বাংলাদেশের সরকার করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাত্র ২৫টি সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বহুজাতিক স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা ছিল, এর সঙ্গে যুক্ত হলো এই চারটি হাসপাতাল। চারটি নতুন পরীক্ষাকেন্দ্র যুক্ত হওয়ায় পরীক্ষার সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু তাতে বড় রকমের পরিবর্তন আসবে, এমন আশা করার কিছু নেই। তদুপরি ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতাল (সাবেক অ্যাপোলো), স্কয়ার হাসপাতাল ও ইউনাইটেড হাসপাতাল শুধু তাদের ভর্তি রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করবে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাইরের রোগীদের নমুনাও পরীক্ষা করতে পারবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার পরীক্ষা কিটের অভাব নেই বলা হলেও বাংলাদেশে পরীক্ষার হার এখনো জনসংখ্যার অনুপাতে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় কম। তদুপরি বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ, যেখানে সুস্থ হওয়ার চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এই হিসাব হচ্ছে সরকারি; এর বাইরে উপসর্গ নিয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের এই হিসাবে নিলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় দ্বিগুণের বেশি। সংক্রমণের মাত্রা কতটা ভয়াবহ, সেটা নারায়ণগঞ্জের হিসাবেই বোঝা যায়—গত মঙ্গলবার ১৮৪ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে ১৪০ জনের ফল পজিটিভ।
এখন পর্যন্ত ঢাকার ৯টি হাসপাতালে এবং ৬৪টি জেলাতেই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে বলে সরকারিভাবে বলা হয়ে থাকে। এগুলোর অবস্থা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের রোগীরা যেসব অভিযোগ করেছেন তার অন্যতম হচ্ছে অব্যবস্থাপনা; রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না। ‘গত ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় করোনা-আক্রান্ত ৫৮ বছরের বিকাশ সাহাকে, সেদিন ভোরেই মারা যান তিনি। অক্সিজেনের অভাব, হাসপাতালে কোনো সাহায্য না পাওয়া, অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ তার পরিবারের’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২৭ এপ্রিল ২০২০)। ঢাকার বাইরের অবস্থা বোঝার জন্য এই তথ্যই যথেষ্ট, ‘কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও পাবনা জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো জেলার হাসপাতালে আইসিইউ বেড নেই।’ (ইত্তেফাক, ২৯ এপ্রিল ২০২০)। একই সূত্রে এও জানা যাচ্ছে, দেশে করোনায় আক্রান্ত প্রতি ১৮ জন রোগীর বিপরীতে মাত্র একটি আইসিইউ রয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাঁদের এক-পঞ্চমাংশেরও যদি আইসিইউর সুবিধার দরকার হয়, তা-ও অনুপস্থিত।
এ অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর যেভাবে এগিয়ে আসার দরকার ছিল, সবাইকে চিকিৎসা দেওয়ার যে কর্তব্য ছিল, সেভাবে এগিয়ে আসেনি। যদিও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা ৯ এপ্রিল থেকে বলে এসেছেন,বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো সব ধরনের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তারা সরকারের সঙ্গে এখনো কোনো রকম ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। রোগীর খরচ, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয়—সেব বিষয়ে এখনো ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একধরনের দর-কষাকষি চলছে। যেসব হাসপাতালকে এখন অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাদের পরীক্ষার সর্বোচ্চ ফি ধরা হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ যদি কোনো বিত্তবান মনে করেন যে তিনি পরীক্ষা করাতে চান, তবে অন্য কোনো অসুখের কারণে বা অজুহাতে সেখানে ভর্তি হলেই তাঁর পরীক্ষা হবে, আইসিইউ দরকার হলে তা-ও পাবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও হবে। অন্যদিকে যাঁরা পরীক্ষা কিটের অভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনা মূল্যে পরীক্ষা করাতে চাইবেন, তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে। কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, সেটাও জানা নেই। বিত্ত এবং যোগাযোগের কারণে এখন কিছু মানুষ যে আলাদা সুবিধার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেন, সেটা একার্থে বিস্ময়কর নয়। কেননা বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্রই দীর্ঘদিন ধরেই একই অবস্থা। এই দুর্যোগে তার ব্যতিক্রম করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্র ও সরকারের। রাষ্ট্র আর সরকারের অগ্রাধিকার কোথায়, সেটা বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট। দরিদ্র নাগরিকদের জন্য শনাক্তকরণ কিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
গত এক মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জনগণের কষ্টের অর্থে পরিচালিত সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রূপ দেখতে পেয়েছি। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেহাল, কারণ স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের স্বল্প বিনিয়োগ ও দুর্নীতি। ক্ষমতাসীন, এলিট, বিত্তশালীরা নির্ভর করেছেন প্রাইভেট সেক্টরের ওপর, বিদেশি হাসপাতালের ওপর। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রাইভেটাইজেশনের পরিণতি হচ্ছে এই অবস্থা। তিন মাসের বেশি সময় ধরে ‘আমরা প্রস্তুত’; ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী’ বলে হম্বিতম্বি করার পরে দেখা গেল যে আসলে কোনো প্রস্তুতিই নেই। হাসপাতালের প্রস্তুতি নেই, বেড নেই, আইসিইউ নেই, অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।
চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে উষ্মা, হুমকি এবং প্রচারণা চালানো হলো। তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় দেখা গেল। মাস্ক সরবরাহের ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে বিপদগ্রস্ত হলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এই নিয়ে কথা বললে চাকরিতে ওএসডি হতে হয়েছে এক চিকিৎসককে। আর অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে এই দুর্যোগে জনস্বাস্থ্য কাজে যুক্ত করার বদলে তাঁদের ইচ্ছেমতো চলতে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে এমন অভিযোগও আছে, এই বিপর্যয়ের সময়ে তারা রোগীদের ফিরিয়ে দিয়েছে।
একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন রোগীর করোনাভাইরাস পরীক্ষার বিস্ময়করভাবে পরিবর্তিত ফলাফল এসেছে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এবং শেষ পর্যন্ত সেই রোগী মাহমুদা খানমকে (৭৫) সেই হাসপাতাল থেকে তাঁর ভেন্টিলেটর খুলে সাবধানতামূলক ব্যবস্থা বা যথাযথ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা ছাড়াই আরেক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে; যেখানে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। বন্ধু জিয়া হায়দারের মায়ের এই মৃত্যুসংবাদে ব্যক্তিগতভাবে মর্মাহত হয়েছি, এর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালগুলোর যে দায়িত্বহীনতার চিত্র উঠে এসেছে, তা ভয়াবহ। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার বা তদন্ত করার যেন কোনো ব্যাপার নেই।
কয়েক সপ্তাহ আগে সরকারের পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ‘ভিআইপি, বিত্তশালী এবং দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের’ জন্য আলাদা হাসপাতাল প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার পিছিয়ে যায়। সেই সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান বিবিসিকে যুক্তি দেখিয়েছিলেন এভাবে: ‘ভালো সচ্ছল পেশেন্ট আছে না? কথা উঠেছিল তারা কোথায় ভর্তি হতে পারে? সরকারিভাবে আমরা যা করছি, সেগুলো তো আপামর জনগণের জন্য। যে শত শত মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, তাদের জন্য তো একটা ব্যবস্থা আছেই। …ধরুন একজন প্রখ্যাত শিল্পপতি, উনি হয়তো করোনার চিকিৎসায় সরকারি যে ব্যবস্থাপনাগুলো আছে, এগুলো তো সাধারণ মানের—সেখানে যেতে উনি ইতস্তত করলেন। তো উনি অ্যাপোলো (বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতাল), ইউনাইটেড বা স্কয়ারে গেলে যেন চিকিৎসা পারেন। তাঁরা টাকা দিয়েই চিকিৎসা করাবেন।’ (বিবিসি বাংলা, ২২ এপ্রিল ২০২০)।
এই বাক্যগুলো আবার পড়লেই বুঝতে পারা যাবে যে কেন আলাদা করে কেবল বেশি ফির বিনিময়ে প্রাইভেট হাসপাতালে কেবল তাঁদের রোগীদের জন্য আলাদা করে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রাজনীতি ও অধিকারের ক্ষেত্রে নাগরিকের সমতার ধারণা অনেক আগেই লুপ্ত হয়েছে, এই বিপর্যয়ের দিনে ন্যূনতম একটি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও সেই অসমতা নগ্নভাবে প্রকাশিত হলো।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো