প্রকাশিত: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:২৪
মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার
শুরুতেই অল্প একটু কবিতা ছন্দের উক্তি দিয়ে প্রিয় বড়ভাই মাহফুজ উল্লাহ’র চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিক উপলক্ষে আমার এই লেখাটি।
ছবির ফ্রেমে ঐ ছবিটা
যেই ছবিটা ছবির ফ্রেমে
তাকিয়ে দেখো
চিরকালই চেতন মনে
নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে
পাথরচোখে
আমার দিকে অবিরত
বলছে কিছু স্মৃতির কথা!
সে – সব কথা
কেউ জানে না আমি জানি __
যেই ছবিটা পাথর বুকে
খোদাই করা
হৃদগভীরে অশ্রুজলে
খুব নীরবে উদাস চোখে
আকাশ মেঘে
আমার দিকে চেয়েই থাকে !!
প্রিয়জনের ব্যথায় কাঁদে
অবিস্মৃত
ফ্রেমের ছবি চেয়ে থাকে
জানে কেবল ঐ ছবিটা
সবার মাঝে
হৃদয় ফ্রেমে আঁকা থাকে
তেমনি আছে আমার স্মৃতি
ধূসর মাটি
নোনাজলে ধূসরলিপি
কেমন করে আদিম ধরা
স্মৃতির পটে
গোপন রাখে আমায় পলেপলে।।
স্মৃতির অ্যালবাম খোলা জানালায় আকাশচুম্বী মন – অশ্রুজলে স্মৃতির পটে প্রিয় আছেন মাহফুজ উল্লাহ।
একজন মাহফুজ উল্লাহর মৃত্যু নেই। কারণ তিনি অনেক কিছুই রেখে গেছেন। তিনি কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেন না। তিনি ছিলেন উদার হৃদয়ের মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে আমরা লক্ষ করেছি দল-মত নির্বিশেষে সবাই শোকাহত করেছে। সবাই যখন বিভক্ত আমরা সাংবাদিকরাও বিভক্ত। এই বিভক্ত সমাজে মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন একজন দিকনির্দেশক।
সৃষ্টিকর্তা যাকে পছন্দ করেন তাকেই ডেকে নেন। মানুষ সে জন্যই মরে। এই অর্থে তিনি কীর্তিমান পুরুষ। মাহফুজ ভাইয়ের মৃত্যুতে একথা আমার বারবার মনে হচ্ছে, মাহফুজ উল্লাহ ভাই চলে গেছেন! গণতান্ত্রিক চিন্তা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তার কারণে তিনি অনন্য অবস্থানে ছিলেন। আমরা তাঁর জন্য দোয়া করব। তাঁর সাথে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় কাটাতে পেরেছি। তাঁর মাধ্যমে আজ আমি এই অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়েছি। দীর্ঘ দশটি বছর একাধারে তাঁর সাথে আমার জীবনের পথচলা। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি আমাকে অনেক আদর ভালোবাসা মাধ্যমে অনেক বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর দেখানো ও শিখানো পথেই আজ আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁর লেখা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই আমাকে আজীবনের জন্য স্বত্বাধিকার (কপিরাইট) করে দিয়ে গেছেন। এটাই হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মহামূল্যবান সম্পদ। ছোট্ট ভাই হিসেবে আমাকে আপন মনে করে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সাথে একাধারে সময় কাটিয়েছেন। যেমন আদর করতেন ঠিক তেমনি ভাবে শাসন ও করতেন আমাকে।
৬৯ বছর বয়সী মাহফুজউল্লাহ ২ এপ্রিল ২০১৯ সালে হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। স্কয়ারে কয়েক দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ১১ এপ্রিল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি হৃদরোগ, কিডনি ও উচ্চ রক্ত চাপজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এর আগে ব্যাংককে একবার তাঁর বাইপাস সার্জারিও হয়েছিল। তিনি ২৭ এপ্রিল ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ৫মিনিটে ব্যাংককের হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
মাহফুজ উল্লাহ শুধু বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিকই ছিলেন না, একাধারে লেখক, কলামিস্ট, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশবিদ ছিলেন তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর ছিলেন। এছাড়াও নোয়াখালী জার্নালিস্ট ফোরামের উপদেষ্টা ছিলেন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম পরিবেশ সাংবাদিকতা শুরু করেন।
১৯৫০ সালের ১০ মার্চ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন দেশের এই খ্যাতিমান সাংবাদিক। তার পিতার নাম হাবিবুল্লাহ এবং মাতার নাম ফয়জুননিসা বেগম। ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত মুজাফফর আহমেদের দৌহিত্র তিনি।
ছাত্রাবস্থাতেই মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকতা পেশায় নিবেদিত হন। বাংলাদেশের একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্মলগ্ন থেকে কাজ করেছেন মাহফুজ উল্লাহ। ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দেন মাহফুজ উল্লাহ। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন মাহফুজ উল্লাহ। চীন গণপ্রজাতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ড-কালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তিনি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাহফুজ উল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন তিনি। ছাত্র রাজনীতির কারণে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন মাহফুজ উল্লাহ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাহফুজ উল্লাহ। বাম রাজনীতি দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করলেও বেশ কয়েক বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মাহফুজ উল্লাহ। যে কারণে তার নাম বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসাবেও পরিচিতি রয়েছে।
রেডিও ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি ছিল মাহফুজ উল্লাহর। তাকে উপস্থাপনাও করতে দেখা গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে একজন সক্রিয় পরিবেশবিদ হিসাবে পরিচিত মাহফুজ উল্লাহ। সেন্টার ফর সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নামক একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহফুজ উল্লাহ। এছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর করজারভেশন অব নেচারের আন্তর্জাতিক পরিচালনা পরিষদের প্রথম বাংলাদেশি সদস্য তিনি।
লেখক হিসেবেও মাহফুজ উল্লাহ প্রশংসিত ছিলেন। তাঁর লেখা অর্ধশতাধিক বই পৃথিবীর বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সংগৃহীত আছে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ: আ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’, ‘যাদুর লাউ’, ‘যে কথা বলতে চাই’, ‘অভ্যুত্থানের ঊনসত্তর’, ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন: গৌরবের দিনলিপি (১৯৫২-৭১)’, ‘উলফা অ্যান্ড দ্য ইনসারজেন্সি ইন আসাম’, ‘স্বাধীনতার প্রথম দশকে বাংলাদেশ’। ২০১৭ সালের শেষ দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে লিখেন ‘বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ হার স্টোরি’। এই বইটি দেশ ও বহির্বিশ্বে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে । প্রকাশনায় দেশের স্বনামধন্য জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা দি ইউনিভার্সাল একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে । এছাড়াও তাঁহার জীবনের সর্বশেষ একটি বিশেষ কাব্য উপন্যাস ( এ কী কেবলই প্রেম -) এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে আমাদের দি ইউনিভার্সাল একাডেমী থেকে ২০১৭ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় । এটাই হচ্ছে মাহফুজ উল্লাহ’র জীবনের একদম শেষ সমাপনী প্রকাশিত গ্রন্থ ।
পরিশেষে লেখাটি পরিসমাপ্তি টেনে নিলাম এইভাবেই – দেহের জমিন রক্তধারা প্রেম বুকেতে মানব _ ধারা
জনম _ জীবন অভিন্ন _ সে কান্না _ হাসি ঐক্য _ প্রেমে।
স্মৃতির পিঞ্জর প্রিয় বড়ভাই মাহফুজ উল্লাহ’কে মহান আল্লাহ তায়ালা যেন ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন আমিন। আমার লেখার মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে সকলের নিকট দোয়া চাই তাঁর জন্য। আমিন ছুম্মা আমিন।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট