কিংস পার্টিখ্যাত বিএনএমে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ না দিলেও নতুন এই দল গঠনে নেপথ্যের কারিগর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। বহুল আলোচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএমের জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে আবেদন ফরম সংগ্রহ করিয়েছেন তিনি। এমনকি দলের নামটিও তাঁর দেওয়া বলে দাবি করেছেন এর নেতারা। শুধু তাই নয়, নতুন এ দলে যোগ দিতে মেজর হাফিজের হাতেই আবেদন ফরম তুলে দিয়েছিলেন ক্রিকেটের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।
বিএনপির বিক্ষুব্ধ নেতা হাফিজ উদ্দিনের বাসায় সাকিবের বিএনএমের সদস্য ফরম পূরণ করে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি পর্বের ছবি সমকাল পেয়েছে। ওই সময়ে দলটির তৎকালীন সদস্য সচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেজর (অব.) কামরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে নতুন দলে না গিয়ে সাকিব আল হাসান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হয়েছেন।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ই নতুন দলটি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পেয়েছে বলেও আলোচনা রয়েছে। অথচ ইসির সব শর্ত পূরণ করেও নিবন্ধন পায়নি বলে অভিযোগ এনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বেশ কয়েকটি দল। এর মধ্যে আছে– নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)।
বিএনএমের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দলের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনের বনানীর বাসায় একাধিক বৈঠক হয়েছে। হাফিজ উদ্দিন আহমদ দলের চেয়ারম্যান এবং সাকিব আল হাসান কো-চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল। তারা পরে সুবিধাজনক সময়ে যোগ দেবেন এই আশ্বাস দেওয়ায় দলটির কমিটি গঠনের সময় ওই দুটি পদ শূন্য রাখা হয়েছিল। পর্দার আড়ালে থেকেই হাফিজ উদ্দিন দলটির নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণে ভূমিকা রেখেছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ না মেলায় দু’জনের কেউই নতুন দলে যোগদান করেননি।
অবশ্য বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ গতকাল রোববার সমকালকে বলেন, তাঁকে নতুন রাজনৈতিক দল বিএনএমের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি বেইমানি করতে চাননি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলটি গঠনে নেপথ্যে ভূমিকা রাখা ও তাঁর বাসায় একাধিক বৈঠকের কথা সঠিক নয়। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান তাঁর হাতে ফরম দিয়ে যোগদানের বিষয়টিও এড়িয়ে যান মেজর (অব.) হাফিজ।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানকে একাধিকবার মোবাইলে ফোন করলেও তিনি ধরেননি। অবশ্য বিএনএমে সাকিবের যোগদানের গুঞ্জন সম্পর্কে সমকালকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সাকিব। কিন্তু আবেদন ফরম পূরণ করে সাকিবের বিএনএমে যোগদানের ‘প্রমাণস্বরূপ’ ছবির ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
বিগত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যাপক গুঞ্জন ছিল– হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিএনএমে যোগ দিচ্ছেন। বিএনপিতে কোণঠাসা ও বঞ্চিত বিভিন্ন স্তরের অনেক নেতা ও সাবেক মন্ত্রী-এমপিও দলটিতে যোগ দেবেন; এমনকি চমক হিসেবে কৃতী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান দলটিতে যোগদানের খবরের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন নেতারা। ১৮ নভেম্বর ‘বিএনএমে যোগদানের গুঞ্জন মেজর হাফিজ ও সাকিবের’ শীর্ষক সংবাদও সমকালে প্রকাশিত হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতিতে কোণঠাসা দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় হয়েছেন। ভারতে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর কারাভোগ শেষে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁকে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের বীরউত্তম হিসেবে তাঁকে বিএনপির মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির বৈঠকের পর তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে অনেক অনুরোধ করেছিলেন। তিনি রাজি হয়নি। বিএনপিতে আছেন এবং বিএনপিতে থাকবেন।
তবে সূত্র জানায়, বিএনপির প্রবীণ এই নেতা নতুন দলটিতে যোগ দিলে দলটির অবহেলিত বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্যেরও যোগদানের ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে নানা হিসাবনিকাশ করে হাফিজ উদ্দিন যোগদান না করায় বিএনপির ওই সংসদ সদস্যরাও যোগদান করেননি। হাফিজ যোগ না দিলেও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর বিএনএমে যোগ দিলে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।
নাম প্রকাশ না করে বিএনপির একজন সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না। তাদের কথা ও কাজে মিল নেই। তারা নতুন দলে না গিয়ে ভালো করেছেন। যারা বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপিতে গেছেন তারা দু’কূলই হারিয়েছেন। বিশেষ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ও বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনএমের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ড. আবদুর রহমান, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, বহিষ্কৃত সাবেক বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার কিংস পার্টি দুটিতে যোগ দিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জামানতও হারিয়েছেন। অথচ তাদের ছাড় দিয়ে সংসদ সদস্য করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।
বিএনএমের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও মুখপাত্র মেজর (অব.) ব্যারিস্টার সারওয়ার আলম সমকালকে বলেন, বিএনপির রাজনীতিতে হতাশ হয়ে আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। শুরুতে তিনি, মেজর জেনারেল (অব.) এহতেশাম হক, ড. জাকির হোসেনসহ (প্রয়াত) অনেকে যুক্ত হন। সেই সময় কমপক্ষে ৪০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, শতাধিক আইনজীবী তাদের সঙ্গে যুক্ত হন– যার ৮০ ভাগ রাজনীতিতে নতুন। সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তাদের এ উদ্যোগ দেখে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিএনপির রাজনীতি করা সম্ভব নয় বলে ২০১৯ সালের দিকে তাদের উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এমনকি নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন। এর পর ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার তাদের সঙ্গে তিনি তাঁর বনানীর বাসায় বৈঠক করেন।
বিএনএম গঠনের সঙ্গে জড়িত নেতারা জানান, ২০২০ সাল থেকে মেজর হাফিজকে তারা অনুরোধ করছিলেন, নেতৃত্ব নিতে চাইলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। কিন্তু তিনি বিভিন্নভাবে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। তাদের বিভিন্ন অজুহাত ও আশ্বাস প্রদান করতে থাকেন। তারা তাঁকে বারবার বলেছেন, ‘আপনি নতুন ধারার রাজনীতি করতে চাইলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, আমাদের এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ ভিন্নধারার রাজনৈতিক উদ্যোগ। আমরা কোনো দল ভাঙার দায়িত্ব নেব না। কোনো স্বৈরাচারীর দোসরও হতে চাই না। প্রায় শতবার তাঁর বাসায় মিটিং করলেন। সেসব মিটিংয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিবিদও ছিলেন। তখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, নতুন নেতা হিসেবে রাজনৈতিক দল গঠন করছেন তিনি। এখন তিনি নিজেকে ‘সাধু’ বানাচ্ছেন।
বিএনএমের নেতাদের দাবি, ২০২২ সালের জুলাইয়ে বিএনএমের উদ্যোগী নেতাদের ডেকে মেজর হাফিজ দলের নাম চূড়ান্ত করে দিলেন। তাঁর পরামর্শে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিএনএমের নিবন্ধনের কার্যক্রম শুরু হয়। নিবন্ধন ফরম মুক্তিযোদ্ধা দলের একজন শীর্ষ নেতা দিয়ে সংগ্রহ করেন তিনি। উদ্যোগী নেতাদের মধ্যে হাফিজ উদ্দিনের পছন্দের লোক হিসেবে বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ড. আবদুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) মো. হানিফকে সদস্য সচিব করেন।
নেতারা আরও জানান, নিবন্ধনের আবেদন করে তুলনামূলক সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী অনেক দল নিবন্ধন না পেলেও গত বছরের ১০ আগস্ট ইসির নিবন্ধন পেল বিএনএম। এর পর ১৮ আগস্ট মেজর (অব.) হাফিজ তাঁর বাসায় বিএনএমের আহ্বায়ক কমিটির বৈঠক ডাকলেন। এমনকি ১৮ থেকে ২৪ আগস্টের মধ্যে তিনি বিএনএমে যোগদান করে নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। একাধিকবার তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।
বিএনএম বিক্ষুব্ধ কয়েকজন নেতা জানান, তারা কয়েকজন ‘পাতানো নির্বাচনে’ যাবেন না বলায় হঠাৎ করেই মেজর (অব.) হাফিজ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। এর পরই তারা জানতে পারেন, গোপন বৈঠকের মাধ্যমে একটি কাউন্সিল করা হয়েছে। সেখানে হাফিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে একটি কমিটি করা হয়। সেই কমিটিতে কারা থাকবেন, তা তিনি নিজেই লিখে দেন। অর্থাৎ তিনিই বিএনএম নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। সরকারকে তিনি এই ধারণা দেন, তিনি সময়মতো ‘ওপেন’ হবেন। অবশ্য তখন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদও হাফিজ উদ্দিনের যোগদানের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণাও দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ও নেতারা বলেন, ২০১৯ সাল থেকে অসংখ্যবার বৈঠক করলেও শেষ মুহূর্তে মাত্র ১ মিনিটেই তাদের বাদ দিয়ে ফ্রিডম পার্টির সদস্য ড. মো. শাহজাহান মহাসচিব ও ক্যাপ্টেন (অব.) কামরুল ইসলামসহ কিছু পছন্দের লোক দিয়ে তাদের গড়া দলকে পাতানো নির্বাচনে পাঠালেন।
অবশ্য বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনএমের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুর রহমান সমকালকে বলেছেন, মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিএনপিতে অবমূল্যায়িত ছিলেন। ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু বিএনপি ছাড়তে চাননি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি তাঁর আস্থা ও দুর্বলতা ছিল। আমার মনে হয়, নানামুখী চাপের মুখে নতুন দলে যোগদানের ব্যাপারে ‘কৌশলী ভূমিকা’ নিয়ে সময় পার করেছেন।
samakal