সামরিকতন্ত্র, এ যেন মহাকালের অনাদি রূপ


আমরা অসামরিক লোকেরা প্রায়ই এ কথা ভেবে অবাক হই, যখন শুনি আধুনিককালের প্রায় সব সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন জমানার গাওগেমেলার যুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হয়। ৩৩১ সালের ১ অক্টোবর পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসের আড়াই লাখ সেনাবাহিনীর সামনে মাত্র ৪৭ হাজার বাহিনী নিয়ে তরুণ আলেকজান্ডার, যখন তিনি দিগ্বিজয়ী হননি কিংবা সম্রাটরূপে পরিচিতির বদলে তার পরিচয় ছিল কেবলই মেসিডোনিয়া নামক ক্ষুদ্র একটি ইউরোপীয় রাজ্যের শাসক, দুনিয়া তার কর্মকাণ্ডকে পাগলামোর ছলে সদলবলে আত্মহত্যার যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছিল। কারণ তৎকালীন দুনিয়ার এক নম্বর সুপার পাওয়ার পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তো দূরের কথা, তাদের কোনো হুকুম নির্দেশ অথবা সুপারিশ এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো রাষ্ট্রের ছিল না।

এখন প্রশ্ন হলো আলেকজান্ডার ছিলেন আইরন এজ বলে খ্যাত লৌহযুগের সেনাপতি। অন্য দিকে পারস্য যুদ্ধ যার অন্য সাংস্কৃতিক নাম ছিল ভিডিও গেম ওয়ার, এই দুইয়ের কৌশল এক এবং অভিন্ন হয় কী করে? একইভাবে মার্কিনিরা যখন ১৯৫৫ সালে ভিয়েতনাম আক্রমণ করে তখন ভিয়েতনামি যোদ্ধারা আজ থেকে দুই হাজার ৬০০ বছর আগে রচিত যুদ্ধসংক্রান্ত একটি বইয়ের সূত্রগুলো প্রয়োগ করে পৃথিবীর এক নম্বর সুপার পাওয়ার মার্কিন বাহিনীকে চরমভাবে পরাজিত ও অপমানিত করে ভিয়েতনাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। প্রাচীন চীনের এক মহাবীর যাকে কিনা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মিলিটারি জিনিয়াসদের মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য করা হয়, সেই জেনারেল সান ঝু রচিত ‘আর্ট অব ওয়্যার’ বইটি কেন এখনো সারা দুনিয়ার সামরিক স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগারে ব্যবহৃত হয় তা জানার জন্যও আমি মাঝে মধ্যে নিদারুণ কৌতূহল অনুভব করি।

রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নাকি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্রীয় বেতনভুক সেনাবাহিনী প্রথা চালু করেছিল তুর্কি অটোমানরা যার নাম ছিল জেনিসারি বাহিনী। এর আগে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যুদ্ধ উপলক্ষে সৈন্যবাহিনী গড়তো এবং যুদ্ধ শেষে তা ভেঙে দেয়া হতো। বড় বড় রাজ্য ও সাম্রাজ্য সারা বছর সেনাবাহিনী রাখত বটে তবে কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে তাদের কোনো বেতনভাতা দেয়া হতো না। একেকজন সেনাপতিকে তার পদ-পদবি এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সফলতার ওপর ভিত্তি করে জমিদারি দেয়া হতো। সেই আয় দিয়ে নির্দিষ্টসংখ্যক ঘোড়সওয়ার, পদাতিক, তীরন্দাজ ইত্যাদি শিরোনামে সেনাবাহিনী পুষতে অনুমতি দেয়া হতো, যারা রাজার নির্দেশে যুদ্ধ করতে বাধ্য হতো।

সামরিক বাহিনীর জন্য জনবিচ্ছিন্ন জীবন, কঠোর অনুশীলন, পরিমিত ও প্রয়োজনীয় আহার এবং দুর্নীতিমুক্ত নির্দিষ্ট আয়-রোজগার যারা নিশ্চিত করতে পেরেছেন তারাই সেনাবাহিনী দ্বারা নিজেরা উপকৃত হয়েছেন এবং দেশ-জাতির ভাগ্যের উন্নয়ন সাধন করে ইতিহাসে স্থান করে নিতে পেরেছেন। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। হজরত ওমর রা:-এর জমানায় সেনাপতি আমর ইবনুল আস যখন মিসর জয় করলেন তখন সেখানে একদল সেনাবাহিনী নিয়মিত রাখা দরকার বলে খলিফার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। খলিফা ওমর সে অনুমতি দিলেন; তবে সেনাবাহিনীর জন্য ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণ এবং সেই ক্যান্টনমেন্ট যেন শহর বন্দর রাজধানী থেকে বহু দূরে তৈরি করা হয় সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা পাঠালেন। খলিফা ওমরের জমানায় সর্বপ্রথম যে ক্যান্টেনমেন্টটি নির্মিত হয়েছিল মিসরে সেটিই এখনকার মিসরের রাজধানী কায়রো, যা তৎকালীন জমানায় বিরানভূমি ছিল।

দ্বিতীয় ঘটনাটিও হজরত ওমর রা:-এর সময়ের। সেনাপতি খালেদ বিন ওয়ালিদ তার অসামান্য বীরত্ব, প্রতিটি যুদ্ধে বিস্ময়কর বিজয় এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণে রীতিমতো জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হলেন। ঠিক এই সময়ে জনৈক কবি সেনাপতিকে নিয়ে নাতিদীর্ঘ এক কবিতা রচনা করলেন এবং সেনাপতি খুশি হয়ে যুদ্ধ তহবিল থেকে বড় একটা অনুদান কবিকে দিলেন। খলিফা সেনাপতিকে এর কারণ দর্শাতে বললেন এবং সেনাপতির জবাব সন্তোষজনক না হলে তিনি কেবল সেনাপতিকে পদচ্যুতই করবেন না বরং একজন সাধারণ সিপাহিরূপে তাকে নতুন সেনাপতির অধীনে যুদ্ধ করতে বাধ্য করলেন। খলিফা ওমর এত বড় সিদ্ধান্ত তখন নিয়েছিলেন যখন মুসলিম বাহিনী সিরিয়াতে যুদ্ধরত ছিল না।

উল্লিখিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি যে, সেনাবাহিনীর মতো স্পর্শকাতর বিষয়াদি কঠোরতার সাথে পরিচালনার জন্য কতটা সততা, ব্যক্তিত্ব, আধ্যাত্মিকতা এবং সাহসের প্রয়োজন পড়ে। রাজা যদি নিজে রাজভাণ্ডার লুট করেন, প্রজাদের বধূ-কন্যা হরণ করেন এবং রাজ্যে অবিচার-অনাচার ও অত্যাচারকে ভাত-মাছের মতো সাধারণ ঘটনা বানিয়ে ফেলেন তাহলে রাজার সেনাবাহিনী তাদের মালিকের সাথে পাল্লা দিয়ে কতটা খারাপ হতে পারে তা আমরা বাংলার জমিনে আফ্রিকীয় ক্রীতদাস তথা মামলুক যুগে দেখেছি। অন্য দিকে বাংলার সেনাবাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস দেখেছি আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং শায়েস্তা খানের জমানায়।

নিবন্ধের শুরুতে যে কজন ভুবনবিখ্যাত ‘সেনাপতি কাম রাজা’র নাম বলেছি তারা সবাই প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো- কেবল সামরিক প্রতিভাসম্পন্ন লোকজনকে সেনাসদস্যরূপে মনোনীত করেন। যোগ্যদের কঠোর পরীক্ষা, হাজারো অনুশীলন, যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতা এবং যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে পাণ্ডিত্যের ওপর ভিত্তি করে পদোন্নতি দিতেন। নিজের ছেলে-সন্তান, ভাই বেরাদর বা আত্মীয়রা যোগ্য না হলে সেনাবাহিনীর ধারেকাছেও ভিড়তে দিতেন না। সেনা সদস্যদেরকে রাজধানী, রাজদরবার, রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতেন। ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিনোদন, বিলাসিতা, অধিক পানাহার তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ, ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়া, বাজারে গমন ইত্যাদি ব্যাপারেও মারাত্মক কড়াকড়ি ছিল। কেবল যুদ্ধজয়ের পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লুটপাট, নারী ধর্ষণের অনুমতি ছিল। কিন্তু লুটপাটের অর্থ সেনা কমান্ডারের মাধ্যমে রাজকোষে জমা দিতে হতো। ফলে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট যুদ্ধ করার জন্য পাগলপারা হয়ে থাকত।

একটি ক্ষুদ্র সেনাদল কিভাবে একটি সাম্রাজ্য গঠনে ভূমিকা রাখে আবার পৃথিবীর বৃহত্তম সেনাবাহিনী কিভাবে ক্ষুদ্রতম একটি সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সম্রাটকে যুদ্ধক্ষেত্রে কবরে পাঠিয়ে দেয়, সেই কাহিনী বলে আজকের নিবন্ধটি শেষ করব। ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস তার বইয়ে পারস্য সম্রাট মহামতি সাইরাসের উত্থানপর্ব এবং মৃত্যুপর্বে নাটকীয় যে দুটো কাহিনী বলেছেন তা আজকের নিবন্ধের পাঠকদের কাছে বর্ণনা করে প্রসঙ্গের ইতি টানছি।

মহামতি সাইরাসকে বলা হয় ‘পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সম্রাট’ যিনি সবচেয়ে বড় একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং সেই প্রাচীন জমানাতেও ন্যায়বিচার, সুশাসন, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে যে অনবদ্য নজির স্থাপন করেছেন এর দ্বিতীয় নজির নেই। অধিকন্তু তার প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্য যেমন হাজার বছর টিকে ছিল, তেমনি তার উত্তরাধিকারীরাও সুদীর্ঘ সময় ধরে শাসন করার নজির স্থাপন করেছিলেন। সাইরাসের বিজয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী রাজ্য লিডিয়া দখল। তিনি কেবল লিডিয়া অর্থাৎ আজকের তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চল তথা উসাক, মানিসা, ইজমিরসহ পশ্চিমা এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূমিই দখল করলেন না, বরং লিডিয়ার সম্রাট ক্রেসাসকে নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন।

সাইরাস লিডিয়া জয় করলেন- লিডিয়ার সাবেক সম্রাট তার কর্মচারী নিযুক্ত হলেন; কিন্তু তার পরও লিডিয়ার সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিট অব্যাহত গেরিলা যুদ্ধ দ্বারা সাইরাসকে আতঙ্কিত করে তুলল। সাইরাস লিডিয়া সম্রাটের পরামর্শ চাইলে ক্রেসাস উত্তর দিলেন, গেরিলা যোদ্ধাদের পেটুক ও সঙ্গীতপ্রিয় করে তুলতে হবে। তাদের হাতে বাদ্যযন্ত্র, পায়ে নরম স্যান্ডেল এবং গায়ে আরামদায়ক পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে তারা যুদ্ধ ভুলে লোভী-অলস-দুর্নীতিপ্রবণ এবং কলহপ্রিয় হয়ে পড়বে। সাইরাস তখন যুদ্ধপ্রবণ এলাকা ত্যাগ করে সেখানে সঙ্গীতশিল্পী ও নর্তকী পাঠালেন। নামমাত্র মূল্যে উৎকৃষ্ট বাদ্যযন্ত্র, রেশমি কাপড় এবং নরম স্যান্ডেল ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে গেরিলাদের কাছে পৌঁছে দিলেন। যুদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলোতে সুন্দরী দাসী, খাদ্য ও মদভর্তি যানবাহন পরিত্যক্ত বা মালিকানাবিহীন অবস্থায় দেখা গেল যা হাসিলের জন্য সেনারা যুদ্ধ ফেলে নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি ও দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত আরম্ভ করল। ফলে শক্তিশালী লিডিয়া সাম্রাজ্যের গেরিলা ইউনিটটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল।

আলোচনার এই পর্যায়ে আপনাদের সাইরাসের পতন ও মৃত্যুর কাহিনী বলছি। তিনি বলতে গেলে এশিয়া ও আফ্রিকার বিরাট অংশ জয় করার পর নতুনভাবে জয় করার কোনো অঞ্চল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কারণ দূরের ও কাছের সব রাজ্যই তাকে কর দিত এবং আনুগত্য প্রকাশ করত। কিন্তু যুদ্ধপ্রিয় সাইরাস যুদ্ধের জন্য উতলা হয়ে পড়লেন এবং কার সাথে কিভাবে যুদ্ধ বাধানো যায়, সে পাঁয়তারা শুরু করলেন। তৎকালীন মধ্য এশিয়ার অর্থাৎ আজকের তুর্কমেনিস্তান-আজারবাইজান ও আফগানিস্তান এলাকার মধ্যখানে মাসাগাতাই নামের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল যার রাজা সাইরাসকে কর দিতেন। রাজা মারা গেলে তার স্ত্রী তমিরি রানী হন। এই সুযোগে সাইরাস রাজ্যটি দখলের উদ্দেশ্যে প্রথমে রানীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। রানী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে সাইরাস মাসাগাতাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। রানী তমিরি অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী একটি পত্র লিখে নিজের ক্ষুদ্রত্ব, বার্ধক্য এবং সাইরাসের সাম্রাজ্যের বিশালতা বর্ণনা করে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সাইরাস সব কিছু উপেক্ষা করে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হন।

এ অবস্থায় রানী তার রাজ্যের সমুদয় অর্থ দিয়ে দামি খাবার, মদ, বস্তু ও স্বর্ণমুদ্রাসহ বিরাট এক বহর তৈরি করেন। তারপর সৈন্যবাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দুর্বল অংশকে সেই বহরের দায়িত্ব দিয়ে পড়ন্ত বিকেলে আমুদরিয়া নদীর পাড়ে সাইরাস বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে পাঠান এবং নিরাপদ দূরত্বে শক্তিশালী আত্মঘাতী ইউনিট নিয়ে গোপনে অপেক্ষা করতে থাকেন। সাইরাসের বাহিনী গোধূলিলগ্নে রানীর ফাঁদে পা দিয়ে একটি সাজানো যুদ্ধে জয়লাভ করে অবিশ্বাস্য ধনসম্পদ-খাদ্য-পানীয় এবং নারীদের পেয়ে সারা রাত মাতলামি করে ভোররাতে মরণনিদ্রায় ঢলে পড়ে। ঠিক সেই সময় রানীর গেরিলা বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পুরো সাইরাস বাহিনীকে কচুকাটা করে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাইরাসকেও হত্যা করতে সমর্থ হয়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য