- মিনার রশীদ ০১ মে ২০২০
সিরিয়ার তিন বছরের যুদ্ধাহত সেই শিশুটির কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বলেছিল, ‘আমি আল্লাহকে গিয়ে সব বলে দেবো।’ তার এই কথাটিতে বিশ্ববাসীর ওপর প্রচণ্ড অভিমান ও ক্ষোভ ঝরে পড়েছে। এই অভিমান ও ক্ষোভ শুধু জালিমদের বিরুদ্ধেই ছিল না। তা ছিল এই সব জুলুম ও অবিচার সহ্য করা সমগ্র মানব গোষ্ঠীর ওপর।
করোনাক্রান্ত বিশ্ববাসীর আতঙ্কিত ও ভীত বিহ্বল চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, ও সত্যি সত্যি আল্লাহকে সব বলে দিয়েছে। মর্ত্যবাসীর মনে একটি ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে, গণমৃত্যু শুধু সিরিয়ায় আসবে, শুধু ইরাকে আসবে, শুধু ইরানে আসবে, শুধু ইয়েমেনে আসবে কিংবা অন্যান্য মুসলিম নামধারী দেশগুলোতেই আসবে। কিন্তু কোভিড-১৯ সেই ধারণা বদলে দিয়েছে। প্রকৃতি থেকে এমন একটি পদক্ষেপের জন্য অনেকেই অপেক্ষমাণ ছিল। কিন্তু বিষয়টি হয়ে পড়েছে- গাছের আগা পর্যন্ত পানি উঠে গেলে দেখি কাক কোথায় বসে- শিয়ালের সেই কামনার মতো।
গত কয়েক মাস ধরে বিশ্বের প্রায় আট’শ কোটি মানুষের মৃত্যু আতঙ্ক কেন যেন উপরের ধারণাটি পোক্ত করেছে। ওই শিশুটির ফরিয়াদ ছিল সম্ভবত আট’শ কোটি মানুষের বিরুদ্ধেই। এটা ঠিক যে এই আট’শ কোটির সবাই অপরাধী নয়। কেউ কেউ অপরাধ করছে, কিন্তু বাকিরা সহ্য করেছে! একজন ম্যানুফেকচারার যখন দেখবেন তার প্রডাক্ট দিয়ে কাক্সিক্ষত কাজটি হচ্ছে না বরং উল্টো হচ্ছে তখন সেই ম্যানুফেকচারের মনে প্রডাক্ট বন্ধ বা ধ্বংস করার চিন্তা আসতেই পারে! জানি না মানবজাতি তার ম্যানুফ্যাকচারের পক্ষ থেকে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছে কি না!
মানবজাতির কিছু সদস্যের অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, অহঙ্কার এবং ঔদ্ধত্য সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ওই সব অমানবিকতা ও ঔদ্ধত্যের যেমন বৈশ্বিক একটি চেহারা রয়েছে তেমনি রয়েছে এই রাষ্ট্রীয় বা স্থানীয় চেহারা।
কোভিড-১৯ না এলে পুরো উন্মাদ ট্রাম্প এবং অর্ধ উন্মাদ মোদিরা একটি পারমাণবিক যুদ্ধ বাধিয়ে দিতো। কাজেই প্রকৃতির মালিক তার নেচারাল প্রটেকশনের উপায় হিসাবে এই করোনার করুণা (?) দিয়ে দুনিয়াবাসীকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছেন? কারণ ট্রাম্প ইরানকে আক্রমণ করলে এবং মোদি পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে তা খুব দ্রুতগতিতে পারমাণবিক সংঘর্ষে রূপ নিতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ট্রাম্পের মতো উন্মাদের টেবিলে আছে হাজার হাজার পারমাণবিক বোমার বাটন! আরেক অর্ধ উন্মাদের হাতে কয়েক শত পারমাণবিক বোমা। যে পৃথিবী একটি করোনার আঘাতে নুইয়ে পড়েছে সেই পৃথিবী পারমাণবিক হিংস্রতার আঘাত কীভাবে সইত? এই হুঁশ জাগাতেই কি করোনার আবির্ভাব?
করোনা সারা বিশ্বের টনক নাড়িয়ে দিলেও এ দেশের বেয়াক্কলদের হুঁশটি সময়মতো জাগাতে পারেনি। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী এবং জি-সেভেনভুক্ত দেশ ইতালির প্রেসিডেন্ট আকাশের পানে চেয়ে যখন বলেন, এখন উপরওয়ালার সাহায্য ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। ওই সময়েও আমাদের ডন কিহোতেরূপী গবুচন্দ্ররা কোভিড-১৯ কে যথারীতি মাসল দেখিয়ে চলেছেন। আমরা নাকি কোভিড-১৯ এর চেয়েও মহাশক্তিশালী! কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের প্রস্তুতি নাকি বিশ্বের যে কোনো উন্নত দেশের চেয়ে ভালো। গল্পের ডন কিহোতে যেমন ভাঙা বর্ম এবং ভাঙা তলোয়ার নিয়ে উইন্ড মিলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তেমনি আমাদের এসব ডন কিহোতেরা যথাযথ পিপিই (পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) ছাড়াই ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন। সময়ে দেখা গেল এই গবুরা যত চাপাবাজি করেছেন তার সবই বোগাস! সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়ার সময় টের পেলেন লাইফ জ্যাকেট সব ফোটা/অকেজো!
দেশকে সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, নিউইয়র্ক, প্যারিস বানানোর মাজেজা দেশবাসী এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে! যে সুশীলরা এত দিন সরকারের উন্নয়নের চাপাবাজিকে প্রমোট করেছে, তারাও আজ ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি শুরু করে দিয়েছেন। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এমন লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে যে করোনা না এলেও নন-করোনাতেই দেশবাসীর মরার সুবন্দোবস্ত পাকা হয়ে গেছে!
এই ফেরেশতাতুল্য শিশুটির সেই ফরিয়াদের তালিকা থেকে বাংলাদেশও বাদ পড়েনি। ওর পিছে পিছে গিয়ে ফরিয়াদ করেছে নারায়ণগঞ্জের সাতজন- যাদের র্যাবের বিশেষ মিশনে ওপারে চলে যেতে হয়েছিল। প্রথমে যাওয়ার কথা ছিল একজনের- পরে মুখ বন্ধ করতে একে একে আরও ছয়জনকে পাঠানো হয়েছে। খুনিদের সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার পরেও (লাশের পেট কেটে ইট দিয়ে বাঁধার পরেও ) সেই লাশগুলো শীতলক্ষ্যায় কেন ভেসে ওঠেছিল- সেটাও ছিল এক বিস্ময়ের ব্যাপার! বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবার অবকাশ আমাদের হয়নি। ফেনীর পরোপকারী ডাক্তারকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যার নায়ক এবং মন্ত্রীর জামাতাও এই সাত খুনের ঘটনায় হাতে নাতে ধরা খেয়েছে!
কে একে ধরিয়েছে?
এরা তো সব ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল!
এর পরও এই জালিম খুনিদের হুঁশ হয় না। যৎসামান্য বেতন এবং কিছু সুযোগ সুবিধার কারণে এদের কেউ কেউ রীতিমতো পশুতে পরিণত হয়েছে। এরকম শত শত এবং হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা গুমের কারণে নারী ও শিশুদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে এ দেশের বাতাস। গুম হওয়া মানুষগুলোর স্বজনদের আহাজারি নিঃসন্দেহে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সুতরাং এই নতুন জালিমরাও একদিন ধরা খাবে- মজলুমদের অভিশাপে এদের অনাগত বংশধররা এর প্রায়শ্চিত্য ভুগতে থাকবে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমরা কেউ কেউ এই প্রকৃতির লীলাখেলা দেখতে পেলেও সেই প্রকৃতির স্রষ্টা বা নিয়ন্ত্রকের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারি না।
রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে অনেক তরুণকে ধরে এনে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে- তার পর ক্রসফায়ারের গল্প সাজানো হয়েছে। এদের মধ্যে ভাগ্যবানদের লাশ আত্মীয়স্বজনরা পেয়েছেন। হতভাগাদের লাশটিও স্বজনদের কাছে পৌঁছেনি। পুলিশি হেফাজতে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে অনেক তরতাজা যুবককে। জীবনের তরে অনেকের পুরুষত্ব নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এগুলো করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এই অনাচারের মূল বিচারটি পরকালের জন্য নির্ধারিত থাকলেও দু-একটা নমুনা উপরওয়ালা সম্ভবত এই দুনিয়াতেই প্রদর্শন করেছেন।
এসব দুরাচার ও অনাচারের প্রধান সহযোগী ছিল যে পুলিশ বাহিনী তাদের একজন নিজের আদরের কন্যার হাতে সস্ত্রীক নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন যে ঘটনা মানব ইতিহাসে খুব বেশি ঘটেনি। ঘুমের ওষুধের নেশা থেকে দু’নয়ন খুলে দেখেন তাদের গলা নিজ হাতে কাটছে তাদেরই অতি আদরের কন্যা! তাকে বাধা দেয়ার ন্যূনতম শক্তিটুকু তাদের অবশিষ্ট ছিল না। এর মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগত থেকে আমাদের কাছে যে সিগনাল পৌঁছাতে চাওয়া হয়েছিল মনে হয় তা আমরা ধরতে পারিনি! ঊর্ধ্বজগত থেকে আসে (কেউ কেউ এটাকে বলেন প্রকৃতি) সাধারণত কালেক্টিভ শাস্তি। ধরে নিলাম ঐশীর বাবা কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তবে মেয়েকে যে পয়সা হাত খরচের জন্য দিতেন তা নিজের বেতনের কয়েকগুণ ছিল! নিজের বাহিনীতে বা ডিপার্টমেন্টে অন্যায় কাজ হতে দেখলে সেই অন্যায় কাজে জড়িত না হলেও সে সমানভাবে অপরাধী। কারণ অন্যায় কাজ সঙ্ঘটিত হতে দেখেও বাধা দেয়নি। তা প্রতিহত বা বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা বা চিন্তাও করেনি।
সব পুলিশের পাপের যৎসামান্য প্রায়শ্চিত্য ভুগে গেছেন ঐশীর বাবা-মা। এগুলো করেন সেই আল্লাহ, যিনি তার অসীম কুদরতে মুজিববর্ষকে করোনাবর্ষে রূপান্তরিত করে ফেলেন।
মানুষকে সতর্ক করার জন্য যে আলেম সমাজকে পাঠানো হয়েছে, আমাদের দেশে তারাও সুবিধাবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সত্য কথাটি জানাতে তারা ভয় পাচ্ছেন। ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটি না বলে কাকে কিসের জননী বা জনক উপাধি দেয়া হবে সেই গবেষণায় নিয়োজিত হয়ে গেছেন। নিজেদের একান্ত বিশ্বাসের বিপরীতে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া করতেও কারো কারো অসুবিধা হয় না। এরাও পড়ে গেছেন দারুণ মুসিবতে। ‘রাজাকার নন’ এটির প্রমাণ রাখতে গিয়ে ঈমানটাই বিলকুল খুঁইয়ে ফেলছেন।
আল্লাহর ঘরের ইমাম হয়ে ক্ষমতাধর মহিলাদ্বয়কে চেয়ারে বসিয়ে নিজেরা তাদের পায়ের কাছে বসে পড়েন! এরা জনগণকে বোঝান রিজিকের মালিক আল্লাহ, কিন্তু নিজেদের রিজিকের মালিক হিসাবে গণ্য করেন ইউএনও / এসি ল্যান্ড/এমপি/মন্ত্রীদেরকে। যাদের বানানো হয়েছে জাতির রাহবার তারা নিজেদের মাদরাসার সামান্য অনুদান কিংবা একটি কাগুজে সনদ পেয়ে সব অনাচার, অবিচার ভুলে জালিমের পেছনে কাতারবন্দী হয়ে পড়েন!
কারো কারো মনে হতে পারে, মানুষের দুর্গতি নিয়ে নিষ্ঠুর রাজনীতি করছি। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের আট’শ কোটি মানুষের মতো প্রতি মুহূর্তেই আমিও এর একটি প্রতিষেধক বা কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারের খবরের অপেক্ষায় আছি। আমি এটাও বিশ্বাস করি, সেই ওষুধ বা প্রতিকার কোনো অলৌকিক উপায়ে আসবে না। এই ভাইরাসকে প্রাকৃতিক উপায়ে দুর্বল তিনিই করে দিতে পারেন যিনি এই ভাইরাসসহ সব প্রাণীকুলকে সৃষ্টি করেছেন, এখন তিনিই মানুষের মগজে বুদ্ধি দিয়ে দেবেন এই ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের!
এই জ্ঞান তিনি তাদেরই দেবেন যারা এ ব্যাপারে প্রচেষ্টায় এগিয়ে থাকবে। কাজেই বিজ্ঞানের সাথে আমার বিশ্বাস কখনোই টক্কর খাবে না।
এই আর্টিকেলে যে কথাটি বলতে চেয়েছি তা হলো- আমরা এক দিকে কাপুরুষতা, ভীরুতা ও সুবিধাবাদিতা এবং অন্য দিকে ঔদ্ধত্যের মাধ্যমে ঊর্ধজগতের যে ক্ষোভটি বাড়িয়েছি তা সম্যক উপলব্ধি করে, একান্ত মনে অনুতপ্ত হয়ে সেই কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। হয়তোবা এই ম্যাসেজটি দিতেই কোভিড-১৯ এর আবির্ভাব।