ফরহাদ মজহার 20 November 2022
সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে
কুতর্কের দোকান খুলিসনে নে আর
মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার …
ডিজিটাল টেকনলজি সহজলভ্য হবার কারণে লেখালিখি শিশুর হাতের ঝুনঝুনি বাজানোর মতো সহজ ও শিশুতোষ হয়েছে। জুকারবার্গ রমরমা ফেইসবুকের দোকান খুলেছেন। শিশুতোষ হর্ষে ঝুনঝুনির দোকান খুলতে পারা তাই যারপরনাই সহজ হয়েছে। শব্দ বাজাই, কথা বাজাই, ‘লাইক’ মারামারি হয়। ‘ইমো’ চালাচালি হয়। ভাল লাগে। নিজেকে খুব ইম্পর্টেন্ট মনে হয়।
গুটেনবার্গ টেকনলজির ফলে মুখস্থ ভাষা ছাপাখানার অক্ষর হিশাবে হাজির হয়। ভাষা সরল রেখায় একদিক থেকে আরেকদিকে ছাপা হয়, ফলে ভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ধরণ যেমন বদলে গিয়েছে, তেমনি আমরাও বদলে গিয়েছি। আমাদের ইন্দ্রিয় ব্যবহারের মৌলিক বদল ঘটেছে। আমরা চোখ দিয়ে শুনি (অর্থাৎ পড়ি), যেহেতু কানের ব্যবহার নাই, তাই অন্যের কথা শোনারও দরকার বোধ করি না। শিক্ষিতদের এই ভয়ংকর দোষ নতুন কোন খবর না। নিরক্ষরের এই দোষ নাই, কারণ অন্যের সঙ্গে কথা বলার মধ্য দিয়েই তার জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। সক্রেটিস যেমন। নিরক্ষরের জগত আমরা আর বুঝিনা বলে ফকির, দরবেশ, পীর, মুর্শিদদের শক্তি সম্পর্কেও শিক্ষিত্ শ্রেণী কোন ধারণা করতে পারে না।
বই যেহেতু কথা বলতে পারে না, তাই কিছু না বুঝলে লেখককে প্রশ্নও করা যায় না। আমরা ভুলে যাই ছাপার অক্ষর কোন অর্থ পয়দা করে না। জীবিত মানুষই অর্থ উৎপাদনে সক্ষম। তারপরও এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা না যে ছাপা খানার যুগে আমরা ‘যুক্তিবিদ্যা’ শিখেছি, কারণ বাক্যের বিভিন্ন অংশ ‘যুক্ত’ করে অর্থ বের করবার বিদ্যা আয়ত্ব করা সহজ ব্যাপার না। বলা হয় প্রিন্টিং টেকনলজির ফলেই আধুনিক কালে যুক্তি, Reason, Rationality-ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, তথাকথিত যুক্তিবাদী আধুনিক মানুষ এবং আধুনিকতারও জন্ম হয়েছে।
ডিজিটাল টেকনলজির সুফল ও কুফলের মূল্যায়ন চলছে। নামতা রপ্ত করা বা গণিতের পরিশ্রম থেকে মস্তিষ্ক মুক্তি পেয়েছে, এটা আমরা বুঝি। এই কাজ এখন কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট করে। ফলে যারা কম্পিউটারের জগতে শিক্ষিত না তারা নতুন করে ‘অশিক্ষিত’ হয়েছে। এরপর এসেছেন জুকারবার্গ। রাতারাতি জুকারবার্গ সব্বাইকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন ‘What’s On Your Mind?’ — আমরাও রাতারাতি বিরাট বিরাট বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ হয়ে গেলাম, জুকারবার্গ বুদ্ধিজীবী আর দার্শনিকে এলসিডি স্ক্রিন পূর্ণ করে দিলেন। এখন চিন্তা করতে শেখা, চিন্তা রপ্ত করা বা চর্চার দরকার নাই। আমরা কুতর্ক করতে পারলেই দার্শনিক হয়ে গেলাম। ফেইসবুকে দোকান খুলে বসে পড়লেই হোল। বিশ্ব জগতের সমস্ত সমস্যার সমাধান ফেইসবুকাররা করতে শুরু করলেন।
চিন্তা করতে পারা আর বিপরীতে বাগাড়ম্বর আর বকোয়াজি আলাদা — এটা পুরানা কথা, পুরানা সত্য। আমরা যাকে অলংকারশাস্ত্র বলি, আর পাশ্চাত্যে Rhetoric –সেই শাস্ত্র একান্তই দর্শনের বিষয়। কিন্তু বাগাড়ম্বর, বকোয়াজি অনর্থক কুতর্ক ইত্যাদি চিন্তার বিকাশের জন্য বা চিন্তাশীলতা চর্চার জন্য ক্ষতিকর। তাই অভিযোগ উঠেছে ফেইসবুক তরুণদের চিন্তাশূন্য স্টুপিডে পরিণত করছে। বকোয়াজি বা বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে চিন্তার স্বাদ নেবার জন্য মানুষের আকুতি বা চাহিদা তারা মেটাতে পারছে না।
সাহিত্যে চিন্তা থাকে, যেমন ধর্মতত্ত্বেও থাকে — কিন্তু চিন্তার নিজের স্বরূপ আছে। সেটা স্রেফ সাহিত্য না। বকোয়াজি, ফাতরামি, বাগাড়ম্বর, কুতর্ক ইত্যাদির সাহিত্যিক মূল্য কেউ অস্বীকার করেছেন দেখি নি। চিন্তাশূন্য কুতর্কেও আমোদ ও বিনোদন আছে। একটা বয়স পর্যন্ত কিশোর কিশোরি বালক বালিকাদের বকোয়াজি, কুতর্ক ভাল। কিন্তু সেটা যদি পার্মানেন্ট দোকান হয়ে যায় তাকে বলা ‘জুকারবার্গিওসিস’।
এটা একটা অসুখের নাম। চিকিৎসা করতে হয়।
শেষে তাহলে ‘Of the Vanity of Words’ থেকে একটা উদ্ধৃতি সহজ বাংলায় বুঝিয়ে শেষ করি। মূল উদ্ধৃতি কমেন্টে দেখুন। বকোয়াজগিরি নতুন কোন পেশা না। যেমন, অনেকে আত্মবিশ্বাসের অভাবে মুখে রঙ মাখেন, উদ্দেশ্য নিজের চেহারা লুকিয়ে রাখা। কিন্তু সেটা বড় কোন ক্ষতির কারন না। ক্ষতি অতোটুকুই যে তাঁর সহজ, স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক বদন দর্শনের আনন্দ থেকে আমরা বঞ্চিত থাকি। যা দেখি তা কৃত্রিম ।
কিন্তু লেখালিখির ক্ষেত্রে বকোয়াজগিরি বা কুতর্ক নিন্দনীয় — এটাও মুখোশ দিয়ে নিজের চেহারা ঢেকে রাখার অক্ষম চেষ্টা। সেই ক্ষেত্রে চিন্তাহীনতা, চিন্তাশূন্যতা, চিন্তার দৈন্যতা ইত্যাদি বকোয়াজি বা অনর্থক তর্ক দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়। এটা মেকাপ করা মুখের মতো আমাদের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপার না। মোটেও সেই রকম নয়। বরং আমাদের পর্যালোচনা বা বিচারবুদ্ধির সঙ্গে প্রতারণা। চিন্তার সামাজিক চর্চা এতে বাধাগ্রস্ত হয়। শুধু তাই না ,বাস্তবতা বা সত্য উন্মোচনের জন্য চিন্তার যে আকুতি ও নিষ্ঠা তাকে বকোয়াজগিরি ও কুতর্কের দোকান দূষিত করে।
কথাটা আমার না। ফকির লালন শাহেরও না। বলেছেন: Michel de Montaign ।