সোয়া তিনশ বছরের পুরনো বাড়িতে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে

The Business Standard Bangla    20 August 2022
১৭৬৫ সালে মুর্শিদাবাদে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আবার শুরু হলে সৈয়দ আহমেদ আলী মীর্জা  ও তাঁর ভাই সৈয়দ আহমেদ রেজা ঢাকার ইমামগঞ্জের গ্রীষ্মকালীন বা রঙমহল প্রাসাদে  চলে আসেন। এটি তৈরি করেছিলেন   ঢাকার নায়েবে নাজিম জেসারাত খান তাঁর স্ত্রীর জন্য।  জেসারত খাঁ  দুই মেয়াদে (১৭৫৬-১৭৬২ এবং ১৭৬৫-১৭৭৮ ) ঢাকার নায়েবে নাজিম ছিলেন।

যে বছর সম্রাট আওরঙ্গজেব মারা গেলেন মানে ১৭০৭ সালে সেই বছরই বাড়িটা তৈরি হয়েছিল। সৈয়দ আহমদ আলী পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ডায়রি থেকে সময়টা জানতে পেরেছেন। সৈয়দ আলী মোহাম্মদকে ডাকা হতো ছোট্টান নবাব, তিনি ছিলেন আহমদ আলীর দাদা। ছোট্টান নবাব জন্মেছিলেন ঢাকার ইমামগঞ্জের  রঙমহল প্রাসাদে। তাহলে জানমিয়া গলির এই বাড়িটার নাম কিভাবে হলো ছোট্টান হাউজ?

উত্তর খুঁজতে ঢাকা গবেষক হাশেম সূফীর সঙ্গে গেলাম আবুল হাসনাত রোডের জানমিয়া গলিতে। বাড়িটার বাইরের দেয়ালগাত্রে একটা নেমপ্লেট দেখলাম। এতে সৈয়দ তাকী মোহাম্মদ বুডডানের নাম লেখা যিনি মোহাম্মদী বেগম ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি । সুফী ভাই জানালেন, বুড্ডান সাহেব একজন শায়েরও, ছোট্টান নবাবের পুত্র আর আহমদ আলীর বাবা। বাড়িটার উচু পাচিল কৌতূহল জাগাচ্ছিল। তবে ভিতরটা আরো অন্যরকম, বাইরে থেকে বোঝার সুযোগ ছিল না।

ভিতরে একটা  ছোট উঠান, উঠান ঘিরে একতলা দরদালান, উঠানের মাঝখানে বয়সী এক আমগাছ, গাছটির উত্তরে বৈঠকখানা যার একটা অংশ ব্যবহৃত হয় ইমামবাড়ি হিসাবে। তখন বিকালও শেষ হতে চলেছে। লম্বা করে আমগাছটা ছায়া ফেলেছে বৈঠকখানা ঘরের ওপর। আলীর জন্ম এই বাড়িতেই ১৯৮৩ সালে।

বুড্ডান সাহেব মেজাজি লোক। বয়স তাঁর সত্তরের বেশি হবে। স্মৃতি ছাড়া এখন আর বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই অবশ্য। তবে তাহজিব তমুদ্দুন অটুট আছে পুরোদস্তুর। তাইতো দেখা হতেই বুড্ডান সাহেব খুব আদর করে ভিতরে নিয়ে গেলেন, বসার জায়গাও  দেখিয়ে দিলেন। তবে তিনি বেশিক্ষণ আমাদের সময় দিতে পারলেন না, ওদিকে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে, মাগরিবের আজান পড়ল বলে। তাই নবাবদের নতুন প্রজন্মের তরুণ সদস্য  আলীকেই খুলতে হল ইতিহাসের পাতা।

রংমহল বিক্রি হয়ে গিয়েছিল

ছোট্টান নবাবের পৈতৃক নিবাস ছিল ইমামগঞ্জের রংমহল প্রাসাদ। ১৯১৮ সালে সেখানেই তাঁর জন্ম। প্রাসাদটির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন।  ১৯৪২ সালে ছোট্টান নবাব ও তাঁর অন্য শরীকরা প্রাসাদটি তেল ব্যবসায়ী দুল্লিচান ওমরাওওয়ালার কাছে বিক্রি করে দেন।  তারপর চলে স্থায়ীভাবে চলে আসেন নানাবাড়িতে। ৪৮ নং আবুল হাসনাত রোডের সৈয়দ জান মিয়া গল্লির বাড়িটাই ছোট্টান নবাবের নানাবাড়ি।

শিশুকালেই পিতৃহারা হন ছোট্টান নবাব। বৃটিশ সরকার তাই শিশু নবাবের একজন লিগাল গার্ডিয়ান বা অভিভাবক নিয়োগ করে। নানা সৈয়দ আমজাদ আলী আল হোসায়নী ওরফে সৈয়দ জান চৌধুরী নিযুক্ত হন ছোট্টান নবাবের গার্ডিয়ান। নানার নামেই এই জান মিয়া গল্লিটি। রংমহল বিক্রি হয়ে গেলে নবাব পাকাপাকিভাবে চলে আসেন নানাবাড়িতে। যে বাড়ির প্রাচীর এখনো দুই পুরুষ সমান উচু।  নবাব পুত্র বুড্ডানের জন্ম ১৯৫০ সালে।

 যে প্রশ্ন নিয়ে আমরা এসেছিলাম সেটির উত্তর জানা হয়ে গেল আমাদের। তবে নতুন যে প্রশ্ন উঁকি দিল তা হলো, রঙমহলটি কিভাবে হলো ছোট্টান নবাবের? আলীর কাছে এ প্রশ্নেরও উত্তর আছে।

ছোট্টান নবাব যেভাবে রঙমহল পেয়েছিলেন 

নবাব, নায়েব বা নায়েবে নাজিম ইত্যাদি টাইটেলের প্রচলন হয় মুঘল জামানায় ১৭১৭ সালে।  নবাব বা নাজিমদের সঙ্গে যারা আত্মীয়তা করতেন তারাও মর্যাদাবান হতেন কারণ নবাবের অধীনে পরগণা ভিত্তিক জমিদারির উত্তরাধিকারী ছিলেন তারাও। মুর্শিদাবাদে বাংলার মসনদে আসীন ছিল এমন তিনটি বংশেরই (মুর্শিদ কুলি খানের নাসিরি, সিরাজউদ্দৌলার আফসারি এবং মীর কাশিম আলী খানের নাজাফি) উত্তরাধিকারী ছোট্টান নবাব বংশপরম্পরায় অথবা আত্মীয়তাসূত্রে।

ছোট্টান নবাবের পিতার নাম সৈয়দ আলী আহমাদ ওরফে গুন্ডে নবাব আর দাদার নাম সৈয়দ মোহাম্মাদ আলী ওরফে মোহামদু মীর্জা।  ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত মোহামদু মীর্জা ঢাকার হোসাইনি দালান ইমামবারার সুপারিন্ডেন্ট ছিলেন।  মোহামদু মীর্জার পিতার নাম ছিল নবাব সৈয়দ মোহাম্মাদ আলী ওরফে মামদু মীর্জা।

আর মামদু মীর্জার পিতা ছিলেন সৈয়দ আহমেদ আলী মীর্জা।  আর এই শেষোক্তজনের দাদী ছিলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সরফারাজ খানের কন্যা। ১৭৪০ সালে সরফরাজ খানকে পরাজিত করে মুর্শিদাবাদের মসনদে আসীন হয়েছিলেন আলী বর্দি খাঁ।  সিরাজউদ্দৌলা নবাব হয়েছিলেন আলী বর্দির পরেই।  তারপর নবাব হন মীর জাফর আলী খান।

১৭৬৫ সালে মুর্শিদাবাদে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আবার শুরু হলে সৈয়দ আহমেদ আলী মীর্জা  ও তাঁর ভাই সৈয়দ আহমেদ রেজা ঢাকার ইমামগঞ্জের গ্রীষ্মকালীন বা রঙমহল প্রাসাদে  চলে আসেন। এটি তৈরি করেছিলেন   ঢাকার নায়েবে নাজিম জেসারাত খান তাঁর স্ত্রীর জন্য।  জেসারত খাঁ  দুই মেয়াদে (১৭৫৬-১৭৬২ এবং ১৭৬৫-১৭৭৮ ) ঢাকার নায়েবে নাজিম ছিলেন।

সৈয়দ আহমেদ আলী মীর্জা জেসারাত খানের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন।  তাই মামদু মীর্জা ছিলেন জেসারাত খানের নাতি।  সে পরম্পরায় মামদুর পুত্র মোহামদু মীর্জা মানে ছোট্টান সাহেবের দাদা রঙমহলের উত্তরাধিকারী হন আর দাদাসূত্রে পিতা হয়ে আসে নাতির কাছে।

উল্লেখ্য  ছোট্টান নবাবের  ডায়রি থেকে জানা যায়,  ঢাকার নবাব হাবিবউল্লা ছিলেন তাঁর খেলার সাথী। তারা একসঙ্গে পাখি শিকার এবং ঘুড়ি উড়ানোসহ অনেক খেলাধুলা করেছেন।  ছোট্টান নবাব বিয়ে করেছিলেন ড. মীর্জা মোহম্মদ হোসায়নের একমাত্র কন্যা জাফরী বেগমকে।  জাফরী বেগমের দাদার নাম ছিল মীর্জা আলী হাসান ওরফে মিরীদা।

ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে মির্জা আলী নাকি দেঊরী রোডে তাদের বড় জমিদার বাড়ি ছিলো।  মীর্জা আলী হাসানের পিতা মীর্জা লতিফ হোসাইন ওরফে চামারু মীর্জা ছিলেন বৃহত্তর ভোলার লাখেরাজ (নিষ্কর) জমিদার।  মীর্জা লতিফের দুই ছেলে মীর্জা দেলাওয়ার হোসায়ন এবং মীর্জা নেছার হোসায়ন ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে নিহত হন।  তাদের ভিক্টোরিয়া পার্কে মানে  বাহাদুর শাহ পার্কে  ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল।

এ পর্যায়ে এসে ছোট্টান নবাবের নাতি সৈয়দ আহমদ আলী সিপাহী বিদ্রোহকালের আরো কিছু কথা বলতে উৎসাহী হলেন কারণ তাঁদের নবাবী হারানোর সঙ্গে ওই সময়ের যোগ আছে।

বৃটিশরা ছিনিয়ে নিয়েছিল 

মামদু মীর্জা ঢাকার অন্য জমিদারদের সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহে সমর্থন দেন, সে কারণে তিনি বৃটিশদের কোপানলে পড়েন। ব্রিটিশরা তাঁর নবাব টাইটেল ছিনিয়ে নেয়,  তাদের সম্পত্তি পত্তনী দেয়ার রুল জারি করে। ফলাফলে ১৮৬১ সালে পুর্ববাংলার অনেক নবাববংশীয় জমিদারের মতো মামদু মীর্জার পরিবারও জমিদারি হারান অথবা পত্তন দিতে বাধ্য হন।

মোহামদু মীর্জা যেমন ময়মনসিংহ এবং ভাওয়ালের কিছু অংশ এবং আরো অনেক এলাকার জমিদারি রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের পিতা রাজা কালী নারায়ণ রায় চৌধুরী মানে ভাওয়াল রাজার কাছে মাত্র ৪২০০ টাকা বাৎসরিক খাজনায় পত্তনী দিতে বাধ্য হন।

নবাবীর কফিনে শেষ পেরেকটি গাঁথা হয় ১৮৮০ সালে। কারণ এর আগ পর্যন্ত  মুর্শিদাবাদে ‘বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব’  টাইটেলটি বহাল ছিল। হুমায়ুন জার পুত্র ফেরাদুন জা ছিলেন শেষ নবাব যদিও তার কোনো ক্ষমতা ছিল না কিন্তু কাগজপত্রে তিনি নবাব ছিলেন। ১৮৮০ সালে টাইটেল বিলুপ্ত করা হলে সব নবাব খেতাব হারান। পরে ব্রিটিশরা নবাবদের জন্য চালু করে অবসরকারীন ভাতা। ছোট্টান নবাবের পিতা নিজামতও ফান্ড থেকে এ ভাতা পেয়েছেন আর নবাব নিজেও পেয়েছেন দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত।

শেষে বাড়িটার কিছু কথা  

ছোট্টান নবাবের নানা সৈয়দ জান চৌধুরীর জন্ম ১৮৬২ সালে।   পিতা সৈয়দ জিয়াউদ্দিন আল হোসায়নী চৌধুরীর কাছ থেকে তিনি বৃহত্তর বাকেরগঞ্জের  সুলতানাবাদ ও শায়েস্তাগঞ্জ এবং বুজুর্গ উমেদপুর পরগনার জমিদারী প্রাপ্ত হন।  জান মিয়ার দাদা  সৈয়দ আব্দুল্লাহ চৌধুরী  ঢাকার শেষ নায়েব নাজিম গাজিউদ্দিন হায়দারের দরবারে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন।

জান মিয়ার এক পুর্বপুরষ ঢাকায় রেভিনিউ অফিসার হিসেবে বাংলার সুবাহদার মোগল প্রিন্স আজিমুশশানের (সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাতি) আমলে ঢাকায় আসেন।  তখন এই বাড়িটি তাঁর সরকারি বাসভবন হিসেবে বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছিল। বাড়িটি ছিল চুন চুড়কির।  পরে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাওয়ায় কাঠের কড়ি বর্গা দিয়ে পুনঃনির্মিত হয়।

এখন যে অংশটা বাকি রয়ে গেছে তা মূলত জমিদার বাড়ির কাছারি ঘর। উল্লেখ্য সৈয়দ আব্দুল্লাহ চৌধুরী গাজিউদ্দিন হায়দারের কাছ থেকে রমনা পার্কের কিছু অংশ কিনে নিয়েছিলেন এবং সেখানে একটি মসজিদও নির্মাণ করিয়েছিলেন।  ১৮৬১ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

সৈয়দ আব্দুল্লাহ চৌধুরীও সিপাহী বিদ্রোহে সমর্থন দিয়েছিলেন আর তার জরিমানা হিসাবে তার জমিদারী ঢাকার নবাব আব্দুল গনিকে পত্তনী দিতে বাধ্য হন।  পরে ১৯১১ সালে সৈয়দ জান মিয়ার মাতা মোহাম্মদী বেগম তাদের বাকী থাকা সম্পত্তির কিছু অংশ ওয়াকফ করেন।  আর জান মিয়া হন তার মোতাওয়াল্লী (অভিভাবক বা পরিচালক)।  মৃত্যুর দুই বছর আগে ১৯৪২ সালে জান মিয়া তার একমাত্র নাতি সৈয়দ আলী মোহাম্মদ ছোট্টানকে তার সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করে যান।

বর্তমান মোতাওয়াল্লী বুড্ডান সাহেব ছোট্টান নবাবের বড় ছেলে।  ছোট্টান নবাবের বড় মেয়ে ড. কানিজ ই বাতুল খিজরান বেগম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক।   রাজা সাহেব মাহমুদাবাদ, প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা, মির্জা ইস্পাহানি , নবাব হাবীবুল্লাহ সহ অনেকে বিখ্যাত ব্যক্তি এই বাড়ির অতিথি হয়েছে।

নবাব ছোট্টান  নিউ গভঃ স্কুল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা বোর্ডের আজীবন সদস্য ছিলেন।

এবার উঠতে হয়

কথায়  কথায় রাত হয়ে এলো।  বয়স্ক আমগাছটা চাদের আলো গায়ে মেখে ঠায় দাড়িয়ে। বাড়িটার উচু দেয়ালে আধো আলো আধো ছায়া। তিনশ বছরের বুঝি স্মৃতিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এধারে ওধারে।  বাড়িটা পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষী। সাক্ষী দেশভাগেরও।

এ বাড়িতে ১৮৩৫ সালে বাংলায়  লেখা  জমির দলিল আছে।  বাড়িটা আসলে ইতিহাসের এক মহাফেজখানা। আমরা কতক জানলাম, আরো অনেকটাই আসলে বাকি থেকে গেল।