সুশাসন-শুদ্ধাচার ও অন্ত-বহিস্থ তাগিদ

সুশাসন-শুদ্ধাচার ও অন্ত-বহিস্থ তাগিদ

Daily Nayadiganta

একটি দেশ ও রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো, সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেতৃত্ব, দল ও গোষ্ঠীর মনোভাব তথা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সমাজতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিশেল ফুকো এই প্রপঞ্চকে তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন। ১৯৭৭-৭৮ সালে ‘গভর্নমেন্টালিটি’ বা ‘শাসন মানসিকতা’ নামে প্রদত্ত বক্তৃতামালায় তিনি এ তত্ত্ব তুলে ধরেন। ২০০৭ সালে ‘সিকিউরিটি, টেরিটরি ও পপুলেশন’ নামে তার এই বক্তৃতামালা প্রকাশিত হয়। এতে তিনি একটি নির্দিষ্ট সরকারের ধরন-ধারণ প্রকাশে মনস্তত্ত্বের প্রায়োগিকতা তুলে ধরেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, এর সাথে তিনটি বিষয় জড়িত। প্রথমত, ক্ষমতা প্রয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিক ধরন-ধারণ। দ্বিতীয়ত, একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত ক্ষমতাবলয়ে প্রকৃতি ও প্রবণতা। তৃতীয়ত, ওই নির্দিষ্ট শাসক এলিটদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রক্রিয়ার প্রভাব। ফুকো মনে করেন, এ তিনটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের গতিপ্রকৃতি নির্ণিত হয়। মিশেল ফুকোর এই তত্ত্বের ভিত্তিতে মিথছেল ডিন ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘গভর্নমেন্টালিটি- পাওয়ার অ্যান্ড রুল’ নামের গ্রন্থে ফুকোর ধারণার প্রাতিষ্ঠানিকতা দেন। যেকোনো দেশ, সমাজ ও সরকারকে বুঝার জন্য এ তত্ত্বটি প্রায়োগিক যোগ্যতা রাখে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের মন-মানসিকতা, প্রক্রিয়া-প্রবণতা ব্যাখ্যা করার জন্য এই তত্ত্ব বাস্তবসম্মত।

আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে এর প্রভাব-প্রতিপত্তি অনস্বীকার্য। ফুকোর প্রথম বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, যদি আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকার বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো, ‘ক্ষমতা প্রয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিক ধরন-ধারণ’ সেই ১৯৪৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একই রকম রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। আর অস্বাভাবিক হলো ক্ষমতা অর্জনে একক প্রাধান্য ও শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হত্যা করা হয়। তখনকার পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন তাদের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। ১৯৫৭ সালে বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যখন লক্ষ্য ও আদর্শচ্যুতির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন, তখন আওয়ামী লীগ ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালি’কে অধিকতর সুবিধাজনক মনে করে ও দলের বিভক্তি ঘটায়। ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর অধীনে যখন গণতন্ত্র চর্চার সীমিত সুযোগ আসে তখন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নিজ নিজ রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত না করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বান জানান। এটি ‘৯ নেতার বিবৃতি’ বলে খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতার এই আদেশ অগ্রাহ্য করে। এখানের নেতা এককভাবে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটান। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাড়া অন্য যাদের ভূমিকা ছিল, তাদের কোনো মূল্যায়ন হয়নি। ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল্লাহ (পরবর্তীকালে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ঘোষক) মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কারাবরণ করেও যথাযথ স্বীকৃতি পাননি। এনএসএফের ১১ দফা পক্ষের নেতা ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরীর ভাগ্যেও তেমন সম্মান জোটেনি। ফুকোর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য দিয়ে যদি আমরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরবর্তী অধ্যায় বিবেচনা করি, তাহলে দেখব ‘ক্ষমতাবলয়ের প্রকৃতি ও প্রবণতা’ অথরেটারিয়ান বা একক কর্তৃত্ববাদী ধরনের ছিল। স্বাধীনতার পর পর সব রাজনৈতিক নেতা যখন জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানায়, আওয়ামী লীগ তা অগ্রাহ্য করে। সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে তারা জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান সংযোজন করে। এ বিধানের সর্বনাশা ফলাফল পরবর্তীকালে জাতি প্রত্যক্ষ করে। বিনা বিচারে আটক করার ‘স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট’ তারাই প্রণয়ন করে। এসব প্রবণতা অবশেষে ‘এক নেতা এক দেশ’-এ রূপান্তরিত হয়।

চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়। এবার আসা যাক, ফুকোর তৃতীয় বৈশিষ্ট্যে। সামরিক শাসন অবসান ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে ২১ বছর পর একপর্যায়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর তাদের নেতৃত্ব যখন অনুধাবনে সক্ষম হয় যে, জনগণের ভোটে তাদের ক্ষমতাসীন হওয়া অনেকটা অসম্ভব বিষয় তখন তারা নিজেদের প্রবর্তিত, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা’ নাকচ করে দেয়। ‘ওই নির্দিষ্ট শাসক এলিটদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রক্রিয়ার প্রভাব’ এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, সমালোচকদের ভাষায় ‘সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধরনের শাসন প্রবণতায় ব্যক্তিই রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে। তার নির্দেশ ছাড়া গাছের পাতাটিও যেন নড়ে না। মন্ত্রী ও সভাসদরা সব সময় তার নির্দেশের উল্লেখ করেন। বিগত প্রায় এক যুগে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে জনগণের ওপর তাদের আস্থাহীনতার কথা। এবার তারা কখনো ‘বোগাস’ নির্বাচন আবার কখনো বা ‘নিশীথ’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে আছে। এর ফলে ‘নির্বাচন’ নামক ব্যবস্থার সমূলে বিনাশ সাধিত হয়েছে।

এতসব সত্ত্বেও যদি ব্যক্তিতন্ত্রের মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে জনগণের আপত্তির কারণ থাকে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ ধরনের ইতিবাচক একনায়কত্বকে ‘বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটরশিপ’ বা মহানুভব স্বৈরতন্ত্র বলে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাধারণ প্রবণতা এ রকম ‘অ্যাবসলিউট পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি’- সার্বিক ক্ষমতা সার্বিকভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্রমেই সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। নিয়মতান্ত্রিকভাবে বা আইনের শাসনের অবসান ঘটে। সরকারের অদক্ষতা, দলীয়করণ প্রবণতা ও দুর্নীতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির সমীক্ষাগুলো স্মরণ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের অনিবার্য প্রতিষ্ঠান- আইনসভা গ্রহণযোগ্যতা হারায়। আমলাতন্ত্র বা নির্বাহী বিভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিচার বিভাগে সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধি মোতাবেক অনিবার্য বিরোধী দলকে নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন, গুম ও মামলা-হামলার মাধ্যমে নিঃশেষ করে দেয়া হয়। হাস্যকরভাবে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের জন্ম দেয়া হয়। সেটি আবার সরকারি ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ওঠে। মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করা হয়। সভা-সমিতি, আন্দোলন-সংগ্রাম সরকারের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এমন ভীতির রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে মানুষ নিঃসঙ্কোচে কথা বলতে ভয় পায়। সরকারের সমর্থনের ভিত্তি এভাবে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। বাংলাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবণতা এই যে, সব সময় জনগণের একটি অংশ হালুয়া-রুটির ভাগ বসানোর জন্য সরকারি দলে নাম লেখায়। টাকার বিনিময়ে মিছিলে যায়। সুবিধার বিনিময়ে সেøাগান তোলে। ক্ষমতার বিনিময়ে কর্তৃত্ব করে। তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতি, রাহাজানি, লুটপাট ও জবরদখল স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

এ অবস্থায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সব প্রথা ও প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের একটি অংশ শক্তভাবে রাষ্ট্রিক দুরবস্থার জন্য শাসন কর্তৃত্বকে দায়ী করে। প্রায়ই আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ‘১/১১’ পরিস্থিতি ডেকে আনার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী জাতিকে নিশ্চিত করেন যে, ১/১১ ঘটনা আর ঘটবে না বা ঘটতে দেয়া হবে না। নির্বাচনী কারচুপির কারণে আওয়ামী লীগ জনগণের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে। জনগণ অন্যায়, অপকর্ম ও দুর্নীতির কারণে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে আছে- এ কথা আওয়ামী নেতৃত্বের অজানা নয়। গুজব রটে যে, শাসক দলে উত্তরাধিকারের সঙ্কট চলছে।

অপর দিকে বহিস্থ বলয়ের অবস্থাও অনুকূল নয়। বিশ^স্ত প্রতিবেশীকে সব কিছু দিয়েও যেন শেষ রক্ষা হয় না। সেখানের সরকার ও দলের দ্বৈত অবস্থান সত্ত্বেও কেবল তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’ বাংলাদেশে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে। প্রতিবেশীর বৈরী নিকটের শক্তিধরের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে বলে শোনা যায়। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’- এ নীতির কারণে উভয় কূল হারানোর সম্মুখীন হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। পাশ্চাত্যে এখনো নির্বাচনকালীন দ্বৈধতার অবসান ঘটেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব কূটনীতির ভাষায় বারবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকার কয়েকটি দেশ আবরার হত্যাকাণ্ডের পর উদ্বেগ প্রকাশ করে। জাতিসঙ্ঘের ঢাকাস্থ প্রতিনিধি আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এমন মন্তব্য করে যে, তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সুশাসন ও মানবাধিকারে উন্নতির তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশকে। তারা বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) অব্যাহত রাখতে হলে গণতন্ত্র, সুশাসন, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশকে আরো উন্নতি করতে হবে। এ বিষয়গুলোতে উন্নতির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি জোটের সদস্য ২৭টি দেশের সাথেও বাংলাদেশকে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলোতে আরো কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা ভাবছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা জোর দিয়ে বলছে, ইউরোপের সাথে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্পর্কের ভিত্তিমূল হবে মানবাধিকার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর ইউনিয়নের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা প্যাম্পালনি সাংবাদিকদের বলেছেন, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের কিছু বিষয়ে আমরা উদ্বেগ তুলে ধরেছি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে নাগরিক সমাজের কাজের পূর্ণ সুযোগের ওপরও জোর দিয়েছে’। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, মানবাধিকার বিশেষ করে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইইউ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করেছে। বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। দুই পক্ষই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সুশাসন, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছে।

উপর্যুক্ত অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ চাপের কারণে সাম্প্রতিক তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের সূচনা হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। শুদ্ধি অভিযান বা শুদ্ধাচারের কবলে পড়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। এদের অপরাধী অংশ অবাধে এক যুগ ধরে অবাধ লুটপাট ও নৈরাজ্য কায়েম করেছে। মূল দলের কাউকে এখন পর্যন্ত স্পর্শ করা হয়নি। রাঘব বোয়ালরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। অবশ্য কয়েকজন এমপি এবং আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। দুদক ইতোমধ্যে ১০০ জনের নামের তালিকা তৈরি করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ব্যবস্থাটি লোক দেখানো এবং সাময়িক। যুক্তি হিসেবে তারা ফুকোর ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতে চান। তারা বলতে চান, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই নীতিহীনভাবে ক্ষমতালিপ্সু থেকেছে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সহনশীলতার তীব্র অভাব রয়েছে। তাদের অনুসৃত কার্যক্রম যেমন আবরার হত্যা- প্রমাণ করে যে স্বেচ্ছাচার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে, দেশে অঘোষিত একদলীয় শাসন চলছে। সে ক্ষেত্রে সুশাসনের নমুনা প্রদর্শনের জন্য নাটক চলছে। আওয়ামী লীগের অনুসৃত শাসন এবং ত্রাসের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি বা ফুকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী পরিবর্তন সম্ভবও নয়। রাজনীতিতে শুদ্ধি অভিযান নতুন নয়। কিন্তু তার নিশ্চিতের জন্য সেরূপ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রয়োজন। ঠগ বাছতে গা উজাড়- এ কথাটি যদি সত্যি হয় তাহলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব রক্ষা করাই কঠিন। দুর্নীতি ও ক্ষমতার মোহ আওয়ামী পরিবারকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছে যে, তারা বিকল্প সন্ধানে ব্যর্থ। সত্যি সত্যিই যদি আওয়ামী লীগ পরিবর্তন আনতে চায় তাহলে তাকে সুশাসনের নীতিমালায় ফিরে যেতে হবে। বিশ্বব্যাংক সুশাসনের ছয়টি মাত্রা নির্ণয় করেছে। এগুলো হলো- ১. প্রতিবাদের অধিকার তথা জবাবদিহিতা ২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ৩. সহিংসতা তথা সন্ত্রাসের অনুপস্থিতি ৪. সরকারের সক্ষমতা ৫. আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ও আইনের শাসন ও ৬. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ। সুশাসনে সামষ্টিক শাসনের এবং সিদ্ধান্ত নেয়ায় বহুত্ববাদের কথা বলা হয়েছে। সরকারের সব কার্যক্রম হবে জনকল্যাণমুখী। সুশাসন মানেই হচ্ছে, সম্মতির ভিত্তিতে শাসন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এতে সম্পৃক্ত থাকবে সুশীলসমাজ, বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, নিঃশর্ত সেবা এবং সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে- সুশাসনের অনুষঙ্গ। ক্ষমতাসীন সরকারের পরিচালিত শুদ্ধি অভিযান বা শুদ্ধাচার তখনই সফল হতে পারে যখন তারা সুশাসনের অনিবার্য শর্তাবলি অনুসরণ করবে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]