গত দুই বছরে চার হাজার কোটি টাকার গম রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে, যার সবই নিম্নমানের এবং দামও বাজারমূল্য থেকে বেশি। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে ২০২২ সাল থেকে এই ১১ লাখ টন গম আমদানি করা হয়।
সাধন চন্দ্রের আগে খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন কামরুল ইসলাম। ২০১৫ সালে কামরুল ইসলামের সময় ব্রাজিল থেকে পোকা খাওয়া ও নিম্নমানের গম আমদানি হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক সমালোচনার পর সরকার ওই বছর গমের প্রোটিনের সর্বনিম্ন মান বা বিনির্দেশ সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ করে। কিন্তু সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালে আবারও ওই বিনির্দেশ কমিয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ করা হয়। অর্থাৎ নিম্নমানের গম আমদানির সুবিধা করে দেওয়া হয়। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ দুই ব্যবসায়ীর স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রোটিনের পরিমাণ সাড়ে ১১ শতাংশ হলে গমে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। এতে গমের মধ্যে ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু বাড়তে থাকে। এ ধরনের গম গুদামে রাখার পর তা এক বছরের মধ্যে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এই গমের আটা খেলে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগ হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সংগ্রহ শাখার ২০২২ সালের ২০ মার্চের স্মারকপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মতামতের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আমদানি করা গমে প্রোটিনের মাত্রা ১২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। তখন এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন দেশের পুষ্টিবিদেরা।
এর আগে ২০১৫ সাল থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ গম আমদানি করছিল। পরে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠজনদের সুবিধা দিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর গমের পুষ্টিগুণবিষয়ক সাধারণ নির্দেশনা অনুযায়ী, গমের প্রোটিনের মান ১২ থেকে ১৮ শতাংশ হতে হবে। এর চেয়ে কম পুষ্টিমানের গম বা আটার তৈরি খাবার খেলে নানা ধরনের অপুষ্টিজনিত সমস্যার ঝুঁকি তৈরি হয়।
বেশি দরে ক্রয়
গম আমদানির ক্ষেত্রে গত এপ্রিলে খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে গ্রেইন ফ্লাওয়ার ডিএমসিসির চুক্তি হয়। তাতে প্রতি টন গমের দাম ধরা হয় ২৮০ ডলার। ওই মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর ‘মাসিক খাদ্যপণ্যের দর’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়ার প্রতি টন গমের দাম ছিল ২০২ ডলার। জাহাজভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তা সর্বোচ্চ ২২০ ডলার হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য অধিদপ্তর ওই গম প্রতি টনে ৬০ ডলার বেশি দাম দিয়ে কেনে।
দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধন চন্দ্র মজুমদার ২০১৯ সালে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি খাতে গম আমদানির একচেটিয়া দায়িত্ব পায় রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান প্রডিনটর্গ। সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) আমদানির ক্ষেত্রে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকার নিয়ম নেই।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে জ্বালানি খাতের পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রিক গ্রুপ মধ্যস্বত্বভোগীর দায়িত্ব পায়। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মিঞা সাত্তার আর তাঁর ভাই আমিরুজ্জামান সোহেল হলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই দুই ভাই সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারি গম ক্রয়ে এই দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। জিটুজির মাধ্যমে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এ ধরনের তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা নিয়ে বারবারই প্রশ্ন উঠেছে। এটা গণ খাতে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাশিয়ায় অবস্থানরত মিঞা সাত্তার হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সরকারকে সর্বোচ্চ মানের গম সরবরাহ করেছি, যা রাশিয়া সরকারের ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় মান যাচাই করা হয়েছে।’
ওই সময়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন মো. ইসমাইল হোসেন। বর্তমানে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জেষ্ঠ সচিব। ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নিয়ম ও সরকারের নির্দেশ মেনে গম আমদানি করা হয়েছিল।
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র এখন কারাগারে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
দুই বছরে আনা গমের সর্বশেষ দুটি চালান এখন চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এসব গম বিতরণ করা হচ্ছে।
দরপত্রপ্রক্রিয়ায়ও একই চক্র
শুধু সরকারি খাত নয়। সাধন চন্দ্র মজুমদারের আমলে বেসরকারি খাতে গম আমদানির ক্ষেত্রেও ওই দুই ভাইয়ের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকার পায়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে খাদ্য অধিদপ্তরের পরপর দুটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে প্রায় এক লাখ টন গম আমদানির অনুমতি পায় এই দুই ভাইয়ের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আর ডি গ্লোবাল।
আর ডি গ্লোবালের মালিকানা স্বত্বের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমিরুজ্জামান সোহেল ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মালিক। দুই ভাইয়ের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রিক গ্রুপের প্রধান কার্যালয় হিসেবে মহাখালী ডিওএইচএসের ২৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। আর ডি গ্লোবালের ক্ষেত্রেও একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রেইন ফ্লাওয়ার ডিএমসিসির বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে নিয়ম সংশোধন করে এভাবে নিম্নমানের গম কেনা একধরনের দুর্নীতি। আর বেশি দামে ওই গম কেনার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণের অর্থের অপচয় করা হয়েছে। এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
prothom alo