সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব তত্ত্বাবধায়ক সরকারেই

  • তারেকুল ইসলাম
  •  ১৬ জুন ২০২৩, ২০:০৪

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় এমপির চিঠি এখন আলোচনায়। চিঠিতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে অবাধ, স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভ‚মিকা রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে- ‘আমরা বাংলাদেশে আসন্ন ১২তম সাধারণ নির্বাচনের ওপর ফোকাস করার গুরুত্বের ওপর জোর দিতে চাই, যা ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের শুরুতে হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার এখনো বাকি। কারণ সেখানে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি একটি সমস্যা, যেহেতু কারচুপি, কারসাজি ও ভোটারদের অনুপস্থিতি দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন বিঘ্নিত করেছে।’

দলীয় সরকার নাকি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন- এই মেরুকরণে বিভক্ত সরকার ও বিরোধী শিবির। বিগত ২০১১ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আপিল বিভাগ ওই রায়ে এই পরামর্শও দেয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় আরো দু’টি মেয়াদে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আপিল বিভাগ যে আট সদস্যের অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি পরামর্শক) নিয়োগ দিয়েছিল, তাদের সাতজনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তাদেরই একজন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম স¤প্রতি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা সত্তে¡ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন সম্ভব বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যারা তখন মতামত দিয়েছিলেন, তাদের মতামতগুলোকে তিনি ‘রিভাইভ’ করার কথা বলেছেন। বাস্তবতা হলো- কোনো পক্ষ-বিপক্ষ ছাড়াই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আমাদের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে। অতীতও তা-ই বলে। তা ছাড়া কোনো আমলেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি; কোনো না কোনোভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক হানাহানির জন্ম দিয়েছে। গণতান্ত্রিক নাগরিক সমাজের নেতারাও বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করলেও তা সংবিধানের অজুহাতে থোড়াই কেয়ার করেছে সরকার। সন্দেহ নেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর কখনো ফিরিয়ে আনা হবে না- এমন কর্তৃত্ববাদী অবস্থান প্রকারান্তরে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দ্ব›দ্বকেই প্রলম্বিত করবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর কোথাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নেই।’ তার এ দাবিটি বিভ্রান্তিকর। কারণ, খোদ ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনিস্টার সিস্টেমেও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার (Caretaker conventions) নিয়ম রয়েছে, যদিও তাদের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ফ্রেমওয়ার্কের সাথে আমাদের অবস্থার সাযুজ্য নেই। তাদের ক্ষেত্রে নতুন সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত চলতি সরকারই কেয়ারটেকার সরকার হিসেবে সীমিত পরিসরে বহাল থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে কাজ করে। তাদের জাতীয় নির্বাচন কমিশন দলীয়করণমুক্ত এবং স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার সুযোগ পায়। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন যে সরকারি দলের আজ্ঞাবহ তা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়ই প্রমাণ হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের প্রশাসন, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যেভাবে দলীয়করণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে, তাতে করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অলীক চিন্তামাত্র।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকারের সুযোগ নেই। ২০১৫ সালের আগস্টে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত Constitutional Conventions in Westminster System বইয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘Elections are nervous times for the incumbent government and the opposition. Modern politics is hard fought, and in such a win/lose environment there is great pressure not to give an edge to political opponents. The Westminster parliamentary model provides for both continuity and restraint during the election and transition period with caretaker conventions. The aim of the conventions is to hold the incumbent government to a ‘status quo’ until the new government is formed. It is a governing tradition shared by the Australian, Canadian, New Zealand and UK parliamentary systems’ (Caretaker Conventions, Section-5, Page-91). (অর্থাৎ, নির্বাচনের সময়টা সরকার ও বিরোধী দলের জন্য স্নায়বিক চাপ তৈরি করে। আধুনিক রাজনীতির লড়াইটা কঠিন। এমন হার-জিতের পরিবেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোনো সুযোগ দেয়ার মানসিকতা থাকে না। তাই ওয়েস্টমিনস্টার সংসদীয় মডেল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচন ও ক্রান্তিকালে শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা এবং ভারসাম্য বজায় রাখে। এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো- নতুন সরকার গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বিদ্যমান সরকারকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখা। যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার সংসদীয় সিস্টেম এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ঐতিহ্য ধারণ করে।)

কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো- ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার একটি স্বতন্ত্র ফ্রেমওয়ার্ক থাকলেও আমাদের নিজস্ব কোনো ফ্রেমওয়ার্ক কি আছে? ব্যারিস্টার আমীর উল-ইসলাম তার সা¤প্রতিক বক্তব্যে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্যও একটি ফ্রেমওয়ার্ক থাকার আবশ্যকতার কথা বলেছেন, যেটি দুর্ভাগ্যক্রমে আজো আমাদের হয়নি। আমাদের বিরোধী দলগুলোর উচিত, তাদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিকে আরো গঠনমূলক ও জোরালো করে তোলার জন্য অবিলম্বে আমাদের উপযোগী একটি বাস্তবভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করানোর কাজ শুরু করা। কোনো গ্রহণযোগ্য ফ্রেমওয়ার্ক না থাকলে চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছা আমাদের জন্য দুরূহ হবে। ভবিষ্যতে আবারো একই রাজনৈতিক সঙ্কটে আমাদের ঘুরপাক খেতে হতে পারে।

অন্য দিকে, সরকার যতই বড় গলায় দাবি করুক তারা গণতন্ত্রের পথে রয়েছে কিন্তু তা সত্তে¡ও বাইডেন-আহূত দু’টি গণতন্ত্র সম্মেলনের একটিতেও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের কঠোর চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। ইতোমধ্যে ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যান ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের সুযোগ তৈরিতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া’র আহ্বান জানিয়ে বাইডেনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে প্রয়োজনে কঠোর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সেনাদের জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধসহ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। সেই চিঠির ব্যাপারে হোয়াইট হাউজ অবগত আছে বলে জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন্সের পরিচালক অ্যাডমিরাল জন কার্বি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র অনড় অবস্থানে রয়েছে।’ তা ছাড়া বাইডেন প্রশাসনের ফরেন পলিসিতে বিশ^জুড়ে কর্তৃত্ববাদ মোকাবেলার বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। তাই বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উন্নতিতে কাজ করছে বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্র। তারই ধারাবাহিকতায় সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে যারা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তাদের ওপরই এই নয়া ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে বিøংকেন সুস্পষ্টভাবে সেই অপকর্মগুলো উল্লেখ করে দিয়েছেন- ‘Actions that undermine the democratic election process include vote rigging, voter intimidation, the use of violence to prevent people from exercising their right to freedoms of association and peaceful assembly, and the use of measures designed to prevent political parties, voters, civil society, or the media from disseminating their views’.

এই ভিসানীতি মূলত কাদের উদ্দেশ্যে তা বোঝার আর বাকি নেই। সুতরাং, সংবিধানের অজুহাত দেখিয়ে ২০১৪ সালের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা নির্বাচন করে আগের মতো পার পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পূর্বঅভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে অটল রয়েছে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। ফলে সরকারের জন্য ২০১৮ সালের মতো নিশিরাতের ভোটডাকাতির মাধ্যমে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগও কমে এসেছে তা বলাবাহুল্য।

অন্যদিকে, সরকারের পক্ষে চীন ও রাশিয়া নানা সময়ে লিপ সার্ভিস দিলেও ভারতকে নীরব ভ‚মিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রতি আগের মতো প্রকাশ্য সমর্থন দিতে দেখা যাচ্ছে না। লক্ষণীয়, দিল্লির চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখার নীতি থেকে সরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে নতুন ভ‚-রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধি করেই ভারতের জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত স¤প্রতি বিবিসি বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের হয়ে দেনদরবার করবে না ভারত সরকার।’ উল্লেখ্য, তারও আগে র‌্যাবের ওপর মার্কিন স্যাংশন প্রত্যাহার করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার ভারতের দ্বারস্থ হলেও তাতে কোনো ফল আসেনি। শ্রীরাধা আরো বলেছেন, ‘পরপর দুটো নির্বাচন নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠলেও ভারত চোখ বুজে ফলাফল মেনে নিয়েছে। এটি ঠিক, ভারত আওয়ামী লীগকে অন্ধের মতো সমর্থন করেছে… কিন্তু আমেরিকা এখন যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে সেটি ভারতের জন্য চিন্তার জায়গা তো বটেই। মনে হচ্ছে না আমেরিকানরা পেছাবে। সেখানে ভারত কী করতে পারবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান।’

এটি ঠিক, মিয়ানমার ও ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পলিসি ও স্ট্র্যাটেজির সাথে ভারতের অবস্থান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত কৌশলগতভাবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পক্ষেই থেকেছে, যা আমেরিকার নতুন মিয়ানমার অ্যাক্টের বিরোধী। এ ছাড়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর দায়ে রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক স্যাংশন সত্তে¡ও ভারত বিপুল পরিমাণে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস ক্রয় করেছে, যা রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা সহায়তা করেছে। এসব কারণে ভারতের মোদি সরকারের ওপর পশ্চিমাদের চাপ রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি কর্নাটকের নির্বাচনে বিজেপির লজ্জাজনক হার মোদি সরকারের জন্য ঘরেও চাপ তৈরি করেছে।
ভারতে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসসহ বাকি বিরোধী পক্ষগুলো ভারতের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো ধূলিসাৎ হচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ তুলছে। আমেরিকায় সাম্প্রতিক এক সফরকালে ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘ভারতীয় গণতন্ত্র সারা বিশ্বের জন্য ভালো বিষয়। ভারতের গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়লে তার প্রভাব সারা বিশ্বে পড়বে। পাশাপাশি তা আমেরিকার জাতীয় স্বার্থের জন্যও ভালো নয়। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই আমাদেরই করতে হবে, এটি আমাদেরই কাজ।’ (২ জুন ২০২৩, দ্য ট্রিবিউন ইন্ডিয়া) সুতরাং, ঘরেও বিরোধীদের আন্দোলনের চাপে রয়েছেন মোদি। তাই সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে- বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বলিষ্ঠ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ঝুঁকি হয়তো মোদি সরকার নেবে না।

তবে নতুন খবর হলো- মোদি তার আসন্ন ওয়াশিংটন সফরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তুলবেন বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। গত ১০ জুন ‘এগিয়ে আসছে নির্বাচন, ঢাকার উদ্বেগ নিয়ে মোদির সফরে বাংলাদেশকে বার্তা দিতে চায় ভারত’-শীর্ষক আনন্দবাজারের এক রিপোর্টে মোদি বাংলাদেশের ব্যাপারে ওয়াশিংটনকে কী বলবেন তার দুটো বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ১. বাংলাদেশে এমন কিছু করা বাঞ্ছনীয় নয়, যাতে সে দেশে মৌলবাদী, কট্টরপন্থী, সন্ত্রাসবাদীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা যায়। ২. সে দেশে এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে আওয়ামী লীগ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রথমত, যেখানে এ বছরের শুরুতে বিবিসির প্রচারিত ‘ইন্ডিয়া : দ্য মোদি কোশ্চেন’ তথ্যচিত্রে গুজরাট দাঙ্গা মোদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে সহায়তা করেছে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেখানে মোদির মতো বিতর্কিত ব্যক্তির মুখে মৌলবাদ ও কট্টরপন্থার জুজু কি ওয়াশিংটনকে টলাবে? তা ছাড়া ওয়্যার অন টেররের নীতি এখন আর মার্কিন ফরেন পলিসির কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। এই বাস্তবতাও বোঝার ব্যাপার আছে। সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে আমেরিকা থেকে সুবিধা হাতানোর দিন এখন বিগত। দ্বিতীয়ত, চীনের দিকে আওয়ামী লীগের ঝুঁকে যাওয়ার হুমকি যে ফাঁপা বিষয়, তা যুক্তরাষ্ট্র বোঝে না এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ চীন ও রাশিয়ার বলয়ে ঢুকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ উপেক্ষা করার মতো অর্থনৈতিক শক্তি ও স্বাবলম্বিতা বাংলাদেশের নেই। পোশাক রফতানি থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপকভাবে পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের রফতানি আয়ে চীন ও রাশিয়ার অবদান সে তুলনায় অতিশয় নগণ্য। তা ছাড়া ভঙ্গুর রিজার্ভ ও বৈদেশিক ঋণের ভারে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। সেই সাথে জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও তীব্র অসন্তোষ তো আছেই।

যাই হোক, ইইউর ছয় এমপির চিঠি সরকারের ওপর নতুন চাপ তৈরি করবে সন্দেহ নেই। কারণ চিঠিতে ইউরোপিয়ান অর্থনৈতিক জোনে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা ও জিএসপি প্লাস প্রণোদনার শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বলতে হচ্ছে, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনিবার্যতা অগ্রাহ্য করলে তার পরিণতি শুধু ক্ষমতাসীনদের জন্য নয়, দেশ ও জনগণের জন্যও আখেরে ভালো হবে না।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]