- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৯ অক্টোবর ২০২২, ০৭:৩৩
ব্যবসায়ীরা আগের দামেই বিক্রি করছেন সয়াবিন তেল৷ তাদের যুক্তি, আগে বেশি দামে আমদানি করেছেন, তাই আগের দামে বিক্রি করছেন তারা৷ এই অজুহাতে ভোক্তাদের পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা৷
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, বাজারে এখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল খুচরা বিক্রি হওয়ার কথা ১৭৮ টাকায়৷ আর খোলা তেল প্রতি লিটার ১৫৮ টাকায়৷
বাস্তবে এখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৯০ থেকে ২০০ টাকা আর খোলা প্রতি লিটার সর্বনিম্ন ১৭৫ টাকা৷
ভোক্তা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন সয়াবিন তেলের চাহিদা পাঁচ হাজার টন৷ ওই হিসাবে, গত চার দিনে ২০ হাজার টন অর্থাৎ দুই কোটি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে৷ প্রতি লিটারে ১৪ টাকা করে বাড়তি আদায় করে ভোক্তাদের কাছ থেকে চার দিনে মোট ২৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা৷ অর্থাৎ দিনে সাত কোটি করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা৷
কৌশল করে ব্যবসায়ীরা এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে-এ বিষয়টি জানে ভোক্তা অধিদপ্তর৷ কিন্তু বাজারে ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী অবস্থানের কাছে অসহায় সংস্থাটি৷ তবে দু-একদিনের মধ্যেই দাম ঠিক হযে যাবে এমন আশা অধিদফতরের৷
বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমে যাওয়ায় সরকার গত ৩ অক্টোবর দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম সমন্বয় করা উদ্যোগ নেয়৷ এরই অংশ হিসেবে বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ১৪ টাকা এবং খোলা তেল লিটারে ১৭ টাকা কমানো হয়েছে৷ আর পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৮৮০ টাকা৷ ৪ অক্টোবর থেকেই এই মূল্য কার্যকর হওয়ার কথা৷
এর আগে গত ২৩ আগস্ট প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯২ এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার৷ আর ওই সময় পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৪৫ টাকা৷
নতুন দাম নির্ধারণের পর বাজারে এখনো ২৩ আগস্টের দামেই তেল বিক্রি হচ্ছে৷
শুধু তাই নয়, বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল আগের দামে বিক্রি হলেও কোনো কোনো জায়গায় খোলা তেল আগের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে৷
রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা চাকরিজীবী স্বপন মিয়া৷ তিনি জানান, শনিবার এক লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকায় কিনেছেন তার বাসার পাশের দোকান থেকে৷ অথচ সরকারের নির্ধারিত দাম ১৫৮ টাকা৷
তিনি বলেন, ‘নির্ধারতি দামের কথা বললে দোকানদার বলেন, তেল নেই, অন্য জায়গা থেকে কিনেন৷’
হাতিরপুল এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জব্বার জানান, তিনি পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেল আগের দাম ৯৪৫ টাকায়ই কিনেছেন৷ তার দাবি, কেউ নতুন দামে তেল দিচেছ না৷ কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে৷
বিক্রেতারা বলছেন, তাদের কাছে নতুন তেল আসেনি আর তাই আগের দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের৷
কলাবাগানের এফএএফ স্টোরের মিন্টু মিয়া বলেন, ‘আমাদের কিছু করার নাই৷ আমাদের কাছে নতুন তেল আসেনি৷ ফলে আমরা আগের দামেই বিক্রি করছি৷ নতুন তেল এলে তখন আমরা কম দামে বিক্রি করব৷’
তিনি আরো বলেন, ‘বোতলের গায়ে যে দাম লেখা থাকে সেই আমাদের দামেই বিক্রির নির্দেশ আছে৷’
তবে আমদানিকারকদের দাবি, তারা দাম কমানোর ঘোষণা দিলেও খুচরা পর্যায়ে কেন কমছে না সেটি জানে না৷
ভোজ্যতেল আমদানিকারক সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তীর কাছে সয়াবিন তেলের দাম না কমার কারণ জানতে চাইলে তিলি বলেন, ‘খুচরা পর্যায়ে কেন কমছে না আমি তা জানিনা৷ আমরা তো কমানোর ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি৷’
ব্যবসায়ীদের এই কৌশল ঠেকাতে ভোক্তা অধিদপ্তর এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)৷
সংস্থাটির সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা জেনেশুনেই কৌশল করে এই লুটপাট চালাচ্ছে৷ তেলের নতুন দাম ব্যবসায়ীরাই আলোচনা করে ঠিক করেছে৷ ৪ অক্টোবর থেকে কার্যকর করার কথা তারাই বলেছে, কিন্তু করছে না৷ তারা আগেই বেশি দামের সয়াবিন তেল ডিলারদের মাধ্যমে দিয়ে রেখেছে৷ সেই তেল তারা এখন বিক্রি করছে৷ নতুন তেল দিচ্ছে না৷ ওই তেল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা দাম বাস্তবে কমাবে না৷’
তিনি জানান, নিয়ম হলো তেলের দাম সমন্বয়ের সাথে সাথে বাজার থেকে তুলে নিয়ে নতুন দাম লিখে বাজারে ছাড়তে হবে৷ দাম কমলে সেটা তারা করে না৷ বাড়লে সাথে সাথেই করে ফেলে৷ বোতলের গায়ে নতুন দাম লেখার অপেক্ষাও করে না তারা৷
তার কথা, ‘এখন এই ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তর এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব৷ কিন্তু তারা নিচ্ছে না৷ কারণ এই সরকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করে৷ সাধারণ মানুষের কথা তাদের মাথায় নেই৷’
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা চাইলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি৷ কিন্তু ব্যবসায়ীদের সাপ্লাই চেইন অনেক বড়৷ তাই সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এখনই কিছু না করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি৷’
তিনি স্বীকার করেন, ‘ব্যবসায়ীরা এখন অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে৷ তাদের কাছে আগের দামে যে তেল আছে সেটা বিক্রি করছে আগের দামেই৷ তাদের কৌশল হলো সেটা শেষ করার পর তারা কম দামে বিক্রি করবে৷ কিন্তু আইনে এটা পারে না৷ তারাই ৪ অক্টোবর থেকে দাম কমানোর ঘোষণা দিয়ে এখন খুচরা বিক্রেতা, ডিলার এমনকি ফ্যাক্টরিতে থাকা তেল বেশি দামে বিক্রি করছে৷ কিন্তু দাম বাড়ালে তারা সাথে সাথেই বাড়িয়ে ফেলে৷ এটা ব্যবসায়ীদের অসৎ মাননিসকতা৷ এর পরিবর্তন না হলে শুধু আইন দিয়ে কিছু হবে না৷’
তিনি বলেন, ‘ব্যসায়ীয়া এখন শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেলেই প্রতিদিন এক কোটি ৪০ লাখ টাকা বাড়তি নিচ্ছেন৷ আরো তো খোলা তেল আছে৷ তারা এটা অন্যায়ভাবে নিচ্ছে৷’
তবে তিনি আশা করেন আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে দাম কমবে৷ নির্ধারিত নতুন দামেই তেল পাওয়া যাবে৷ সাপ্লাই শুরু হয়েছে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে