- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৫ নভেম্বর ২০২০
‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা/ সোনা নয় তত খাঁটি/ বলো, যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি/ বাংলাদেশের মাটি রে/ আমার বাংলাদেশের মাটি/ আমার জন্মভূমির মাটি’। এ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গান। গীতিকার কেবলই সোনা দেখেছেন। আসলেও তো তাই। বাংলার মাটিতে সোনা ফলে। ‘মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’। ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এ বসুন্ধরা’। আমরা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছি। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সোনার বাংলা’ গড়ার জন্য সোনার মানুষ চেয়েছেন; কিন্তু পেয়েছেন চোরের খনি। তার ভাষায়- ‘চাটার দল চেটেপুটে সব শেষ করে দেয়’। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চান সোনার মানুষ। আর তার লোকেরা চায় সোনার হরিণ। সোনার মানুষ আর সোনার হরিণের রশি টানাটানিতে উলুখাগড়া, সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর মধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে ৫০ বছর। পদ্মা মেঘনা যমুনা ও কর্ণফুলীতে ইতোমধ্যে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। সোনার বাংলার বিপরীতে এরা ক্ষমতায় থেকেছেন। সোনার বাংলার পক্ষের লোকেরা বলেছেন, সোনার বাংলা ছারখার হয়েছে। তারা আশার আলো দেখিয়েছেন, ‘আবার জমবে মেলা, হাটতলা বটতলা’। কিন্তু ‘ফুটো কলসি যেমন ছিল তেমনি যে রয়ে যায়’। নতুন লোকেরা নতুন উদ্যমে সোনার হরিণের পিছু নেয়। ‘সে যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা/ সে যে নাগাল পেয়ে পালায় ঠেলে, লাগায় চক্ষে ধাঁধা।’ তারা ‘সোনার বাংলা’ নামক সোনার হাঁসটির প্রতিদিন একটি ডিমে সন্তুষ্ট নন, তারা হাঁসটিকে জবাই করে একদিনেই সব ডিম পেতে চান। তারা সোনার বাংলাকে জবাই করছেন প্রতিদিন।
এ রকম একটি সোনালোভী মানুষের গল্প পড়েছিলাম পাঠ্যবইয়ে। গল্পটির নাম ‘গোল্ডেন টাচ’। এখনকার সোনালোভী মনিরের মতো একজন লোক। সে সোনার স্বপ্ন দেখত। সোনার জন্য আরাধনা করত। তার ঘরে সোনার সিন্দুক গড়তে চাইত। সব সাধনার পর বিধাতার তরফ থেকে সে বর বা আশীর্বাদ পেল। বিধাতা বললেন, ‘তুমি যা স্পর্শ করবে তাই সোনা হয়ে যাবে। বিধাতার আশীর্বাদ পেয়ে সে আনন্দে উতলা হয়ে উঠল। দৌড়ে গিয়ে একটি গ্লাস হাতে নিলো। কী আশ্চর্য! তার হাতের গ্লাসটি সোনা হয়ে গেল। সে আনন্দে উন্মাদ হলো। চিৎকার করে স্ত্রীকে ডাকল। তাকে জড়িয়ে ধরল। স্ত্রী মুহূর্তেই সোনা হয়ে গেল। ছোট্ট মেয়েটি মাকে জড়িয়ে ধরল। সোনার মূর্তিতে পরিণত হলো তার পরিবার। এত সোনা তার আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপে পরিণত হয়েছে- প্রথমবারের মতো সে বুঝল তা। যে সোনা তার জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারত তা অপরিমিতির কারণে তার কাছে অসহনীয় মনে হলো। মনিরের মতো মানুষ, যাদের কাছে সোনা আছে, এখনো অগ্রহণযোগ্য বা অভিশাপ হয়ে যায়নি। মনিরদের চাহিদার অন্ত নেই। লোভের শেষ নেই। হতবাক হতে হয় তাদের গল্প শুনে। মনে হয় ‘আলিফ-লায়লা’র গল্প শুনছি।
নব্বইয়ের দশকে গাউছিয়া মার্কেটের কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী ছিলেন মনির হোসেন। এরপর মৌচাক মার্কেটের ক্রোকারিজের দোকানে চাকরি নেন। সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে যুক্ত হন বিমানবন্দরকেন্দ্রিক লাগেজ পার্টির সাথে। শুরু করেন স্বর্ণের চোরাচালান। পরে পরিচিতি পান ‘গোল্ডেন মনির’ নামে। স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পর কব্জায় নেন রাজউক। কারসাজির মাধ্যমে মালিক হন একের পর এক প্লটের। সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক, তার প্লটের সংখ্যা ২০২টি। র্যাবের ভাষ্য, মনির হোসেন অবৈধ উপায়ে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে মনিরের সখ্য ছিল ‘অন্যরকম’। তিনি যে দামি গাড়িতে চড়তেন, সেটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক এমপির। তার বাসায় আরেকটি গাড়ি পাওয়া যায়, সেটি জাতীয় পার্টির সাবেক একজন এমপির। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে আরো তিনটি গাড়ি জিম্মায় নিয়েছে র্যাব। প্রতিটির মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় ডিআইটি প্রজেক্টের ১১ নম্বর সড়কে মনির হোসেনের ছয়তলা বাড়ি। সেই বাসা থেকে গুলিসহ একটি বিদেশী পিস্তল, চার লিটার বিদেশী মদ, ৩২টি নকল সিল, আট লাখ টাকার বেশি বিদেশী মুদ্রা, ৬০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার এবং এক কোটি ৯ লাখ নগদ টাকা জব্দ করা হয়। বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্ট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনি। ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো: জাহাঙ্গীর আলম। জানা যায়, উত্থানপর্বে সে সময়ের সন্ত্রাসী মুরগি মিলনের সাথে মনিরের কাজ কারবার গড়ে উঠে। অতীতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সে সম্পর্ক গড়ে তোলে। বর্তমানেও তাই করেছে। বিআরটিএতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেরুন রঙের গাড়িটি শেরপুর-০১ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি আতিউর রহমানের নামে নিবন্ধন করা। আর কালো রঙের গাড়িটি জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আক্কাস আলী সরকারের নামে নিবন্ধন করা। আক্কাস আলী কুড়িগ্রাম-০১ আসনে ২০১৮ সালের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন। প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, জাল নথিতে অন্যের জমি ও প্লট দখল নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউকের কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন’ মনির। র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ভূমি জালিয়াতি করেই অসংখ্য প্লট নামে-বেনামে নিজের করে নেন। ওই সময় প্রভাবশালী মন্ত্রীদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বর্তমানেও তিনি সরকারের প্রভাবশালীদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, একজন প্রতিমন্ত্রীর সাথে সম্পর্কের জেরেই রাজউকে আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন গোল্ডেন মনির। বিভিন্ন জায়গায় মনির নিজেকে প্রতিমন্ত্রীর লোক বলে পরিচয় দিতেন। সে কারণে রাজউকের ভুয়া নথি পেলেও এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ওই প্রতিমন্ত্রীকে দেড় কোটি টাকা মূল্যের একটি সাদা প্রাডো গাড়ি মনির উপহার দিয়েছেন- এমন আলোচনাও রয়েছে।
গোটা বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গোল্ডেন মনির একজন নয় এবং এককালেরও নয়। এ ধরনের ঘটনায় অতীত ও বর্তমানের শাসকদলের সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণিত। বাংলাদেশে রাজনীতি যে রাজনীতিকদের হাতে নেই, এমন কথা বলেছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ। যে রাজনীতির লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ তা আজ আত্মকল্যাণে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি হয়ে উঠেছে অর্থবিত্ত হাতিয়ে নেয়ার বাহন মাত্র। বিগত সংসদ নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের গরিষ্ঠ অংশ ব্যবসায়ী। তারা ছোটখাটো ব্যবসায়ী নন। সে ব্যবসা কোটিপতির এবং মনির ধরনের অন্যায় উপায়ে অর্জিত। অনেকেই তাই উপহাস করে বলেন, পার্লামেন্ট হচ্ছে কোটিপতিদের ক্লাব। কার্ল মার্কস এ ধরনের সংসদকে বলেছিলেন, ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’। আমরা অতটা না বললেও এ কথা স্পষ্ট, সেখানে সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের আর জায়গা নেই। রাজনীতির যে ‘দুর্বৃত্তায়ন’ ঘটেছে বলে সমাজচিন্তকরা বলে আসছেন তা সাম্প্রতিককালের গোল্ডেন মনিরদের উত্থানে স্পষ্ট। এটা লক্ষণীয়, মনিরের উত্থানের সাথে ক্ষমতাসীন সব দলের সংযোগ রয়েছে। তাহলে এ কথা বলা কি অসত্য হবে যে, রাজনীতি মাত্রই কলুষিত হয়ে পড়েছে। গোল্ডেন মনিরের ঘটনায় একজন প্রতিমন্ত্রী ও দু’জন সংসদ সদস্যের সংশ্লিষ্টতা লক্ষ করা যায়। সমাজতাত্ত্বিকরা এ ধরনের ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করে বলতে চাইবেন, এই সমাজের পচন ধরেছে। ব্যক্তি যদি নষ্ট হয় ব্যক্তিকে পরিবর্তন করা হয়তো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সমাজ নষ্টের মুখোমুখি হলে তখন সমাজকে পরিবর্তন করা অতটা সহজসাধ্য হয় না। কিন্তু এ কথাও সত্য, সমাজ পরিবর্তন ছাড়া সামগ্রিক পরিবর্তন অসম্ভব। তাই সব মতে ও সব পথে স্লোগান উঠেছে- ‘এ সমাজ ভাঙতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে’। সেই প্রত্যাশিত সমাজ হবে নীতিনৈতিকতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজ। অনেকেই বলতে চাইবেন, এটি ইউটোপিয়া বা কল্পনাবিলাসী ভাবনা। কিন্তু বাংলাদেশে সমাজের অগণিত মানুষের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করে সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিক ও পারিপার্শ্বিক সে পরিবর্তন অসম্ভব নয়। আর নেপোলিয়নের মতো করে বলা যায়, ‘Impossible is a word which can be found in the dictionary of a fool.’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]