
আমি উনাকে শান্ত করে বললাম, মামা, কয়েকটি প্রশ্ন করি কিছু মনে করবেন না:
এক. সত্যিই কি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গঠনই মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল ? হয়ত এটি আপনার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছিল এবং হয়ত আপনার মত অনেক মুক্তিযোদ্ধার চেতনা তাই ছিল, বিশেষ করে যারা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল তারা এই দাবী করেতেই পারে। কিন্তু এটি কি বাংলাদেশের সকল মানুষের দাবি ছিল অথবা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ছিল? কিসের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মানুষ?
দুই. যুদ্ধ শুরুর আগে বা যুদ্ধের সময় কখনও কি সেক্যুলার সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন দাবী তোলা হয়েছিল? আপনি যে কথাটি আজ বললেন, তা কি তৎকালীন কোন নেতৃবৃন্দের বক্তব্য বা বিবৃতিতে উল্লেখ আছে?
তিন. উনিশশ একাত্তর সালের এপ্রিল মাসে, তাজউদ্দীন আহমদ তার বেতার ভাষণ যখন “আল্লাহু আকবর” বলে শুরু করেন এবং কোরানের আয়াত দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন তখন কি আপনি বলেছিলেন, আল্লাহু আকবর আর কোরানের আয়াত যদি থাকবে তাহলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেন?
চার. আমরা তো রোজা এবং পূজা দুটোর খবরই প্রচার করছি। বাংলাদেশের সকল প্রচার মাধ্যমে এমনকি ইসলামী রাজনীতির সাথে যুক্ত সংবাদপত্রেও প্রথম পাতায় পূজার খবর থাকে । কিন্তু আপনার পছন্দের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভরতের কোন প্রচার মাধ্যমে রোজা কিংবা ঈদের খবর কি দেখাতে পারবেন? বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রতি বছর পূজা উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। কিন্তু দূরদর্শনে রোজা কিংবা ঈদের কোন অনুষ্ঠান আমি কখনও দেখিনি । তবুও কি করে ভারত আপনার কাছে অতি প্রিয় সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়?
পাঁচ. অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিসমাস বা বড়দিনের উৎসবের সময় রাতদিন যে অনুষ্ঠানগুলো প্রচার করা হয় তাতে কি এদের সেক্যুলারিজমের কোন ক্ষতি হচ্ছে?
রেডিওর পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাওয়ায় সেদিন আর কথা বেশিদূর এগোয় নি। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমাদের খোঁজা উচিৎ। ইতিহাসের দলিলপত্র ঘেঁটে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় অথবা তার আগে আওয়ামী লীগের কোন দাবী, প্রচারপত্র বা শেখ মুজিবের বক্তৃতায় ধর্মনিরপেক্ষতার কোন কথা ছিলনা। বরং বিভিন্ন বক্তৃতা ও নথি বিশ্লেষণ করলে এর বিপরীত চিত্রটিই আমরা দেখতে পাই। চলুন তাহলে ইতিহাসের পাতায় একবার নজর বুলিয়ে আসি –
১। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগের দলিলপত্রগুলোতে কি ছিল?
উনিশশ ছেষট্টি সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচী দেয়। সে ছয় দফার অধীনে বেশ কিছু উপ-দফা ছিল। এই ছয় দফাই মূলত মুক্তিযুদ্ধের মূলভিত্তি। সত্তরের নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক এই ছয় দফা মানতে রাজী না হবার কারণেই মার্চের আলোচনাগুলো একের পর এক ভেস্তে যায় এবং দেশ একটি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ ছয় দফার মূল দফা বা উপ-দফার কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমের বিষয়টি পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোনভাবেই অন্তর্ভুক্ত ছিলনা (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২৬৭-২৭৩)।
উনসত্তরের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত “সংগ্রামী ছাত্রসমাজ” এগার ফা দাবী প্রদান করে। শেখ মুজিব তার সত্তর সালের বক্তৃতায় ছয় দফার পাশাপাশি গুরুত্বের সাথে সংগ্রামী ছাত্রসমাজের এই এগার দফার কথাও উল্লেখ করেন। এই এগার দফা দাবীরও কোথাও সেকুলারিজমের কোন কথা নেই (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৪০৯-৪১২)। পহেলা আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচীর ঘোষণা বা মেনিফেস্টো প্রকাশ করেন। এতেও কিন্তু সেকুলারিজমের কোন কথা ছিল না (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৪৭৩)।
সত্তর সালের তিরিশে মার্চ লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডিন্যান্স (LFO) জারি হয়। ভাসানী ন্যাপ এই LFO-সহ সম্পূর্ণ নির্বাচনকেই প্রত্যাখ্যান করে। মস্কো-পন্থী ন্যাপ LFO-এর বিশ নং ধারা-ভুক্ত বিষয়গুলো বাতিল দাবী করে। আন্দোলনরত সকল বিরোধী দলগুলোকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং তা এই LFO-এর অধীনেই। এই LFO-এর বিশ নং ধারাটির বিষয়বস্তু ছিল: “Fundamental principles of the constitution” অথবা সংবিধানের মূলনীতি। এই মূলনীতির (a) উপধারায় বলা হয়: “Pakistan Shall be a Federal Republic to be known as the Islamic Republic of Pakistan… ” . (b) উপধারায় বলা হয় “(i) Islamic ideology which is the basis for creation of Pakistan shall be preserved; and (ii) the Head of the State shall be a Muslim.” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৫১১)। অর্থাৎ বোঝা গেল ইসলাম ধর্মের আদর্শকে কে মূলভিত্তি মেনে নিয়েই আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল। তারা কিন্তু সেক্যুলারিজমের কোন দাবী তোলেনি।
এদিকে সত্তরের নির্বাচনী প্রচারাভিযানেও শেখ মুজিবের দেয়া বক্তৃতাগুলোর কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পাওয়া যায়না। সত্তর সালের সাতই জুন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করে। এদিন ঢাকার রেস কোর্সে অনুষ্ঠিত সমাবেশ সম্পর্কে ডন পত্রিকার রিপোর্টে লিখা হয়: “Sheikh repeatedly held out the assurance that Islam was in no danger on the sacred land of Pakistan, and lashed out at those who raised cries of ‘Islam in danger’ on flimsy grounds…”(Bangladesh Documents, Volume I , page 82)।
পঁচিশে অক্টোবর রংপুরের এক জনসভায় শেখ মুজিব বলেন: “… six-point programme would never destroy Pakistan or Islam but it would only destroy exploiters” – অর্থাৎ তিনি জয় বাংলা স্লোগান সম্পর্কে বলেন সেখানে কোন ইসলাম বিরোধী কোন কিছু নেই (The PEOPLE, Dacca – October 26, 1970, cited in Bangladesh Documents, Volume I, page- 102, 103)। পনেরই নভেম্বর মৌলভীবাজারে আরেক জন সভায় বলেন, “…Neither Pakistan nor Islam will go. What will go is the big bellies of capitalists” – অর্থাৎ এখানে তিনি ধর্ম বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় বরং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বললেন।
সত্তর সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে “Basic features of the constitution” শিরোনামের অধীনে লেখা ছিল: “Islam is the deeply cherished faith of the overwhelming majority of the people. Awami League affirms that a clear guarantee shall be embodied in the Constitution to the effect that no law repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quran and Sunnah shall be enacted or enforced in Pakistan. The sanctity of the religious institutions shall be constitutionally guaranteed. Adequate provisions shall be made for extending religious education at all levels” (Bangladesh Documents, page- 67, 68)। এখানে সেক্যুলারিজম তো দুরের কথা বরং ধর্ম তথা ইসলামের প্রতি তাদের অগাধ দরদই প্রকাশ পাচ্ছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সাতই ডিসেম্বর উনিশশ সত্তর সালে। নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর তেসরা জানুয়ারি উনিশশ একাত্তর সালে ঢাকায় এক সমাবেশে শেখ মুজিব বলেন, “Is There any objection anywhere against Islamic ways and systems after Awami League leaders have been elected to both National and Provincial Assemblies? Are not the people going their own way of life and has any harm been done to Islam? Has Islam gone and are not the people professing this great religion?” The PAKISTAN TIMES –এর রিপোর্টে আরও বলা হয়, “The rally offered ‘fateha’ for those killed in different movement for the people’s cause and kept its proceedings suspended on the advice of Sheikh Mujib during the Asr azan.” “… At the end of his speech Sheikh Mujib raised ‘nara-i-takbir’ slogan” (Bangladesh Documents, page-137)।
নির্বাচনের পর জাতীয় পরিষদের পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার কথা ছিল। আওয়ামী লীগ চাইছিল ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করতে। সেমতে তারা একটি খসড়া সংবিধানও রচনা করেছিল। ডঃ কামাল হোসেনের সূত্রে আওয়ামী লীগের সংবিধান কমিটি কর্তৃক ছয় দফার ভিত্তিতে প্রণীত পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্রের একটি কপি “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র”-এর দ্বিতীয় খণ্ডে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে Preamble শুরু করা হয়েছে এভাবে: “In the name of Allah, the Beneficent, the Merciful, We, the peoples of the autonomous States of Bangladesh, the Punjab, Sind, Pakhtunistan and Baluchistan,…” Preamble-এ আরও বলা হয়েছে: “Further resolving that guarantees shall be embodied in this Constitution… to enable the Muslims of Pakistan, individually and collectively, to order their lives in accordance with the teachings of Islam as set out in the Holy Quran and the Sunnah.” এই খসড়া শাসনতন্ত্রের PART III-তে Islam নামক ধারায় তিনটি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে: “(1) No law shall be repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quran and Sunnah. (2) Facilities shall be provided for the teaching of the Holy Quran and Islamiat to the Muslims of Pakistan. (3) Observance of Islamic moral standards should be promoted amongst the Muslims of Pakistan” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড)।
২। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর দলিলে কি পাওয়া যায়?
দশই এপ্রিল উনিশশ একাত্তর সালে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। সেখানে স্বাধীনতা ঘোষণার ৯টি কারণ বা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয় (Whereas…AND…Whereas এই আকারে) সেখানে কোথাও ধর্ম সংক্রান্ত কোন সমস্যার কথা উল্লেখ নেই। যেহেতু ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি, যেহেতু গণহত্যা করা হয়েছে ইত্যাদিকে স্বাধীনতা ঘোষণার কারণ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাধীনতা ঘোষণার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে: “We…in order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice, declare and constitute Bangladesh to be sovereign Peopels’ Republic…” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড)। তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানে equality, human dignity এবং social justice- অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের জন্যেই আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হল। এখানে সেকুলারিজমের বা ধর্মনিরপেক্ষতার কোন কথা বলা হয়নি। এগারই এপ্রিল নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ বা সতেরই এপ্রিল বিশ্বের উদ্দেশ্যে ইস্যুকৃত প্রেস স্টেটমেন্টেও এধরনের কোন কথা পাওয়া যায় না। অন্যদিকে চোদ্দই এপ্রিল জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী প্রকাশ করা হয়। সেটা শুরু করা হয় এভাবে: “আল্লাহু আকবর, স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী…” এবং এটি শেষ করা হয় এভাবে: “এ সংগ্রাম আমাদের বাচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন। স্মরণ করুন: আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ সুখকর’। বিশ্বাস রাখুন: ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী’। জয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব!জয় বাংলা!” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড)।
এবারে দেখি মুক্তিযুদ্ধের সময় কি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেক্যুলার কোন চেতনা কাজ করেছে? এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল বলেন: “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মীয় অনুপ্রেরণা মোটেও অনুপস্থিত ছিলনা। প্রতিটি যোদ্ধার শ্বাসে-নিঃশ্বাসে, রণক্ষেত্রের প্রতিটি ইঞ্চিতে স্মরণ করা হয়েছে মহান স্রষ্টাকে – তার কাছে কামনা – প্রার্থনা করা হয়েছে বিজয়ের জন্য, নিরাপত্তার জন্য। অধিকাংশ যোদ্ধাই যেহেতু ছিল এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগণেরই সন্তান, সেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর বুলেট, মর্টারের সম্মুখে আল্লাহ এবং রসূলই ছিল তাদের ভরসাস্থল। সুতরাং ’৭১ –এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইসলাম অনুপস্থিত ছিল বলে যারা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, তারা কেবল বাস্তবতাকেই অস্বীকার করছেন।” (মেজর (অব:) এম এ জলিল, কৈফিয়ত ও কিছু কথা, পঞ্চম প্রকাশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৬)। তিনি আরও বলেন: “ইসলাম পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্য-বাদ, বর্ণবৈষম্য-বাদ, রাজতন্ত্র সহ সকল ধরনের স্বৈরশাসনের ঘোর বিরোধী। … স্বাভাবিক কারণেই ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি” (অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, সপ্তম অধ্যায়)। তিনি মন্তব্য করেন, “যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভূত মাথায় বহন করে এনেছে তারা …ভুল করেছে…।” “…ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দান ইসলাম তো করেই না, অন্যান্য ধর্ম মতেও তদ্রূপ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ ছিল, ধর্মযুদ্ধ ছিল না। সুতরাং যুদ্ধোত্তর কালে ধর্মের প্রতি উষ্মা কিম্বা কটাক্ষ করার কোন যুক্তিই নেই, থাকতেও পারে না। তবুও রয়েছে কেন?”(অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, সপ্তম অধ্যায়)।
৩। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা কোথা থেকে এলো?
দশই জানুয়ারি উনিশশ বাহাত্তর সালে নয়া দিল্লীতে একটি পাবলিক মিটিং-এ শেখ মুজিবর রহমান-এর বক্তব্য সম্পর্কে দি নিউ ইয়র্ক টাইমস (১১ জানুয়ারি ১৯৭২) লিখে: “He said his country would be founded on the same principles as India – ‘Bangla Desh stands for secularism, socialism and democracy” (Bangladesh Documents Volume II, page – 609) সতেরই মার্চ উনিশশ বাহাত্তর সালে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এক সমাবেশে বলেন: “Change is the law of life. Many changes are taking place in India and Bangaldesh…Our policies in India are built upon democracy, secularism and socialism, not because they are fine-sounding words but because only a combination of these three principles can enable a country of our size and diversity to be united and strong… Common principles and objectives have brought Bangladesh and India together. We shall firmly stand together by them, and derive inspiration from them for our march forward.” [India Bangladesh Relations Documents -1971-2002, Volume-I, Edited & Introduced by Avtar Singh Bhasin, page-27] ।
উনিশশ বাহাত্তর সালের চৌঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে পাস হয়। সাতাশে নভেম্বর উনিশশ বাহাত্তর সালে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবু সাইদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে এক ভোজসভায় ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি.ভি. গিরি বলেন: “…We have been immensely impressed by the fact that, in its devotion to the democratic process, the Bangladesh Government has succeeded so soon in adopting a Constitution, with the four guiding principles of Nationalism, Socialism, Democracy and Secularism, ideas which have inspired our own people” (India Bangladesh Relations Documents -1971-2002, Volume-I, Edited & Introduced by Avtar Singh Bhasin, page-60)।
উপরের দলিলগুলো থেকে যা বোঝা যায় তা হচ্ছে – এগারই জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়ে দিল যে বাংলাদেশ ভারতের মূলনীতিগুলোই গ্রহণ করতে যাচ্ছে। পরবর্তীতে সতেরই মার্চ ইন্দিরার সুপারিশ মূলক বক্তব্য এবং চৌঠা নভেম্বর ভারতের প্রেসিডেন্টের ধন্যবাদ জ্ঞাপন থেকে সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে ভারত সংশ্লিষ্টতার দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ ব্যাপারে মেজর জলিল তার “অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা” বই-এর অষ্টম অধ্যায়ে “আওয়ামী লীগের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উৎস” শিরনামে উল্লেখ করেন: “এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতা হচ্ছে স্বয়ং দিল্লীর শাসক চক্র। বাহাত্তরের সংবিধানের উৎস তাই বাংলাদেশের জনগণ নয়, সম্প্রসারণ-বাদী এবং সাম্প্রদায়িক ভারতীয় শাসক চক্রই হচ্ছে মূল উৎস।”… “যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের কোটি কোটি বুভুক্ষু মানুষের জন্য অন্নবস্ত্রের পূর্বেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এসে মাথায় চেপে বসে। এই চার মূলনীতি আরোপ করার মধ্য দিয়ে দিল্লীর কর্তারা তাদের মূল লক্ষ্যই স্থির রেখেছে কেবল। কারণ ভারতীয় সংবিধানও চার মূলনীতির ব্যতিক্রম নয়। তাই বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে মূলত ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে সূক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নীতির গোপন সূত্রে বেঁধে দেয়া হয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং তার আগের তথ্য প্রমাণ থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা কি তা আমরা দেখতে পাই। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ, তারা ধর্মান্ধও নয়, ধর্ম-বিদ্বেষীও নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে একরাশ ইসলাম-বিদ্বেষ। যে অপচেষ্টা এখনও পুরো দমে জারি আছে ।
আজকের লিখাটি অনেক লম্বা হয়ে গেল। যাই হোক, একাত্তর সালের চোদ্দই এপ্রিল জনগণের প্রতি নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া নির্দেশাবলীর শেষ অংশটুকুর পুনরাবৃত্তি করে আজকের লিখা শেষ করছি – “এ সংগ্রাম আমাদের বাচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন। স্মরণ করুন: আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ সুখকর’। বিশ্বাস রাখুন: ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী”।
[লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক]