৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সুপ্রিমকোর্টে নজিরবিহীন সন্ত্রাস, ভাংচুরে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ও খুনের মামলার প্রধান আসামীকে বিচারক বানানো হচ্ছে, এমন রিপোর্ট করেছিলাম ২০১০ সালের মার্চ মাসে। এতে তাদের শপথ পড়াতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম। যদিও তিনি ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়তে শেখ হাসিনার শাসনের শুরুতে অনেক তাঁবেদারি এবং দালালি করেছেন। তবে আমার দেশ-এ রিপোর্ট প্রকাশের পর সন্ত্রাসী এবং খুনের মামলার প্রধান আসামীকে শপথ না পড়িয়ে জীবনে হয়ত একটি ভাল কাজ করেছিলেন। যদিও মোহাম্মদ ফজলুল করিম অবসরের পর খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হয়ে ওই সন্ত্রাসী ও খুনিকে ৬ মাস পর শপথ পড়ান এবং বিচারকের আসনে বসার সুযোগ করে দেন।
এ প্রসঙ্গটি টানলাম, একটি বিশেষ কারণে। সুপ্রিমকোর্টের সন্ত্রাসে জড়িত থাকা সেই বিচারক খসরুজ্জামান বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এনিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এতেই তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনেছেন খসরুজ্জামান। আর এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের আপিল বিভাগ শাখা হিসাবে পরিচিত আপিল বিভাগ ৭ আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছে। আগামী ১৯ অক্টোবর এই রুলের শুনানীর দিন ধার্য্য করা হয়েছে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীও রয়েছেন এই ৭ জনের তালিকায়।
হাইকোর্টের একটি আদেশের সূত্র ধরে এই রুল জারি করা হয়েছে। এবং হাইকোর্ট বিভাগের আদেশটি কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশও দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আপিল বিভাগ শাখার বিচারকরা। এই আদেশটি দেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালের ২৩ মে। আদেশে বলা হয়েছিল দেশের কোন আদালত অঙ্গনে মিটিং-মিছিল করা যাবে না। আদালত বর্জন থেকে বিরত থাকার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল আদেশে। এ আদেশ অমান্য করলে আদালত অবমনার দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার কথা ও বলা রয়েছে।
এ আদেশটি দেওয়া হয়েছিল একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে। সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি রোকন উদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে আওয়ামী আইনজীবীদের নৈরাজ্য থেকে আদালত অঙ্গনকে রক্ষা করার নিমিত্তে। কারণ, ২০০৫ সালে আওয়ামী আইনজীবীদের বেপরোয়া নৈরাজ্যের কারণে দেশের বিচার বিভাগে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। কথায় কথায় আদালত বর্জন এবং আদালতের বারান্দা ও করিডোরে মিটিং-মিছিল এবং জয়বাংলা শ্লোগানের কারণে ব্যাহত হচ্ছিল বিচারিক কার্যক্রম। আওয়ামী আইনজীবীদের অব্যাহত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে আদালত অঙ্গনকে রক্ষার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ নির্দেশনা জারি করেছিল। তবে এই আদেশের কপিতে তখন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আওয়ামী আইনজীবীরা। মুখে কালো কাপড় বেধে সভা-সমাবেশ করে তারা দাবী করেছিলেন সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদ করা সাংবিধানিক অধিকার।
অথচ, এই আদেশটিকেই এখন পুঁজি করেছে সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী আপিল বিভাগ শাখা। সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী আপিল বিভাগ শাখা বলার কারণটাও একটু সংক্ষেপে বলে রাখতে চাই। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী একজন আওয়ামী আইনজীবী নেতা ছিলেন। বিচারক হিসাবে শপথ নেওয়ার পরও তিনি আওয়ামী লীগের ভাষায় বক্তব্য দিতেন। আপিল বিভাগে সিরিয়ালে দ্বিতীয় ওবায়দুল হাসান শাহিন। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার কথা তারই। তিনি বাকশাল ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর পিতা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। ভাই শেখ হাসিনার পিএস ছিলেন। বর্তমানে ২০১৮ সালের জালিয়াতির নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্য। সিরিয়ালে তৃতীয় ব্যক্তিটি হলেন, সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের সাথে সেক্রেটারির দায়িত্বপালনকারী ইনায়েতুর রহিম। তাঁর পিতা ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। তাঁর ভাই ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি নিজে ছিলেন বাকশাল ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। তাদের ছাড়া বাকী যে ৩জন রয়েছেন আপিল বিভাগে তারাও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ছিলেন। এজন্য সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী লীগ শাখাই বলা হয়ে থাকে আপিল বিভাগকে। তারা সকলেই ২০০৫ সালের ২৩ মে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের বিরোধীতা করেছিলেন এবং প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তারাই এখন এটাকে কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।
একটি বিষয় এখানে স্মরণীয়। সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার রেকর্ড কখনো তামাদি হয় না। ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টে নজিরবিহীন তাণ্ডব ও সন্ত্রাসে
র ঘটনাটি একটু স্মরণ করতে চাই। এই সন্ত্রাসে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম, ইনায়েতুর রহিমরা। তাদের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যে সেদিন প্রধান বিচারপতির এজলাস তছনছ করা হয়েছিল। ছুড়ে ফেলা হয়েছিল প্রধান বিচারপতির চেয়ার। এলজাসের বারান্দায় রাখা ফুলে টব গুলো দোতলা থেকে নিচে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল।
কেন এই নজিরবিহীন সন্ত্রাস সেটাও একটু জানা প্রয়োজন। নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানোর কারণ ছিল, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের একটি আদেশ। এই আদেশটি তাদের অপছন্দ হয়েছিল। চাহিদার বিপরীতে আদেশ হওয়ায় তাণ্ডবের ঘটনা ঘটিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আওয়ামী আইনজীবীরা।
কি আদেশ দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি তখন, যাতে এমন তাণ্ডব ঘটানো হয়েছিল প্রতিবাদে?
ঘটনাটি ছিল ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রীট মামলাকে কেন্দ্র করে। রীট মামলাটি হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ শুনানী হচ্ছিল। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপক্ষ মনে করেছিল এই বেঞ্চে ন্যায় বিচার পাবে না। তাই অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতির বরাবরে একটি আবেদন জানিয়ে ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। এই রেওয়াজ সুপিমকোর্টে প্রচলিত আছে। কোন পক্ষ ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়ে থাকেন বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। সেদিনও রেওয়াজ অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতির বরাবরে আবেদন জানিয়েছিলেন। এতে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চকে রীট আবেদনটি শুনানী করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ যখন প্রধান বিচারপতির নির্দেশনাটি উপস্থিত আইনজীবীদের জানিয়ে দেন, তখন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন আওয়ামী আইনজীবীরা। তাৎক্ষণিক ক্ষেপে গিয়ে রোকন উদ্দিন মাহমুদ চিৎকার করে বলে উঠেন-ধর মোদাচ্ছিরকে। এরপরই শুরু হয়েছিল আওয়ামী আইনজীবীদের তাণ্ডব। সবাই তখন সন্ত্রাসে মেতে উঠেন। একদল আইনজীবী প্রধান বিচারপতির এজলাসের দিকে ছুটে যান। তখন সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন এজলাসে ছিলেন না। তাঁকে তারা পেলে হয়ত আরো বড় অঘটনের ঘটনা সেদিন ঘটার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য। এই তাণ্ডবের ঘটনাকে আড়াল করতে না পেরে ভারতপন্থি প্রথম আলো পরের দিন লাল কালিতে শিরোনাম করেছিল, প্রধান বিচারপতির নজির বিহীন আদেশ। পত্রিকাটি প্রধান বিচারপতিকে সেদিন দায়ী করে তাণ্ডবের ঘটনাকে হাল্কা করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। যদিও এর একদিন পরই দৈনিক আমার দেশ-এ সার্টিফাইট কপিসহ উল্লেখ করে রিপোর্ট করেছিলাম, ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম, ড কামাল হোসেন তাদের মামলা চলাকালীন কিভাবে প্রধান বিচারপতির কাছে অনাস্থার আবেদন জানিয়ে বেঞ্চ বদল করিয়েছিলেন। প্রতিবেদনটির শিরোনাম করা হয়েছিল, অনাস্থা জানিয়ে শুনানী স্থগিত করায় ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমির নিজেই নজির হয়ে আছেন।
উপরে উল্লেখ করেছি, ভাংচুর সন্ত্রাসের ঘটনা বা ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। তখনকার প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকরা সন্ত্রাসের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভবিষ্যতে ন্যায় বিচারে অটল কোন প্রধান বিচারপতি হয়ত একদিন এ আসনে বসবেন। তখন এই ফৌজদারি ঘটনার বিচার হয়ত দেশবাসীও দেখতে পাবে। সেদিনের ঘটনায় দুটি অপরাধের বিচার দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ। একটি অপরাধ হচ্ছে প্রধান বিচারপতির এজলাসসহ আদালতের বিভিন্ন কক্ষে ভাংচুরের অভিযোগে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা। আরেকটি অপরাধ হচ্ছে আদালতে নজিরবিহীন আক্রমণ চালিয়ে আদালত অবমাননারা করা। এই দুই অভিযোগে সেদিনের সন্ত্রাসীদের বিচার দাবী থাকবে ন্যায় বিচার প্রত্যাশীদের।
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক