সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় বসার ঘরে ঢুকতেই দেখি, নবতিপর এক ‘যুবক’ সোফায় বসে আছেন। আমাদের দেখে হাসি মুখে কুশল জানতে চাইলেন। তাঁর পাশে বই, নোটখাতা, কলম—সবকিছু গুছিয়ে রাখা। এই যুবকের নাম বদরুদ্দীন উমর।
আমরা তিনজন—প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ও আমি গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। উপলক্ষ প্রথমা থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের বামপন্থার সুরতহাল: বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস পরিক্রমা বইটি তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া।
কথা শুরুর আগেই উমর ভাই সংস্কৃতির সাম্প্রতিক সংখ্যাটি হাতে তুলে দিলেন। তিনি ৫০ বছর ধরে পত্রিকাটি বের করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রায় বিরল ঘটনা।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কেমন আছেন?’ বললেন, ‘বয়স তো হয়েছে। আমার বয়সের কেউ বেঁচে নেই। এত বন্ধুবান্ধব ছিল। সালাহউদ্দিন ভাই (ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দীন আহমদ), মুশাররফ হোসেন (অর্থনীতিবিদ), সিদ্দিকী সাহেব (জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী)—কেউ তো নেই।’ বয়স হয়েছে মানে ৯৩ বছর।
জানতে চাই, দেশের অবস্থা কী?
উমর ভাই বললেন, খুবই অবাক কাণ্ড যে একটি সরকারের পতনের পর তাদের যে দল, দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী, অনুগত পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা এভাবে বাড়ি ছেড়ে পালাবেন, এটা নজিরবিহীন ঘটনা। এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, শেখ হাসিনা দেশের মানুষের ওপর কতটা জুলুম করেছেন। জনরোষের ভয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন।
কেন এমন হলো?
উমর ভাইয়ের উত্তর, ‘তিনি ভেবেছিলেন, দেশটা তাঁর বাবার জমিদারি। সব প্রতিষ্ঠানের নাম নিজের ও পরিবারের নামে করেছিলেন। সেদিন দেখলাম, আটটি হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, যেগুলো তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে ছিল। এ রকম শত শত প্রতিষ্ঠান নিজের পরিবারের নামে করেছে। হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, সেতু, সেনানিবাস—কোনো কিছু বাদ নেই। এ ছাড়া লুটপাট, দুর্নীতি ও বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন তো আছেই।’
প্রশ্ন করি, এখন ইউনূস সাহেব কেমন চালাচ্ছেন?
তিনি বললেন, এখন দেশের যে সমস্যা, এটা সামাল দেওয়া খুবই মুশকিল। দেশে এক শ রকম সমস্যা আছে। সব সমাধান করা এই সরকারের দায়িত্ব নয়। সোজা কথা, যদি তারা বলে দেয়, আমরা এই এই কাজ করব, মানুষ বুঝতে পারত। যেমন নির্বাচন করার জন্য যা করা প্রয়োজন। যে কটি জিনিস সরকারের আয়ত্তের মধ্যে আছে, সেগুলো করে ফেলুক। দৈনিক বণিকবার্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইউনূস সাহেব বলেছেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার না চায়, এখনই নির্বাচন দেব। এটা তো হুমকির মতো শোনা গেল। সরকারকে তো বলতে হবে, আমি এটা করব। এত দিন থাকব। কিন্তু সেটা বলছেন না।
এই সরকারের কত দিন থাকা উচিত বলে মনে করেন?
বদরুদ্দীন উমরের জবাব, ‘ড. ইউনূস আল–জাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাব এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এর চেয়ে কম সময় থাকবে। এ নিয়ে সমালোচনা হলে তাঁর অফিস থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, “তিনি চার বছর থাকার কথা বলেননি।’’ তবে প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে কথাটি বলেছেন, তাতে মনের ইচ্ছাটা হয়তো প্রকাশ পেয়েছে। আমি মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার চার বছর থাকবে না। এক বছর থাকলেই সেটা বেশি হবে। বিএনপি তো নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে। তারা ক্ষমতার দোরগোড়ায়। নির্বাচন না হলে ঘরে ঢুকবে কীভাবে? অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, এখনই নির্বাচন দরকার নেই। আওয়ামী লীগ আমলে দলটির অবস্থা কাহিল ছিল। অবস্থা ভবিষ্যতে খুব ভালো হবে মনে হয় না। জামায়াত মনে করে, দুই বছর পর নির্বাচন হলে তারা বেশি আসন পাবে। এ রকম একটা টালমাটাল সময়ে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, বলা মুশকিল।’
এই পর্যায়ে সম্পাদক মতিউর রহমান জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে বারবার এ রকম টালমাটাল অবস্থা হয় কেন?
উমর ভাই কিছুটা নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললেন, এই দেশের যে মানুষ, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে মননশীলতা কম। তাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও আবেগ বেশি। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বরাতে তিনি আরও যোগ করেন, ‘‘দেশটা ইংরেজরা দখল না করে ফরাসিরা দখল করতে পারত। এখানকার লোকদের আবেগ–অনুভূতি ফরাসিদের সঙ্গে খাপ খায়। মানুষের মধ্যে আবেগ-উচ্ছ্বাস বেশি।’’
এই প্রসঙ্গে উমর ভাই তাঁর বাবা অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিমের একটি ঘটনা জানালেন । হাশিম সাহেব বরিশাল অঞ্চলের এক মুসলিম লীগ নেতার সঙ্গে আলাপকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা বারবার মত বদলাও কেন?’ উত্তরে ওই নেতা বলেছিলেন, ‘আমরা তো নদীভাঙনের মধ্যে আছি। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকব কীভাবে?’
উমর ভাইয়ের স্বগতোক্তি, এখানকার মানুষের মধ্যে যে আবেগের প্রাবাল্য, সেটা কতখানি রেসিয়াল (জাতিগত) আর কতখানি ভৌগলিক বলা মুশকিল।
উমর ভাইয়ের সোজাসাপটা উত্তর, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অসম্মানজনক। বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছে। হাসিনা সবাইকে ভাগ দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদেরও নানা রকম সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে। অনেক দিন আগে একজন বুদ্ধিজীবীকে কী একটা বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে সই দিতে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, ‘খবরদার আমার নাম দিয়ো না।’ অথচ সমাজে তাঁর ভিন্ন ভাবমূর্তি আছে। এসব কারণে এখন আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা লুকিয়ে আছেন।
আমাদের পরের প্রশ্ন ছিল, এই যে ছাত্র গণ–অভ্যুত্থান হলো এটাকে কীভাবে দেখছেন? উমর ভাই বললেন, দক্ষিণ এশিয়া বা উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানে তো অভ্যুত্থান বলে কোনো জিনিস নেই। সারা ভারতে কেউ অভ্যুত্থানের চিন্তা করে না। পাকিস্তানেও নয়। তার কারণ সেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাস। আমাদের এখানকার প্রায় সব মানুষ সমগোত্রীয় (পাহাড় ও সমতলের কিছু জাতিগোষ্ঠী ছাড়া)। ভারতে দশ রকমের ভাষা ও জনগোষ্ঠী আছে। এখানে মানুষের যে সমগোত্রীয়তা, সেটা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আরেকটি বিষয় হলো, এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক কর্তব্যটা ঠিকমতো পালন করতে পারছে না । সে জন্যই বারবার গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে। এবার সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান হয়েছে এ কারণে যে মানুষের ওপর জুলুমটা বেশি ছিল। কোনো রাজনৈতিক দল প্রতিরোধ করতে পারছিল না। ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে সেটা সফল হলো। এখন যে টালমাটাল অবস্থা হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। এখানে ক্ষমতাসীন দল পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
জানতে চাই, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কেমন ছিল?
উমর ভাইয়ের সোজাসাপটা উত্তর, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অসম্মানজনক। বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছে। হাসিনা সবাইকে ভাগ দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদেরও নানা রকম সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে। অনেক দিন আগে একজন বুদ্ধিজীবীকে কী একটা বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে সই দিতে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, ‘খবরদার আমার নাম দিয়ো না।’ অথচ সমাজে তাঁর ভিন্ন ভাবমূর্তি আছে। এসব কারণে এখন আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা লুকিয়ে আছেন।
আমাদের পরের শেষ প্রশ্ন, সামনে ভালো কিছু হবে বলে মনে করেন?
উমর ভাই জবাব দিলেন, ‘শেখ হাসিনার সময়ে যা হয়েছে, তার চেয়ে খারাপ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান সরকার কতটা সামাল দিতে পারবে, সেই প্রশ্ন আছে। আরেকটি বিষয় হলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তো শাসক শ্রেণির অংশ। গত পার্লামেন্টের প্রায় ৮০ শতাংশ তাঁরা ছিলেন। আগের আমলের রাজনৈতিক লোকেরা নেই; অর্থনৈতিক লোকেরা আছেন।
তিনি যোগ করলেন, এখানে মানুষ শ্রেণি বিশ্লেষণ করে না। শ্রেণি বিশ্লেষণ করলেই ভাবে, লোকটি কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন। যে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ক্ষমতায় ছিল, বিএনপি এলেও তারা থাকবে। দেশ ভালো চলবে কী করে? শ্রমিকেরা বকেয়া বেতনের জন্য আন্দোলন করছেন; কোনো বাড়তি সুবিধার জন্য নয়। এটা কি আর কোনো দেশে হয়? কোনো পরিবর্তন তো হলো না।
বাংলাদেশ হোমোজিনাস বা সমগোত্রীয় হওয়া সত্ত্বেও এত ভাগ কেন? এর জবাব দিতে গিয়ে তিনি ঈশ্বর চন্দ্রগুপ্তের কবিতার উদ্ধৃতি দিলে বললেন,“এত ভঙ্গ বঙ্গ দেশ তবু রঙ্গে ভরা।” বামপন্থীদের সম্পর্কে উমর ভাইয়ের মন্তব্য: এখানে বামপন্থীদের মধ্যে ভাঙন আছে, আবার একসঙ্গে থাকার চেষ্টাও তারা করেছে। স্বাধীনতার পর বামপন্থীদের একাংশ শেখ মুজিবের সঙ্গে হাত মেলালেন। শেখ মুজিবের বাড়িতে আগুন দেওয়া নিয়ে অনেক বামপন্থীও হাহুতাশ করছেন। বলছেন, এটা করা ঠিক হয়নি। বুঝলাম, এটা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো সাধারণ মানুষ শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ প্রকাশ করল কেন? এর দায় তো শেখ হাসিনার। শেখ মুজিবের একটা ভাবমূর্তি ছিল। শেখ হাসিনা সেটার অপব্যবহার করেছেন। ফেব্রুয়ারি এলেই হাসিনা একটা অভিযোগ করতেন, ‘‘ভাষা আন্দোলনে তাঁর বাবার যে অবদান ছিল, সেটা আমি খর্ব করেছি।’’ কিন্তু কাউকে বড় করা বা কাউকে ছোট করা আমার কাজ নয়।’
মতিউর রহমান উমর ভাইদের উয়ারীর বাসা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি উত্তরে বললেন, ‘উয়ারীর বাসাটি সরকারি ছিল। আইয়ুব খানকে বললেই বরাদ্দ পেতেন। কিন্তু বাবা (আবুল হাশিম) সেটি করেননি। আমরা আর্থিক কষ্টের মধ্যে ছিলাম। জিয়াউর রহমানের সময় জিনিসপত্র বাড়ি থেকে বাইরে ফেলে দেওয়া হলো। আমি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। আমার আত্মীয় মেজর জেনারেল (অব.) গোলাম দস্তগীর তদবির করেও কিছু করতে পারলেন না। জিয়া হয়তো বাবার নামই শোনেননি।’
উমর ভাইয়ের পৈত্রিক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান। কিশোর বয়সে চলে এলেও সেখানকার স্মৃতি ভুলতে পারেন না।
জিজ্ঞেস করি, সর্বশেষ কবে বর্ধমানে গিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি। আগে সব সময় যেতাম। ওখানের জন্য টান আছে। ১৮ বছর বয়সে এসেছি। অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। এখন কেউ নেই। আত্মীয়স্বজন ছিল। ওখানে আমাদের যেসব আত্মীয় ছিলেন, তাঁরা ভালো করেছেন। তাঁরা স্পিকার, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু এখানে কেউ কিছু করতে পারেননি।
উমরের কাজ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অনেকে লেখালেখি করলেও এখানে তেমন আলোচনা হয়নি। এ নিয়ে তাঁর খেদটা যৌক্তিক বলেই মনে হয়। ফেরার পথে উমর ভাইয়ের শেষ কথা ছিল, ‘ যে জীবন আমি যাপন করতে চেয়েছি, সেটাই যাপন করছি।’
PROTHOM ALO