স্বাধীন দেশের গর্ব আমাদের অবশ্যই ফিরে পেতে হবে
- মইনুল হোসেন ১৪ নভেম্বর ২০১৯
জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থা বিলীন হওয়ার কারণে সরকারের ওপর এমনকি নিজেদের গন্তব্যের ওপর জনগণ তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। স্বাধীন দেশে জনগণ হচ্ছে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে কথা বলা যাবে না। কারণ, জনগণের ভোটের নির্বাচনের অবর্তমানে জনগণ কিছু নয়। জনগণের কাছে সরকারেরও কোনো জবাবদিহি নেই। ক্ষমতাসীনদের কোনো জবাবদিহির বালাই নেই। নেতার ব্যক্তিগত আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল থাকা রাজনীতিতে আদর্শ বা নীতির কোনো বাঁধনও থাকে না। তাই সর্বত্র চলছে নীতিহীনদের বাড়াবাড়ি।
রাজনীতি নীতি-আদর্শহীন হতে পারে না। তাই বিরাজনীতিতে নেতাদের সাথে মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সম্পর্ক চাকরিদাতা ও চাকরিজীবী সম্পর্কের মতো। ব্যক্তি হিসেবে কাউকে খুশি রাখা তো রাজনীতির কথা নয়। দেশে তাই চলছে রাজনীতিহীন বিরাজনীতি।
যারা বর্তমানে রাজনীতি করছেন, তারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলছেন। তারা দেশের জন্য কাজ করছেন, স্থানীয়ভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করছেন; কিন্তু তারা মানুষের সুখ-শান্তির কথা বলবেন না। নীতি-চরিত্রের প্রশ্ন তো করা যাবেই না। তারা এটাও ভুলে যান, তারা যে রাস্তাঘাট বা বড় বড় প্রজেক্টের কথা বলছেন তা তো জনগণের টাকায়ই হচ্ছে। এসব তো কন্ট্রাক্টররা করবেন। তাদের কাজ শুধু কমিশন ভাগাভাগি করা।
স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অতীতের রাজনৈতিক নেতাদের ঐতিহ্য, চরিত্র বা অবদানের কথা স্মরণেই রাখছেন না। রাস্তাঘাট তৈরির ‘ঠিকাদারি রাজনীতি’ করতে গিয়ে দেশটিতে চলছে নীতি-চরিত্রহীনতার ভয়াবহ খেলা। ক্ষমতায় থাকতেই হবে, বিত্তশালী হতেই হবে।
রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা মূল্যবোধের প্রতি কোনো প্রকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেতৃত্বের গুণাবলি বিচারের ক্ষেত্রে মোটেও গুরুত্ব পাচ্ছে না। আইনজীবী হতে হলে একজন আইনজীবীর কাছে যেতে হয়। বর্তমান বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের খোঁজে কারো কাছে যেতে হয় না। চাকরি দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারটিই সব কিছু। এর ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়। জনগণের নিঃস্বার্থ সেবা করার রাজনীতি বিদায় নিয়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো মন্ত্রী-এমপিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যিনি তার রাজনৈতিক অবস্থানকে বিপুল বিত্তবৈভব অর্জনে ব্যবহার করেননি। নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধহীন শাসনব্যবস্থায় বিত্তশালী হওয়ার মানসিকতা প্রাধান্য পাওয়াই তো ক্ষমতাসীনদের জন্য স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতায় থেকে সম্পদ অর্জন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
সবচেয়ে বেদনার বিষয় হচ্ছে, যারা আমাদের পাবলিক সার্ভেন্টস তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের কোনো নামগন্ধ নেই। দেশের সংবিধান সংরক্ষণ করার দায়িত্বও তারা পালন করেন না। এমপি এবং মন্ত্রীদের কেউ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়-দায়িত্বও নেই। আমরা স্বাধীন দেশের জনগণ, কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে পারি না। এর চেয়ে আর কত অথর্ব আমরা হতে চাই?
জনগণের সরকারের মূলে আঘাত করছে অনির্বাচিত সরকার। এর আর একটি অদ্ভুত চরিত্র হচ্ছে, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে ব্যাপক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। পাবলিক সার্ভেন্টস যেন ব্যক্তিগত কর্মচারী। তাদেরকে জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করাতে অসুবিধা হচ্ছে না। জনগণের পুলিশ জনগণের পক্ষে থাকতে পারছে না। স্বাধীন দেশের জনগণের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল হওয়া পুলিশের জন্যই অপমানজনক।
জনগণকে সর্বক্ষণ ভয়ভীতির মধ্যে অসহায় করে রাখার জন্য দেশব্যাপী দুর্নীতির দানবীয় শক্তির বিস্তার আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। সরকারের এমন কোনো বিভাগ নেই, যেখানে দুর্নীতি ঢোকেনি। সরকারি অর্থসম্পদ অবাধে ব্যয় করা হচ্ছে, যাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এভাবে জনগণের ভোটাধিকারের ক্ষমতার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে দুর্নীতির ক্ষমতা।
দুর্নীতি ও অপরাধের রাজনীতি সবচেয়ে অমানবিক রূপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার নিষ্ঠুর আচরণে। আবাসিক হলগুলোর মধ্যে ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে ‘টর্চার সেল’। সম্প্রতি বুয়েটের একজন মেধাবী ছাত্রকে সহপাঠীরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। শুধু বুয়েটেই ছাত্রলীগের ৫০টির মতো নির্যাতন কেন্দ্র পাওয়া গেছে।
ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়িয়েছে যে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন কোনো উন্নয়ন নয়। তরুণদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টির কথা ভাবা হচ্ছে না। সরকারের কাছে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের নামই হচ্ছে উন্নয়ন। এসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু সম্পন্ন করার প্রশ্ন নেই, যাতে অর্থের প্রবাহ সচল থাকে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য যাদের সমর্থন দরকার তারা খুশি থাকে। তাই বছরের পর বছর ধরে প্রজেক্টের কাজ চলছে।
প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আমলাদের কথা শুনে সরকার ভাবছে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। তলিয়ে দেখছে না তাদের সরবরাহকৃত জিডিপি সম্পর্কিত তথ্য কতটা সঠিক। তারপর যা সত্য তা হলো, শুধু জিডিপিই জনজীবনে আর্থিক সচ্ছলতা আনে না। সরকারকে জনগণের আর্থিক দুর্গতি কিংবা দুঃখ-কষ্ট উপেক্ষা করেও দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে না।
সরকারের উচিত হবে একই সাথে তুলনামূলক তথ্য সরবরাহ করা, যাতে তাদের কতজন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আর আমরা যারা জনগণ তারা কী পরিমাণ নিঃস্ব হয়েছি তা বোঝার জন্য। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মারাত্মক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি মৃতপ্রায়। দুর্নীতির ভারে মানুষ শ^াসরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দলীয় লোকদের দুর্নীতি আর ফটকাবাজির রমরমা ব্যবসা চলছে। সরকার সম্পূর্ণভাবেই নিজের লোকদের জন্য।
সাধারণভাবে বলা যায়, জনগণের কল্যাণ, তাদের নিরাপত্তা কিংবা পুলিশের কাছে অসহায়ত্ব সরকারের কাছে মোটেই গুরুত্ব পাচ্ছে না এবং সরকারও সেসব সমস্যার সমাধান করার তাগিদ অনুভব করছে না। শিক্ষিত তরুণদের দুর্বৃত্ত হিসেবে ব্যবহার করেই খুশি।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবন কঠিন করে তোলাই উন্নয়ন কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। যেহেতু সরকার জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, তাই সর্বক্ষেত্রে আমলারাই সরকারের ক্ষমতার নির্ভরযোগ্য ভিত্তি। তারাই শক্তির উৎস। সুতরাং তাদেরকে অবশ্যই খুশি রাখতে হয়। জনগণের অর্থে জনগণের বিরুদ্ধে কাজে লাগা সরকারি কর্মচারীদের প্রধান কাজ। জনগণের সেবক হিসেবে তাদেরকে জনস্বার্থে কোনো কাজ করার তাগিদ নেই।
জনগণের ভোটের ক্ষমতা না থাকায় জনগণের সরকারের গোটা ধারণাই উল্টে গেছে। সরকার গঠনে জনগণের ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না বলেই জনগণ উপেক্ষিত হচ্ছে।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অর্থ গোটা সরকারি ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন। আইনের অপব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা না থাকায় কঠিন আইন করার অর্থ আইনের অপব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধি করা। জনগণের জন্য অধিকতর বিপত্তি ডেকে আনা। পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করা সম্ভব হলে পুলিশ নিজ স্বার্থেও তার ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করবে। সরকারের নির্বাচনী জয়-পরাজয় নির্ধারণে যখন পুলিশি শক্তির ব্যবহার করা হয় তখন পুলিশও বুঝে যায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারবে। যখন সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়ায় তখন পুলিশও নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতে পারে। তাই হচ্ছে দেশব্যাপী। সে জন্য পুলিশকে দোষী করাই যথেষ্ট হবে না। কারণ, বর্তমান শাসনব্যবস্থায় জনগণের অসহায়ত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে।
রাজনীতিতে নীতি-মূল্যবোধের গুরুত্ব না থাকলে যে কেউ নেতা হতে পারেন। ক্ষমতা দখল করলেই সরকার গঠন করতে পারেন। নেতা হতে পারেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক নীতি-আদর্শহীন হতে পারেন না।
দীর্ঘ দিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে সরকার একটা মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে গেছে অনেক আগেই এবং আমলাতান্ত্রিক নিষ্ক্রিয়তাও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিরাট বিরাট সাফল্যের মিথ্যা কাহিনী অসার প্রমাণিত হচ্ছে। সরকার নিজেই আর্থিক সঙ্কটে আছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য রাজনীতি বিরাজনীতি হওয়ায় রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে আন্দোলন হচ্ছে না তাই ক্ষমতাসীনরা বিপদ দেখেও দেখছেন না। তাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাই অবাধে চলবে। তবুও আমরা বলব, বর্তমান ব্যবস্থা কোনো টিকে থাকার ব্যবস্থা নয়। পরিবর্তন অনিবার্য, কিন্তু সে পরিবর্তন নৈরাজ্যিক এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে না পারে, সেটি নিয়েই দুশ্চিন্তার বিষয়। সব কিছু নির্ভর করছে সরকারের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের ওপর। সমঝোতার ভেতর দিয়ে পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। যদিও আমি সে ব্যাপারে আশাবাদী নই। শান্তিপূর্ণ প্রস্থানের জন্য দরকার হয় সাহস ও রাজনৈতিক উপলব্ধি। বিরাজনীতির সরকার তাই ব্ল্যাকহোলের ফাঁদে নিজেই বন্দী হয়ে পড়েছে। নিজেদের চেষ্টায় এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
ঐতিহাসিক নিয়মে যা ঘটার তা ঘটবে। কিন্তু এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের করণীয় কিছু থাকবে না তা হয় না। আমরা সবাই দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির অন্যায়-অবিচারের কাছে অসহায় থাকব, এটা মানতে পারছি না। স্বাধীন দেশে মান-মর্যাদা নিয়ে থাকার পরিস্থিতি নেই।
স্বাধীন দেশের গর্ব আমাদের অবশ্যই ফিরে পেতে হবে।
লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা