সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়লেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সাবেক ছাত্রনেতাদের অনেকে ওবায়দুল কাদেরকে লক্ষ্য করে ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলেও স্লোগান দেন। অন্যদিকে, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাককে দেখেও হৈহুল্লোড় করেছেন তারা।
গতকাল বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটে। মতবিনিময়ের জন্য ডেকে এনে কথা বলতে না দেওয়াসহ দীর্ঘদিন দলের কোনো পর্যায়ের কমিটিতে পদপদবি না পাওয়ার অসন্তোষ থেকেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ছাত্রলীগের কয়েকশ সাবেক নেতা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দোতলার সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত হন। তাদের মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, এ কে এম এনামুল হক শামীম এমপি, লিয়াকত শিকদার, মাহমুদ হাসান রিপন এমপি, সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু এমপি, এ বি এম বদিউজ্জামান সোহাগ এমপি, সিদ্দিকী নাজমুল আলম, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনসহ বিভিন্ন সময় সংগঠনের পদধারী নেতারা ছিলেন। বিপুলসংখ্যক উপস্থিতির কারণে ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সভাস্থলে আসতেও বেগ পেতে হয়েছে।
বেলা ১১টার কিছু পরে সভাস্থলে প্রবেশ করেই ওবায়দুল কাদের সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় না করেই গণমাধ্যমের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন দর্শকসারিতে থাকা সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। এতে হট্টগোল শুরু হলে ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা যায়, ‘কে, কে, থামো।’ কিন্তু এর পরও হইচই চলতে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন, ‘মতবিনিময় সভা ডেকে সংবাদ সম্মেলন করছেন কেন? তাহলে আমাদের ডাকলেন কেন? আমরা তো টিভি থেকেই আপনার বক্তব্য শুনে নিতে পারতাম। আমাদেরও তো বহু কথা আছে। আগে আমাদের কথা শুনবেন, আলোচনা করবেন, তার পর ব্রিফ করেন। তা না করে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলা শুরু করে দিলেন।’
পেছনের সারিতে বসা কয়েকজন ছাত্রনেতা তাদের দীর্ঘদিন ধরে পদবঞ্চিত হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে বলেন, সুবিধাভোগী অনুপ্রবেশকারীদের পদপদবিতে আনা হলেও সাবেক ছাত্রনেতাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কমিটি বা কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে আনা হয়নি। এখন মতবিনিময় সভায় ডেকে কথাও বলতে দেওয়া হচ্ছে না।
এক পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য দিনের মতো দীর্ঘ না করে শেষ করে দেন ওবায়দুল কাদের। এর পর তিনি মতবিনিময়স্থল ছেড়ে যাওয়ার সময় পেছনে বসা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে আওয়াজ তোলেন। তার পর অনেকেই ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে ওঠেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশেও নানা কটূক্তি করতে শুরু করেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে ওবায়দুল কাদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সপ্তম তলায় নিজের কক্ষে চলে যান। সেখানে প্রায় আধাঘণ্টা অবস্থান করে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। অন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও যার যার মতো করে চলে যান।
তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের চলে যাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের নিচতলা ও সামনের সড়কে থাকা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে স্লোগান দেন। এ অবস্থা বেশ কিছুক্ষণ চলার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
এদিকে, মতবিনিময় সভা শেষে বের হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাককেও ঘিরে ধরে কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হৈহুল্লোড় করেন। তাদের অনেকেই বলতে থাকেন, ‘উনি এখানে কেন? উনার ছেলে তো সরকারের বিরুদ্ধে (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে) পোস্ট দেয়।’ ওই পরিস্থিতিতে কয়েকজন নেতাকর্মী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দোতলা থেকে আব্দুর রাজ্জাককে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে গাড়িতে তুলে দেন
গতকালের মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। তাদের কয়েকজন ‘সাংবাদিকরা এখানে কেন’ এমন প্রশ্ন তুলে হইচই শুরু করেন। উপস্থিত কয়েকজন ক্যামেরাপারসনকে লক্ষ্য করে গালাগালসহ তাদের মারতে আসেন। এর আগে সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল আসাদ রাসেলকেও এ সময় দেখা যায়। তাঁকে শোকজের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। রাসেলকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না দেওয়ার নির্দেশও দেন তিনি। কিন্তু গতকালও ওবায়দুল কাদেরের গাড়ির সামনেই অবস্থান নিতে দেখা যায় ‘প্রটোকল বাহিনী’র সদস্য হিসেবে পরিচিত এ নেতাকে।
তভেদ ভুলে লড়াই করতে হবে: ওবায়দুল কাদের
এদিকে, গতকাল সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আগুন সন্ত্রাসের ধ্বংসলীলা আবারও শুরু হয়েছে। আজ আমাদের সব মান-অভিমান ভুলে যেতে হবে। এই নারকীয় তাণ্ডবের বিরুদ্ধে মতভেদ ভুলে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। অশুভ শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রবিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে দায়িত্ব ভাগ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কাউকে বসিয়ে রাখব না। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় সাবেক ছাত্রনেতাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হবে। মনে রাখতে হবে, এ দায়িত্ব পালনের বিষয়টি আমরা ভবিষ্যতে মূল্যায়ন করব। এটা দলের সভাপতির পক্ষ থেকে আমি আপনাদের বলছি। সংকটে যারা ঝুঁকি নেবেন, তাদের ব্যাপারে অবশ্যই আমাদের মূল্যায়ন থাকবে। আর যারা কোনো কাজ করবেন না, শুধু অফিসে এসে প্রটোকল দেবেন– এমন নেতাকর্মী আমাদের দরকার নেই।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনসহ স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক ছাত্রনেতারা।
samakal