কয়েক সপ্তাহের তীব্র আন্দোলনে সরকারের পতন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর যে সাংবাদিকেরা ওই সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে এখন আইনি অভিযোগ দায়ের করেছেন অনেকে৷
দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছিল, তারা দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷
ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা এবং সরকারের গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, যারা ‘জনমত গঠনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সরকারকে গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে’ তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে৷
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভে এক হাজারের বেশি আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন৷ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলেও জানিয়েছে সরকার৷
‘সাধারণ মানুষের’ আইনি অভিযোগ
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর দায়ের করা মামলাগুলোতে তদন্তকারী সংস্থাগুলো যদি অভিযুক্ত সাংবাদিকদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করা হবে৷’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কেউ এই অভিযোগগুলো দায়ের করেনি৷ এগুলো সাধারণ মানুষ দায়ের করেছে৷ মামলাগুলো ভিত্তিহীন হলে, অভিযুক্তরা মামলা থেকে অব্যহতির জন্য আদালতে আবেদনের সুযোগ পাবে৷’
এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে মামলা করা থেকে বিরত রাখার অধিকার সরকারের নেই৷ এবং পুলিশেরও অভিযোগ আমলে না নেওয়ার সুযোগ নেই৷’
অভিযোগের প্রেক্ষিতে এরই মধ্যে যেসকল সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের জামিনের বিষয়ে উপদেষ্টা আরিফ বলেন, ‘বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন৷ তবে সাংবাদিকদের জেলে আটকে রাখার কোনো অভিপ্রায় সরকারের নেই৷’
অন্তর্বর্তী সরকারের আরেক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘অভিযুক্ত সাংবাদিকদের গ্রেফতার করতে সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করছে না৷’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ
এদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এভাবে মামলা করার বিষয়টি নিয়ে অধিকার সংগঠনগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে৷
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস, রিপোর্টার্স উইদাইট বর্ডার্সসহ অধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সুবিচার নিশ্চিত করতে এবং অভিযুক্তদের আইনি প্রক্রিয়ার যে অধিকার রয়েছে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে৷
অধিকারকর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশে মিথ্যা মামলা দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়৷ আগের সরকার নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এবং বিরোধীদের দমন-পীড়নের ক্ষেত্র তৈরি করতে এমন কৌশল ব্যবহার করত৷
এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, এই মামলাগুলো দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি৷
এ ধরনের মামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাও করেন তিনি৷
মাসুদ কামাল জানান, তিনি নিশ্চিত-বেশিরভাগ মামলার অভিযোগই প্রমাণ করা যাবে না৷ তিনি মনে করেন, এ ধরনের মামালা করার মধ্য দিয়ে উদ্বেগজনক নজির তৈরি করছে৷
বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক আঙ্গুর নাহার মন্টি মনে করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ফৌজদারি মামলা দায়ের করা অনুচিত৷ মন্টি বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করার প্রবণতা এবং ফৌজদারি মামলা দায়ের করার ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে এবং গণমামাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করতে পারে৷’
মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী জেডআই খান পান্না বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়, তারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহার করারও পদক্ষেপ নেবে৷
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি বলেন, ‘সাংবাদিকদের ন্যায়সঙ্গতভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে কিনা তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়৷ কারণ, ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি৷’
jugantar