13 March 2021
বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির অভিমুখ সঠিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দুটি ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ‘স্বাতন্ত্র্য’ সঠিকভাবে নির্ণয়, উপলব্ধি এবং তা কার্যকরভাবে প্রকাশ করার সঠিক ভাষা ও রণধ্বনি আবিষ্কার।
অর্থাৎ কেন জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা স্বতন্ত্র সেই উপলব্ধি এবং তা প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা আমাদের থাকা চাই। একইভাবে অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের পার্থক্যও বোঝা দরকার। স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের বিকাশের জন্য স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা কেন জরুরি, সেটা এই উপলব্ধি থেকেই তৈরি হয়। অন্যদের কাছেও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সহজে বোঝার জন্য একে একটি জনগোষ্ঠীর আত্মসচেতন হয়ে ওঠাও বলতে পারি। এটি একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সমাজ নানানভাবে অংশগ্রহণ করে। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, ভূগোল, পরিবেশ, উৎপাদন– অর্থাৎ সমাজের সব ক্ষেত্রে এই স্বাতন্ত্র্য নির্ণয়ে ভূমিকা রাখে। একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদির এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত প্রধান ভূমিকা রাখে। কারণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ক্ষেত্র যেমন শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি, তেমনি তারা তাকে রূপ দেবার সৃষ্টিশীল কাজটিও করে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ইতিহাস ও মর্ম সঠিক উপলব্ধির নিরিখে নিজেরা নিজেদের ‘গঠন’ (Constitute) করতে পারা। তার জন্য দরকার জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে একটি ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়ন এবং সেই গঠনতন্ত্রকে রূপ দেবার জন্য যথোপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ, কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়া, বিধিবিধান প্রণয়ন এবং আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক বিকাশের জন্য উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক শর্ত তৈরি ইত্যাদি। বাংলাদেশ আবির্ভাবের প্রথম দিন থেকেই এই দুটি ধারণার সম্যক উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা চেতনায় মারাত্মক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। এই ঘাটতি নিয়েই আমরা আজ অবধি চলছি।
ফলে মোটা দাগে দুটি পরিণতি আমরা ভোগ করছি। একটি হলো নিজেদের মধ্যে মারাত্মক বিভাজন ও বিভক্তি। কারণ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে কোনো সামষ্টিক ধারণা আমাদের নেই। কখনো আমরা বাঙালি, কখনো মুসলমান; কখনো আমরা হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতিকে আমাদেরই সংস্কৃতি বলে মানি, আবার অন্য সময় হিন্দু বিদ্বেষ আমাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি হয়ে ওঠে। আমাদের চিন্তা যেমন বিশৃংখল, তেমনি কাজে কর্মেও আমাদের ঐক্যের অভাব মারাত্মক। অর্থাৎ কী চাই, কেন চাই, কীভাবে, তা অর্জন সম্ভব এইসব নিয়ে আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে পরস্পরের প্রতি দায় ও জবাবাদিহির কোনো ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
একটি ‘স্বতন্ত্র’ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের হাজির হওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশের আবির্ভাব ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য ছিল কি-না, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে বাংলাদেশ এখনো বাস্তবে বর্তমান রয়েছে। তাহলে বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রশ্ন মূলত নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন ও সজ্ঞান হওয়ার প্রশ্ন। বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর বিপরীতে বাংলাদেশের জনগণের ‘স্বাতন্ত্র্য’ কোথায়? কেন তাকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতির জন্য লড়তে হলো? কেন তা টিকিয়ে রাখতে হবে? ভারতের সঙ্গে তার যুক্ত হয়ে গেলে কী অসুবিধা? কিংবা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়তে হলো কেন? ইত্যাদি খুবই গুরুতর প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোকে আমরা খুব হাল্কা চালে গ্রহণ করি। এর উত্তর সন্ধান মানে কোন একটি তত্ত্ব খাড়া করা নয়। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য বোধ আদৌ আছে কি-না, নাকি আমাদের ‘বাঙালি’ হওয়া নিছকই মেকি, অন্তঃসারশূন্য দাবি, এই জিজ্ঞাসাকে খোলা মনে আমাদের বিচার করতে হবে।
বাংলাদেশের ‘স্বাতন্ত্র্য’কে আমরা কীভাবে বুঝি বা ব্যাখ্যা করি? আধুনিক জাতিবাদের যুগে একে আমরা ‘জাতি’ বলি। একাত্তরে আমরা দাবি করেছি আমরা ‘বাঙালি’ জাতি। সেটা করেছি ভাষা এবং সংস্কৃতির পাটাতনে দাঁড়িয়ে। আধুনিক জাতিবাদের খোপের মধ্যে পুরে দিয়ে আমরা ভেবেছি আমরা বুঝি নিজেদের চিনে ফেলেছি। সেটা ঠিক না। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের শক্তিশালী মতাদর্শিক ভিত্তি হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক ‘বাঙালি জাতিবাদ’, যে জাতিবাদী ধারণার মধ্যে ধর্ম, বিশেষ ভাবে ইসলাম অনুপস্থিত। যে কারণে ‘বাঙালি জাতিবাদ’ অনায়াসে ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি হয়ে উঠতে পেরেছে। বাঙালি জাতিসত্তার মর্ম আমরা নৃ-তাত্ত্বিকভাবে নির্ণয় করি নি। করেছি ভাষা ও সংস্কৃতির সূত্রে। করিনি কারণ ‘বাঙালি’ কোনো বিশুদ্ধ নৃ-গোষ্ঠী নয়। সে মিশ্র। তার রক্তের মধ্যে মুণ্ডা, সাঁওতালসহ নানান জনজাতির রক্ত এসে মিশেছে। মিশ্র শোণিত বাঙালির জন্য সৌভাগ্যের, কারণ বাঙালির লড়াই একইসঙ্গে হাজার হাজার বছর ধরে নিপীড়িত, বঞ্চিত বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তারও লড়াই। তাহলে ‘স্বাতন্ত্র্য’ কথাটার একটি মানে আমরা হাতের কাছেই পাচ্ছি। বাঙালি হওয়ার অর্থ শুধু নিজের সত্তা ধারণ করা নয়, একইসঙ্গে ক্ষুদ্র ও নিপীড়িত জাতিসত্তার আকাঙ্ক্ষাও ধারণ করা, তাদের অস্তিত্ব ও অধিকার স্বীকার করে নেয়া।
বাঙালির ইতিহাসের দ্বিতীয় দিক হচ্ছে বর্ণাশ্রম প্রথা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দলিত বা নিম্নবর্ণের মানুষের লড়াই। সেই লড়াইয়ে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের লড়াই একই সঙ্গে দলিত বা নিম্নবর্ণের লড়াই। উপমহাদেশে বর্ণাশ্রম প্রথার কারণে সমাজের নিচে পড়ে থাকা মানুষগুলোরও লড়াই। একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে ‘বাঙালি’ ধারণার এই তাৎপর্য নিহিত ছিল। বাঙালি হাওয়া থেকে জন্ম লাভ করেনি। এই তাৎপর্য স্পষ্ট করে তোলাই ছিল প্রধান রাজনৈতিক কাজ। কিন্তু তা আমরা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি।
না করতে পারার কারণ ছিল। আমরা তিনটি বিশাল নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা বদ্বীপে আমাদের ইতিহাস, ভূগোল, পরিবেশ, জীবন ব্যবস্থা এবং সাধারণ মানুষের ভাব ও ভাষাকে গুরুত্ব দেইনি। আমরা গুরুত্ব দিয়েছি পশ্চিম বাংলা উচ্চ বর্ণের ভদ্রলোক শ্রেণি ও বাবুদের। যারা ইংরেজ আমলে জমিদার ও মহাজন হয়ে শোষণ করেছে। তাদের সাহিত্য ও চিন্তায় তারা ‘বাঙালি’ বলতে যা বুঝেছে ‘বাঙালি’ বলতে আমরাও তাই বুঝেছি, বর্ণ হিন্দুর বাঙালিত্ব। তাদের তৈরি ‘বাঙালি’ ধারণার মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠার কারণে আমাদের প্রধান তিনটি ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্য গায়েব করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। দুটির কথা আগে বলেছি। তৃতীয়টি হচ্ছে ইসলাম। অর্থাৎ স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হবার যে তিনটি বৈশিষ্ট্য আমরা ধারণ করি উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ‘বাঙালি’ ধারণা সেই তিনটি বৈশিষ্ট্যকেই সম্পূর্ণ গায়েব করে দিতে চেয়েছে– ক. আদিবাসী, জনজাতি কিম্বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লড়াই ও অবদান, খ. দলিতদের সংগ্রাম ও অবদান এবং গ. ইসলাম, বিশেষত উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
স্বতন্ত্র্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেটা সর্বব্যাপী। তা ইসলাম, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং দলিতদের সংগ্রামের মধ্যে তারা সমান্তরালে হাজির। সেটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক নিগড় থেকে নারীর মুক্তি। একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক মুক্তি মানে একই সঙ্গে নারীর মুক্তিও বটে। আমাদের স্বাতন্ত্র্যের এই বিভিন্ন দিক নিয়ে আমাদের আরও প্রচুর কাজ করতে হবে। আমাদের সমস্যার সমাধান আসমান থেকে ফেরেশতা এসে করে দেবে না। এটি নিশ্চিত। এর মীমাংসা আমাদেরকেই করতে হবে।
দুই
দ্বিতীয় পরিণতি আরো ভয়ংকর। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভক্তি ও বিভাজন এতো প্রবল যে একটি অলিখিত ও ঘোষিত গৃহযুদ্ধ কার্যত জারি রাখা হয়েছে। এই বিভাজন বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে যেমন, তেমনি বাহ্যিকভাবেও চরম সংকটাপন্ন করে রেখেছে। গোড়ার অসুখ নিরাময় না করলে বাংলাদেশ আদৌ টিকে থাকবে কিনা সেই সন্দেহ উপস্থিত হয়েছে।
কথাগুলো নতুন না। আগেও আমি আমার নানান লেখায় এইসব বলেছি। এখন আবার বলছি এ কারণে যে বাংলাদেশ আরেকটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ গভীর খাদের মধ্যে পড়েছে। খাদের গহ্বর গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কারণ কোনো ব্যক্তিকে সরালেই ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় না। শুধু তাই না, যে দুটি গোড়ার সংকটের কথা বলেছি তার মীমাংসা না হলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা আসলে কারা সে ব্যাপারে আমাদের অস্পষ্টতা আরও বাড়বে। ‘এক দফা এক দাবি এরশাদ তুই কবে যাবি’ ছিল মূলত সেনাবাহিনীর একজন সেনা নায়ককে সরাবার রণধ্বনি, যাকে সেনাবাহিনী স্বয়ং আর সমর্থন দিতে রাজি ছিল না; কিন্তু এখন ‘এক দফা এক দাবি অমুক তুই কবে যাবি’ জাতীয় স্লোগান মূলত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে আস্থাভাজন শক্তিধর ব্যক্তিকে সরাবার রণধ্বনি। বাংলাদেশের বিদ্যমান গৃহযুদ্ধ এতে আরও প্রকাশ্য, গভীর এবং বিস্তৃত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশের জনগণকে যথেষ্ট প্রস্তুত করা গিয়েছে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমরা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বাস্তবতা মোকাবেলা করছি। এটি নব্বই দশক নয়। যদি আমরা ভুল করি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বুঝতে অভ্যস্ত। রাষ্ট্র ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা আসলে কী জিনিস, এটি তাদের বোঝানোর কোনো চেষ্টাই আমরা করিনি। তাহলে এক দফা এক দাবি এখন যারা কৌশলগত রণধ্বনি আকারে তুলছেন তারা রণনীতি নিয়ে আদৌ ভেবেছেন কিনা আমি সন্দেহ করি। রণনীতিগত চিন্তার পরিসরে প্রবেশ করতে হলে আমাদের অবশ্যই গোড়ার দুটি প্রশ্নের মীমাংসা করে আসতে হবে, কিম্বা কীভাবে মীমাংসা করব তার নীতিগত দিক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে ‘গঠন’ (Constitute) কথাটি আমরা ড. কামাল হোসেন ও পদ্মশ্রী আনিসুজ্জামানের কারণে বাংলাদেশ জন্ম হবার শুরু থেকেই গোলমাল পাকিয়ে বসে আছি। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর উপযুক্ত ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন মানে একজন উকিলের মুসাবিদা অনুযায়ী ‘কনস্টিটিউশান’ নামক আইনের বই লেখা না। এই ইংরেজি শব্দটিকে পদ্মশ্রী আনিসুজ্জামান আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন ‘সংবিধান’। অথচ ‘গঠন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ। যার ঘনিষ্ঠ বাংলা অনুবাদ ‘গঠনতন্ত্র’। ‘গঠনতন্ত্র’ আইনের বই না, একটি জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী তাদের স্বাতন্ত্র্যের উপলব্ধির ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক বা সম্বন্ধের ভিত্তি বা দলিল। সরলার্থে এর মানে দাঁড়ায় ‘রাষ্ট্র গঠন’। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী যদি আসলেই তাদের স্বাতন্ত্র্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝে তাহলে বিশ্ব ব্যবস্থার অন্তর্গত একটি ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে নিজেদের স্থান চাওয়ার অর্থ তারা বিশ্বাস করে বৈশ্বিকভাবে সকল মানব গোষ্ঠীকে তাদের ‘স্বতন্ত্র’ কিছু দেবার রয়েছে, যা অন্য কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
ইংরেজি ‘কনস্টিটিউশন’ শব্দটির ‘সংবিধান’ অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে কামাল হোসেন ও আনিসুজ্জামান যে ধারণা দিয়েছেন তা ঘোরতর ঔপনিবেশিক। ঔপনিবেশিক শক্তি মনে করে পদানত বা অধীন জনগোষ্ঠীকে ‘শাসন’ করবার জন্য একটি ‘সর্বোচ্চ আইন’ বা ‘সংবিধান’ দরকার। সংবিধান মানে এই ক্ষেত্রে পদানত জনগোষ্ঠীকে শাসন করার ঔপনিবেশিক হাতিয়ার।
বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন বটে; কিন্তু তাদের যারা শাসন করবে সেই শাসক শ্রেণি নিজেরা ঔপনিবেশিক মন মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাই তারা নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো শুধু ‘শাসক’-ই ভেবেছে। অতএব, তাদের দরকার হয়ে পড়েছিল যারা ‘শাসিত’ হবে তাদের শাসন করবার জন্য একটি সংবিধান।
কিন্তু একটি স্বাধীন জনগোষ্ঠীর ‘গঠনতন্ত্র’ রচনার ধারণা ঔপনিবেশিক ‘সংবিধান’ ধারণার বিপরীতে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা। প্রথমত ‘গঠনতন্ত্র’ স্বাধীন জনগণের ইছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে। এই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়, বলা বাহুল্য, জনগণের স্বাতন্ত্র্য বোধ বা উপলব্ধির, অর্থাৎ তাদের সংগ্রামের স্মৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। সেই স্মৃতি ও ঐতিহাসিক সংগ্রাম জনগণের মধ্যে কিছু আদর্শিক ঐক্যের বীজও বপন করে। তখন গুরুতর প্রশ্ন হয়ে ওঠে কীভাবে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে আমরা বুঝব এবং ব্যক্ত করব, যাতে সকলে সহজে বুঝতে পারে জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার কথাই আমরা বলছি। কীভাবে স্মৃতি ও ইতিহাসের সারসত্তা আমরা এমন ভাবে ছেঁকে আনতে পারি যাতে জনগণ বুঝতে পারে এটি তাদের অভিপ্রায়েরই সারার্থ ইত্যাদি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেদের ‘গঠন’ করবার প্রক্রিয়ায় যথাসম্ভব সবাইকে অংশগ্রহণ করানো এবং গঠনতন্ত্র (Constitution) নামক দলিলে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঠিক সন্নিবেশনা। ‘গঠনতন্ত্র’ কথাটার গভীর তাৎপর্য কামাল হোসেন ও আনিসুজ্জামানদের হাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ার গোড়াতেই নিহত হয়েছে। বাহাত্তরেই তার কবর রচনা করা হয়েছে, যার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে একটি মৃত কাঠামো। এই মৃত কাঠামোর থাম্বা ধরেই পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয়েছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
দেখা যাচ্ছে কনস্টিটিউশনকে ‘সংবিধান’ অনুবাদ করা নিছকই অনুবাদের মামলা নয়। এটি একটি লক্ষণ। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বলতে আমরা কী বুঝি এবং সেই বোঝাবুঝিতে ভুল থাকলে একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিণতি কি হতে পারে সেই বিষয়ে সমাজে সচেতনতার মারাত্মক অভাব। ‘কনস্টিটিউশন’ পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ বর্গ। পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্র হিসেবে আমরা আমাদের প্রাক্তন প্রভুদের নকল করছি মাত্র। সেই জন্যই কনসস্টিটিউশন অনুবাদের প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু সেটাও আমরা ঠিকভাবে রপ্ত করতে শিখিনি। নতুনভাবে ভাববার কিংবা গড়বারও কোনো হিম্মত আমাদের নেই। ‘কনস্টিটিউশন’-এর অনুবাদ ‘গঠনতন্ত্র’ না করে ‘সংবিধান’ করার পেছনে যে ঔপনিবেশিক চিন্তা, শাসক শ্রেণির অহংকার এবং শাসিতকে আইন দ্বারা পদানত রাখার ফ্যাসিস্ট ইচ্ছা ব্যক্ত, সেটা অতএব স্রেফ অনুবাদের মামলা নয়। আরও গভীর বিষয়। যা নিয়ে আমাদের সমাজে আলোচনা নেই বললেই চলে; কিন্তু শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হলে গভীরে যেতে হবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে একটি ‘গণরাষ্ট্র’ বা ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ কীভাবে গঠন করতে হয় সেটা আমরা এখনো জানি না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উৎপত্তির গোড়ায় এই অজ্ঞানতা ঘোরতর পাপ হয়ে রয়েছে, যেদিকে সঠিকভাবে নজর দিতে না পারলে আমরা এক কদমও সামনে এগিয়ে যেতে পারব না।
লেখক: কবি ও চিন্তক