স্টারলিংক ব্যবহারে সুবিধা ও অসুবিধা

logo

স্টারলিংক (Starlink) ইন্টারনেট হলো SpaceX-এর একটি স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা, যা দুর্গম এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই প্রযুক্তি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। এর সুবিধা, অসুবিধা নিয়েই আজকের আলোচনা।

পাহাড়ি অঞ্চল, চরাঞ্চল বা উপক‚লীয় এলাকায় যেখানে ফাইবার অপটিক বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছানো কঠিন, সেখানে স্টারলিংক ইন্টারনেট সহজে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলই এখন পর্যাপ্ত ইন্টারনেট কাভারেজের বাইরে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম- বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকায় ভ‚-প্রাকৃতিক কারণে মোবাইল টাওয়ার বসানো কঠিন। এ ছাড়া পদ্মা, মেঘনা বা যমুনার চরাঞ্চলে নদীভাঙনের কারণে স্থায়ী অবকাঠামো গড়া কঠিন।

উপক‚লীয় এলাকা : ভোলা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা ইত্যাদি অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কেবল নেটওয়ার্ক বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের এলাকায় স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট একটি গেম চেঞ্জার হতে পারে। মাটির নিচে কেবল বা টাওয়ারের প্রয়োজন হবে না, শুধু একটি ছোট ডিস ও বিদ্যুৎ থাকলেই চলে।

উচ্চগতির ইন্টারনেট : স্টারলিংক সাধারণত ৫০-২৫০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতি দিতে পারে, যা বাংলাদেশের অনেক রুরাল এলাকার তুলনায় অনেক ভালো। বাংলাদেশের গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেটের গতি এখনো অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত। সেখানে এখনো থ্রি-জি বা দুর্বল ফোর-জি নেটওয়ার্কেই চলতে হয়। অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্কই অনিয়মিত। এমন পরিস্থিতিতে স্টারলিংকের ৫০-২৫০ এমবিপিএস স্পিড অনেকটা ‘লাক্সারি’ না; বরং প্রয়োজনীয় সুবিধা হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে যারা অনলাইন ক্লাস করে, টেলিমেডিসিন বা রিমোট কাজের সাথে যুক্ত, স্থানীয় পর্যায়ে স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার বা আইওটি-ভিত্তিক সিস্টেম চালাতে চায়। তবে এই স্পিড টেকনিক্যালি সম্ভব হলেও রিয়েল লাইফে কেমন পারফর্ম করে সেটি দেখার বিষয়। কারণ বৃষ্টির সময় বা কিছু জ্যামিং কন্ডিশনে গতি কমে যেতে পারে।

ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্স : প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মোবাইল টাওয়ার বা অপটিক কেবল নষ্ট হয়ে গেলেও স্টারলিংক চালু থাকতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কিংবা ভ‚মিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এই সময়ে সবচেয়ে আগে নষ্ট হয়- মোবাইল টাওয়ার, ফাইবার অপটিক কেবল, বিদ্যুৎ সংযোগ। এতে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। স্টারলিংক এ জায়গায় খুব কার্যকর হতে পারে, কারণ, এটি লোকাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ওপর নির্ভরশীল নয়। দুর্যোগের সময় দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন, রেসকিউ অপারেশন, দূরবর্তী মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স- এসবের জন্য খুব উপকারী। বিশেষ করে সরকার বা এনজিও যদি দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর জন্য স্টারলিংক বেইজড মোবাইল কমিউনিকেশন ইউনিট তৈরি করে, তাহলে অনেক মানুষের জীবন বাঁচানো যেতে পারে।

ডিজিটাল বিভাজন কমানো : শহর ও গ্রামাঞ্চলের ইন্টারনেট ব্যবহারে যে বিভাজন রয়েছে, তা কমাতে সাহায্য করতে পারে। শহরের লোকেরা সহজে ফাইবার অপটিক, উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড, ওয়াইফাই জোন পাচ্ছে, অথচ গ্রামের মানুষ অনেক সময় টু-জি বা থ্রি-জি নিয়েই চলছে। শহরে অনলাইন ক্লাস, রিমোট জব, কিংবা টেলিমেডিসিন সম্ভব, কিন্তু গ্রামের শিশুরা জুমের নামও জানে না অনেক সময়। গ্রামের মানুষরা যদি উচ্চগতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পায়, তাহলে শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ সমান হবে। উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী, কৃষক- সবাই গ্লোবাল ইকোসিস্টেমে কানেক্ট হতে পারবে। এর ফলে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো অঞ্চল ডিজিটালি সক্ষম হয়ে উঠবে। তবে এখানে একটি বাস্তব প্রশ্ন থেকে যায়, সবার কাছে এটি কিভাবে পৌঁছাবে? এক্ষেত্রে সরকারের সাবসিডি, এনজিও প্রজেক্ট, বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল দরকার হতে পারে।

অনলাইন ক্লাস অ্যাক্সেস : দূরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা শহরের ভালো মানের স্কুল, অনলাইন কোর্সে সহজে অ্যাক্সেস পাবে। শিক্ষকের অভাব পূরণে অনলাইন টিউটর, ই-লার্নিং সিস্টেম চালু করা যাবে। একটি রাউটার ও স্ক্রিনেই পুরো গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরি করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য খাতে স্টারলিংকের ভ‚মিকা : দূরবর্তী এলাকার মানুষ শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে ভিডিও কনসাল্টেশন করতে পারবে। ছোট ক্লিনিক বা কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে রিমোটলি রোগ নির্ণয় সহজ হবে। ক্লাউড-ভিত্তিক প্যাশেন্ট ডাটা সংরক্ষণ ও শেয়ার করা যাবে।

খরচ : প্রাথমিক সেটআপ (ডিশ ও রাউটার) এবং মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি বাংলাদেশে অনেকের পক্ষে ব্যয়বহুল হতে পারে (প্রাথমিক খরচ টাকা ৫০০+ এবং মাসিক ১০০ এর মতো হতে পারে)। এটিই হচ্ছে স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ বা অনুরূপ উন্নয়নশীল দেশের জন্য। প্রাথমিক সেটআপ কিট (ডিস+রাউটার) আনুমানিক ৪৯৯ ইউএসডি- প্রায় ৫৫ হাজার টাকা+ (ডলারের হারে ভিন্নতা থাকতে পারে) এর সাথে আমদানি শুল্ক, কর ও শিপিং খরচ যুক্ত হলে ৭০-৮০ হাজার টাকাও লাগতে পারে। মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি আনুমানিক ৯ হাজার থেকে প্রায় ১১ হাজার টাকা প্রতি মাসে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমস্যাগুলো : ব্যক্তিগত ব্যবহারে এই খরচ বহনযোগ্য নয়, বিশেষ করে গ্রামীণ বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য। সরকারি বা এনজিও পর্যায়ে ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও এখনো লাইসেন্সিং বা অনুমোদন জটিলতা আছে। স্থানীয় আইএসপিদের চেয়ে এটি অনেক দামি এবং কম প্রতিযোগিতামূলক- অন্তত শহরের ক্ষেত্রে।

সম্ভাব্য সমাধান

কমিউনিটি-ভিত্তিক ব্যবহার : যেমন- একটি স্কুল, হেলথ ক্লিনিক বা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার এই সেবা নিলে অনেক মানুষ একসাথে উপকৃত হতে পারে। গ্রামীণ বা দূরবর্তী এলাকায় স্টারলিংক বসাতে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) বা এনজিও প্রজেক্টের মাধ্যমে সহায়তা নেয়া যেতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের আওতায় সরকার যদি কিছু সাবসিডি দেয়, তাহলে এটি অনেক সহজলভ্য হবে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালু করতে হলে ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবস্থাপনা, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্ভার লোকালাইজেশন সংক্রান্ত কিছু কঠোর নিয়ম মানতে হয়। সরকার চাইলে কনটেন্ট ও ট্রাফিক মনিটর করতে পারে কিন্তু স্টারলিংক যেহেতু সরাসরি স্যাটেলাইটের সাথে কানেক্টেড, সেখানে এই নিয়ন্ত্রণ সীমিত।

জাতীয় নিরাপত্তা : সরকার চায় সব ধরনের ইন্টারনেট ট্রাফিক দেশের ভিতরে নিয়ন্ত্রিত গেটওয়ে দিয়ে যাক, যা স্টারলিংয়ের সাথে খাপ খায় না। লোকাল ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা এই সেবা এলে নিজেদের ব্যবসার ক্ষতির আশঙ্কা করে- তাই একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ তৈরি হয়। স্টারলিংক সরাসরি সেবা দিলে সরকার অনেক ট্যাক্স বা ফি মিস করতে পারে, কারণ এর নিয়ন্ত্রণ কঠিন।

সম্ভাব্য সমাধান

সরকার নিজেই স্টারলিংয়ের সাথে যৌথভাবে কিছু পাইলট প্রজেক্ট শুরু করতে পারে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে। যেমন দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ প্রয়োজনে সীমিত অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।

স্টারলিংকের ওপর আবহাওয়ার প্রভাব

ভারী বৃষ্টিপাত হলে স্টারলিংকের সিগন্যাল দুর্বল হয়ে যেতে, কখনও বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থাকে বলে ‘জধরহ ঋধফব’। কখনো পুরোপুরি বজ্রপাত বা বৈদ্যুতিক ঝড়ের সময়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিস্টার্বেন্স ঘটে, যা স্যাটেলাইট সিগন্যালের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অত্যন্ত ঘন মেঘ বা আর্দ্রতা থাকলে সিগন্যালের কার্যকারিতা কিছুটা কমতে পারে।

আমাদের দেশে বর্ষাকালে প্রায় তিন-চার মাস প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। উপক‚লীয় ও পাহাড়ি এলাকায় বজ্রপাত অনেক বেশি হয়। এ কারণে স্টারলিংকের মতো কধ-নধহফ ফ্রিকোয়েন্সি-ভিত্তিক স্যাটেলাইট সিস্টেমে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে, যদিও এটি সাময়িক এবং পূর্ণ বিভ্রাট নয়।

সম্ভাব্য সমাধান বা প্রস্তুতি

স্টারলিংক নিজেই সিগন্যাল হারালে আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযোগ করতে পারে।

স্টারলিংক এখন ‘ঐরময চবৎভড়ৎসধহপব উরংয’ অফার করে, যা খারাপ আবহাওয়ায় তুলনামূলক ভালো কাজ করে। জরুরি কাজে স্টারলিংক ব্যবহারের পাশাপাশি লোকাল মোবাইল বা ব্রডব্যান্ড ব্যাকআপ হিসেবে রাখা ভালো।

সুরক্ষা ও নজরদারি

স্টারলিংক বা অন্য স্যাটেলাইট সেবা সরাসরি বিদেশী প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয় (এ ক্ষেত্রে স্পেস-এক্স)। এই সেবা ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীর ডাটা (যেমন- লোকেশন, ব্রাউজিং হিস্ট্রি ইত্যাদি) বিদেশে সঞ্চিত হতে পারে, যা প্রাইভেসি নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে। স্থানীয় সরকার বা সংস্থাগুলো স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার ওপর সরাসরি নজরদারি রাখতে পারবে না, তাই এটি অবৈধ কনটেন্ট, ডার্ক ওয়েব অ্যাক্সেস, বা অপপ্রচার ছড়াতে ব্যবহার হতে পারে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের মাধ্যমে সন্ত্রাসী সংগঠন বা অন্য বিরোধী শক্তি দূরবর্তী অঞ্চলে যোগাযোগ করতে পারে, যা সুরক্ষার জন্য হুমকি হতে পারে। স্যাটেলাইট সেবা চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাব নিরাপত্তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশে নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ

স্টারলিংক বাংলাদেশের ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের অংশ না হওয়ায় এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হতে পারে। বর্তমান বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বিধির সাথে স্যাটেলাইট সেবার কোনো স্পষ্ট সামঞ্জস্য নেই। দেশীয় আইএসপি বা সরকারের জন্য স্যাটেলাইট সেবা ব্যবহারকারী ট্রাফিক ট্র্যাক করা বা বøক করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

সম্ভাব্য সমাধান

স্টারলিংক বা অন্যান্য স্যাটেলাইট সেবা কোম্পানি যদি স্থানীয় সরকার বা সুরক্ষা সংস্থার সাথে কাজ করে, তবে নিরাপত্তা ও নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। যেমন, জরুরি পরিস্থিতিতে ডাটা শেয়ারিং বা মনিটরিং অনুমতি দেয়া। বাংলাদেশ সরকার যদি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রোভাইডারদের সাথে লোকাল ইন্টারনেট গেটওয়ে চালু করতে পারে, তবে দেশীয় কর্তৃপক্ষ ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ এবং মনিটরিং করতে পারবে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রেরিত ডাটা এনক্রিপ্ট করা হলে তা নিরাপদ থাকবে এবং ডাটা প্রাইভেসি নিশ্চিত করা সম্ভব।

আইনি কাঠামো তৈরি : সরকার বা আইনপ্রণেতারা স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার জন্য বিশেষ আইন তৈরি করতে পারে, যাতে এটি নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসি আইন মেনে চলে। আইনি কাঠামো তৈরি করা বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।

লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here