২০২২-০৯-২১
গণতন্ত্র এক বৈশ্বিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে যাঁরা চর্চা করেন, এবং যেসব সংস্থা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি বিষয়ে সতর্ক করে এসেছেন। একের পর এক দেশ দ্রুত পেছনে হাঁটার ফলে এখনকার সময়টা হয়ে উঠেছে স্বৈরশাসকদের সময়। এই পরিস্থিতি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বিষয়ে দুটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে- এই কঠিন সময়ে বুদ্ধিজীবীদের প্রাথমিক ভূমিকা কী? একজন বুদ্ধিজীবীর কী করা উচিত? এই প্রশ্নগুলো ওঠার কারণ, কঠিন সময়ে সমাজ সাধারণত বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাঁদেরকে মনে করা হয় জাতির বিবেক। বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করার জন্য আমাদেরকে প্রথমে চলমান সঙ্কটের প্রকৃতি, সম্ভাবনা ও গভীরতা বুঝতে হবে।
সঙ্কটের স্বরূপ
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংস্থার তথ্য থেকে সঙ্কটের মাত্রা বোঝা যায়। ফ্রিডম হাউজের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘২০২১ সালের শেষে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশই মুক্ত নয় এমন সব দেশে বাস করছেন। ১৯৯৭ সালের পর থেকে এটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংখ্যা। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ এখন স্বাধীন দেশে বাস করছেন।’ ২০২২ সালের শুরুর দিকে প্রকাশিত ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) রিপোর্ট বলছে, ‘গণতান্ত্রিকীকরণ বেশি সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে ২০২১ সালে। এ সময়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বসবাসরত মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, সেই সাথে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হয়েছে।’ ইআইইউর তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩৭.১ শতাংশই স্বৈরশাসনের অধীনে বাস করেন। গণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসন দুটির বৈশিষ্ট্যই আছে, এমন মিশ্র ব্যবস্থায় বাস করেন ১৭.২ শতাংশ মানুষ। ৫৩টি দেশে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের অধীনে বাস করেন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৯.৩ শতাংশ। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬.৪ শতাংশ পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করেন। অ-গণতান্ত্রিকীকরণ বা গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে। ফ্রিডম হাউজের মতে, ‘গণতন্ত্রের জন্য বর্তমান হুমকি হলো টানা ১৬ বছর ধরে বৈশ্বিক স্বাধীনতার অবনতির ফল। গত বছর [২০২১] মোট ৬০টি দেশের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, যেখানে উন্নতি হয়েছে মাত্র ২৫টির।’
গণতন্ত্রের এই সঙ্কট দূর কোনো দেশের ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের পরিস্থিতিও একই। যদিও দাবি করা হয় দেশটির শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক, তবু একে বড়োজোর ‘হাইব্রিড বা দোআঁশলা শাসনব্যবস্থা’ বলা যেতে পারে। দোআঁশলা শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও মূলত এটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন।
গণতন্ত্রের এই সঙ্কট দূর কোনো দেশের ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের পরিস্থিতিও একই। যদিও দাবি করা হয় দেশটির শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক, তবু একে বড়োজোর ‘হাইব্রিড বা দোআঁশলা শাসনব্যবস্থা’ বলা যেতে পারে। দোআঁশলা শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও মূলত এটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন
২০১৩ সালের শেষ দিকেই এই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ঘনঘন বিচ্যুতি, প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার এক কেন্দ্রীকরণ এবং সর্বনাশা মেরুকরণ গণতন্ত্রের ধ্বংসের চিহ্ন বহন করে, এবং দেখায় যে, দেশ চলছে স্বৈরতন্ত্রের পথে। গত নয় বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সরকার ব্যবস্থা সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়াই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চরম অধঃপতন এবং স্বৈরশাসনের দিকে ধাবিত হওয়ার চূড়ান্ত উদাহরণ।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়াই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চরম অধঃপতন এবং স্বৈরশাসনের দিকে ধাবিত হওয়ার চূড়ান্ত উদাহরণ
নতুন বৈশিষ্ট্য
অতীতে বিশ্ব গণতন্ত্রের পেছনে ফেরার দুটি পর্যায় প্রত্যক্ষ করেছে- ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪২ সাল এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল । এই দুটি সময়কালে মহাদেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হয়ে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে অবস্থাটা এমন ছিলো যে, হয় গণতান্ত্রিক, নাহলে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। তবে গণতন্ত্রের অধঃপতনের তৃতীয় ঘটনাটি এক অভূতপূর্ব মিশ্র বা হাইব্রিড ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে আশা করা হয়েছিলো, গণতন্ত্র একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চে পরিণত হবে। সংগঠিত গণতান্ত্রিক দেশে অধঃপতন বা বিপরীত দিকে যাত্রা, বিশেষত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বা হাতিয়ার ব্যবহার করে যে তা ঘটতে পারে, সে সময়ে সেটি কল্পনারও অতীত ছিলো। তারপরও ১৯৭৫ সাল থেকে যেসব দেশের জন্ম হয়েছে, সেসবের সাথে সাথে এই সব দেশেও গণতন্ত্রের পেছন যাত্রা ঘটতে শুরু করেছে।
যেসব দেশে গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রা ঘটেছে, সেখানে নাগরিকদের অধিকার খর্ব হয়েছে, রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং গণমাধ্যমের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা করেছে। অতীতের প্রথাগত স্বৈরতন্ত্র যেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতো এবং যাবতীয় গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করতো, নতুন ব্যবস্থায় স্বল্প মাত্রায় এসব অধিকার জারি থাকে। এর ফলে দেখানো যায় যে, ‘গণতন্ত্র মরে যায়নি।’
এই নতুন ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করা যায় শাসক গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিষয়টি থেকে, যাকে বর্ণনা করা হয় নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি হিসেবে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এরিকা ফ্রানজ এবং আন্দ্রেয়া কেনডল-টেলর (The Evolution of Autocracy: Why Authoritarianism Is Becoming More Formidable, Survival, Vol. 59, No. 5, 2017) দেখান যে, স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরের ফলেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক একনায়কত্বের উদ্ভব ঘটেছে। তাঁরা লক্ষ্য করেছেন যে, ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে ঘটা কর্তৃত্ববাদী রূপান্তরের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ব্যক্তিকেন্দ্রিক একনায়কত্বের দিকে গেছে। এই শাসকদের এখন বলা হয় ‘নব্য-একনায়ক’। ফ্রিডম হাউজ থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত আর্চ প্যাডিংটনের এক গবেষণায় এদের বলা হয়েছে ‘নব্য কর্তৃত্ববাদী’ (Freedom House, ‘Breaking Down Democracy: Goals, Strategies and Methods of Modern Authoritarian,’ June 2017)
নতুন এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের যেসব দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা হয়, তার মধ্যে একটি হলো নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। তবে এসব নির্বাচন গণতন্ত্রের উপাদান নয়, এবং গণতান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রেও তা কোনো ভূমিকা রাখে না।
নতুন এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের যেসব দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা হয়, তার মধ্যে একটি হলো নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। তবে এসব নির্বাচন গণতন্ত্রের উপাদান নয়, এবং গণতান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রেও তা কোনো ভূমিকা রাখে না
গণতান্ত্রিকীকরণ বিষয়ক বিশিষ্ট গবেষক আন্দ্রেয়াস শেডলার তাঁর ২০০২ সালের এক প্রবন্ধে লেখেন যে, মিশ্র বা হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন হয়ে ওঠে ‘কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ার’। এই প্রবন্ধটি প্রকাশ হওয়ার পর দুই দশক কেটে গেছে। এখনও আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন দেশে নব্য একনায়কেরা কীভাবে তাঁদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে নির্বাচনকে ব্যবহার করেছেন।
প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে
স্বৈরাচারীকরণের প্রক্রিয়ায় সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, হাইব্রিড শাসন ও এর নেতাদের কর্মকাণ্ড কেবল সাংবিধানিক বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং, নিজেদের রীতিনীতিকে বৈধতা দিতে তারা সরকার ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠনিক দিকগুলো ছাড়িয়ে গিয়েও ব্যবস্থা নেয়। প্রথাগত একনায়কদের থেকে এসব ব্যবস্থা ভিন্ন রকমের ।
হাইব্রিড শাসনব্যবস্থায় এবং যেসব দেশে নানাভাবে নব্য-একনায়কত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সেখানে পরিচয়ের রাজনীতি বা আইডেন্টিটি পলিটিক্সের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এসব ক্ষেত্রে পরিচয়ের রাজনীতি চূড়ান্ত জাতীয়তাবাদে রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেন, ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’, (আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলুন) তখন সেখানে থাকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ এবং খ্রিস্টান ধর্মের মিশ্রণ। সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড, স্যামুয়েল পেরি এবং জোসেফ বেকার ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ২০১৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁরা দেখান, ধর্ম এবং চূড়ান্ত জাতীয়তাবাদের এই মিশ্রণের শেকড় কতোটা গভীরে (‘Make America Christian Again: Christian Nationalism and Voting for Donald Trump in the 2016 Presidential Election, Sociology of Religion, Vol. 2, No. 2, 2018)। রুশ রাষ্ট্রপ্রধান ভ্লাদিমির পুতিন যখন বলেন, ‘রাশিয়া আপ ফ্রম ইটস নি’, (হাঁটু ভাঙ্গা অবস্থা থেকে রাশিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে) অথবা হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘ইউরোপীয়দের জন্যই ইউরোপকে রক্ষা করতে হবে’, তখন তাঁরা জনপ্রিয় উগ্রজাতীয়তাবাদের কথাই বলেন। এই উগ্র জাতীয়তাবাদ কেবল কারো নিজস্ব পরিচয়ের সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়, বরং সেই পরিচয়কে ছাড়িয়ে এই জাতীয়তাবাদ অনেক দূর প্রসারিত। এটি সমাজে বিষাক্ত বিভাজন তৈরি করে এবং তৈরি করে ঘৃণা। বিভাজন তৈরি হয় দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের নামে।
এ ধরনের ঘৃণা দেশের ভেতর থেকেই তৈরি হোক বা বাইরে থেকেই আসুক, এটি আধিপত্যবাদী মনোভাবের লক্ষণ। এর ফলে অসহিষ্ণুতার জন্ম হয়, বৈচিত্র্যকে অগ্রাহ্য করা হয় এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে এটি প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই ঘৃণা তৈরি করা হয় বিরোধী দলের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। সরকারপক্ষের বিরোধিতা করাই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যায়। এভাবেই ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করা হয়। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এই পন্থা যতো অবলম্বন করেছে, ততোই দলটি দেশটিকে আধা-একনায়কত্বের অধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। একই ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র আবরণে দেশপ্রেমের নির্দিষ্ট এক ধরনের চেতনা তৈরি করা হয়েছে, যাকে মনে করা হচ্ছে দেশপ্রেমের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধরন।
নব্য একনায়কদের আরেকটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ইতিহাস। স্বৈরাচারী শাসকেরা ইতিহাস বিষয়ে মোহান্ধ। রাশিয়া ও হাঙ্গেরির ঘটনা প্রবাহ যাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট বয়ান তৈরি করা হয়েছে এবং সরকারি এই ইতিহাসকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে কীভাবে বিভিন্ন আইন তৈরি করা হয়েছে। ভারতের নেতারা ব্যস্ত ইতিহাসের গেরুয়াকরণের যুদ্ধে, যার অর্থ হিন্দুত্বের আদর্শের নিরীখে অতীতকে দেখার মাধ্যমে ইতিহাসের পুনর্লিখন। কিন্তু ইতিহাসের মাত্র একটি পাঠ থাকতে পারে না। সময়ের সঙ্গে ইতিহাস পঠিত এবং পুনঃপঠিত হতে পারে, যেখানে নতুন নতুন উদ্ভাবন ছাড়াও নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও থাকা সম্ভব। যখন ইতিহাসের কোনো একটি সরকারি বয়ানকে ইতিহাসের একমাত্র বয়ান হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তখন ইতিহাসের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের প্রচেষ্টা কেবল শাসনকে বৈধতা দিতেই ব্যবহার করা হয় না, বরং তা ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথও নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং একটি মাত্র বয়ান নির্মাণ শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের জন্য সীমানা নির্ধারণ করে দেয়- কী নিয়ে কথা বলা যাবে, কোন বিষয়ে চুপ থাকতে হবে। এই সীমানা বলবৎ রাখতে আইনী এবং আইনের বাইরে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যার মধ্যে প্রায়শই হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনও থাকে।
যখন ইতিহাসের কোনো একটি সরকারি বয়ানকে ইতিহাসের একমাত্র বয়ান হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তখন ইতিহাসের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের প্রচেষ্টা কেবল শাসনকে বৈধতা দিতেই ব্যবহার করা হয় না, বরং তা ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথও নির্ধারণ করে দেয়
বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী?
গণতন্ত্রের এই সঙ্কটের সময়ে যখন নব্য স্বৈরাচারীরা ক্ষমতায় আসছে, এবং যখন চিন্তা ও মতপ্রকাশের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে, তখন একজন বুদ্ধিজীবী কী ভূমিকা পালন করতে পারেন, তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
১৯৬৭ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, তখন সেই সঙ্কটের সময়ে একজন তরুণ লেখক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই লেখকের নাম নোয়াম চমস্কি। তিনি লেখেন, “বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব সত্য বলা এবং মিথ্যা উন্মোচন করা।” তিনি আরো বলেন, “বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য সরকারের মিথ্যা উদঘাটন করা এবং সরকারের কাজের হেতু ও উদ্দেশ্য, এমনকি কখনো কখনো গুপ্ত অভিপ্রায়ের দিকে লক্ষ্য রেখে এর কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করা।” (The Responsibility of an Intellectual, The New York Review of Books, February 23, 1967) যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম বিষয়ক নীতি এবং অন্ধ অনুসরণ বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করেন চমস্কি, এবং কতিপয় পণ্ডিতের যুদ্ধ বিষয়ক বয়ানকেও বাতিলের খাতায় ফেলে দেন। চমস্কি স্মরণ করিয়ে দেন যে, “বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব অনেক বেশি ‘জনগণের দায়িত্বের চেয়ে’, কেননা বুদ্ধিজীবীরা স্বতন্ত্র কিছু সুবিধা ভোগ করেন।” যদিও তিনি পশ্চিমের, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের কথা বলেছেন, তবু কথাগুলো যে-কোনো সমাজের ক্ষেত্রেই সত্য, বিশেষত সঙ্কটের সময়ে। চমস্কির প্রবন্ধ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যকে সমর্থন করে, একে মহৎ হিসেবে দেখায় এবং বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে এমন সব সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি খন্ডন করে এবং তাঁদের দিকে মনোযোগ আকর্ষন করে।
গণতন্ত্রের এই বৈশ্বিক সংকটের কালে দেশ নির্বিশেষে এই বিষয়টি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। কাউকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচনা করা যায় কিনা, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও এটি কাজে লাগতে পারে। গণতন্ত্রের ভিত্তি আক্রান্ত হওয়ার সময়ে তিনি কী ভূমিকা পালন করেছেন, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য সহনশীলতা ও সমতার বিরুদ্ধে ক্ষতিকর প্রচারণায় তিনি যুক্ত ছিলেন কিনা- তা খতিয়ে দেখা জরুরি। ঘৃণা কেবল ঘৃণারই জন্ম দেয়, তা ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা নির্দিষ্ট কোনো আদর্শের আবরণে প্রকাশিত বা চালিত হলেও। এবং যখন তা ক্ষমতাসীন দলের হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তা আরো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে ভারতের উদাহরণ প্রাসঙ্গিক। অন্য দিকে, বহু ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ক্ষমতাসীন বিজেপির গেরুয়াকরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যে ভূমিকা পালন করছেন, তা দেখিয়ে দেয় যে, এ ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের বিরোধিতা করা সম্ভব।
চমস্কি আরো বলেন, “সত্যের ওপর জোর দেওয়া যদি বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হয়, তাহলে বিভিন্ন ঘটনাকে ইতিহাসের আলোকে দেখাও তাঁদের দায়িত্ব।” তাঁর কথা থেকে এটি স্পষ্ট যে, বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব শঠতা থেকে সত্যকে আলাদা করা এবং তাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁর এই বক্তব্যকে আমরা কাজে লাগাতে পারি, এবং দেখতে পারি কীভাবে স্বৈরশাসকেরা নিজেদের প্রয়োজনমতো ইতিহাসকে বদলায়।
চমস্কি আরো বলেন, “সত্যের ওপর জোর দেওয়া যদি বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হয়, তাহলে বিভিন্ন ঘটনাকে ইতিহাসের আলোকে দেখাও তাঁদের দায়িত্ব।” তাঁর কথা থেকে এটি স্পষ্ট যে, বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব শঠতা থেকে সত্যকে আলাদা করা এবং তাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা
বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার ক্ষেত্রে ভাক্লাভ হাভেল ১৯৮৬ সালে যা বলেছেন তা স্মরণ করতে পারি আমরা: “বুদ্ধিজীবীর উচিত ক্রমাগত প্রশ্ন তোলা, পৃথিবীর দুর্দশার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া, স্বাধীন হওয়ার ফলে ইন্ধন যোগানো, প্রকাশ্য ও গোপন সকল চাপ ও কৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, বিভিন্ন ব্যবস্থা, ক্ষমতা এবং এর সম্মোহন সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা, এবং এসবের মিথ্যাচারের সাক্ষী হওয়া।”
পৃথিবী একটি দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং বহু দেশে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ছে। ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করতে নব্য স্বৈরশাসকেরা আইনী ও আইনবহির্ভূত ব্যবস্থা নিচ্ছেন, এবং ক্ষতিকর মেরুকরণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। স্বৈরশাসকের ধামাধারীরা এসবকে বৈধতা দিতে তৎপর। এমন এক বিরূপ সময়ে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ক্ষমতার মুখোমুখি হয়ে সত্যটা বলা। সরকারি বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করা কেবল একটা দিক, কিন্তু আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো বৈচিত্র্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানো। যতক্ষণ তাঁরা তা না করছেন, ততক্ষণ তাঁরা বুদ্ধিজীবী আখ্যার উপযুক্ত নন।
আলী রীয়াজ
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ এর সভাপতি।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে নিউ এইজে প্রকাশিত