- মীযানুল করীম
- ০৩ জুলাই ২০২১
‘কালো’ টাকা কি ‘ভালো’ টাকা? ‘সাদা মনের মানুষ’রা কি কালো টাকার মালিক হতে পারেন? অথবা কালো টাকার মালিকরা কি সাদা মনের মানুষ হতে পারেন? এসব প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের হালহকিকত দেখে। কারণ, এ দেশে কালো টাকার অবাধ গতি এবং সমাদর সমধিক। এ দেশে ‘সাদা’ টাকার জন্য যে পরিমাণ কর দিতে হয়, ‘কালো’ টাকার জন্য এ পর্যন্ত দিতে হয়েছে এর চেয়ে অনেক কম। অবশ্য এবার তার পরিমাণ বাড়লেও কৃষ্ণ অর্থের এই শ্বেতকরণের মেয়াদ বারবার বাড়ানো আর কতকাল, সে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে খোদ-ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই।
কালো টাকার মানে বোঝায় দু’রকম অর্থ। ক. অপ্রদর্শিত অর্থ ও খ. অপরাধে লব্ধ অথবা অন্যায় পন্থায় অর্জিত অর্থ। এ দেশে নানা কারণে অনেক ‘ভালো মানুষ’ও তাদের টাকার হয়তো কর নিয়মিত দেননি আলসেমিবশত কিংবা ভুলে যাওয়ার দরুন। এটা সাধারণত ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’রূপে গণ্য হয়ে থাকে। নাগরিক হিসেবে সবারই নিয়মিত আয়কর দিতে হয় এবং এ দেয়াটা তার দায়িত্ব।
নিকট অতীতে একবার বিরোধী দল নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কিছু অর্থের নিয়মিত কর আদায় করা হয়নি। পরে তিনি ঠিকই এর কর দিয়েছেন। তবে এ নিয়ে রাজনৈতিক সমালোচনা ও প্রচারণা চালাতে প্রতিপক্ষ, তথা ক্ষমতাসীনরা ভুল করেননি। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এমন আছেন টাকার বহু মালিক। মোট কথা, সব অপ্রদর্শিত আয় একরকম নয়। নিশ্চয়ই ‘অলস পড়ে থাকা অর্থ’ বলতেই চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি-রাহাজানির টাকা বোঝায় না।
এবারো জাতীয় বাজেট পার্লামেন্টে উপস্থাপনের প্রাক্কালে কালো টাকা নিয়ে যে আলোচনা আরম্ভ হয়েছিল, তা অব্যাহত রয়েছে গত মঙ্গলবার সংসদে বাজেটের অর্থবিল পাস করার পরও। এর আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল, হয়তো এ ‘সুযোগ’ আর প্রলম্বিত করা হবে না। কারণ, কালো টাকা নিয়ে সরকারের অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। তবে গত বুধবার পত্রিকার প্রতিবেদন দেখলেই বুঝা যায়, ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগই শেষ পর্যন্ত রাখা হলো।’ তবে জরিমানার পরিমাণের দিক থেকে সুযোগটি আগের চেয়ে একটু কঠিন হয়েছে। এতদিন ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা গেলেও তা বাড়িয়ে করা হয়েছে এখন ২৫ শতাংশ। ওই করের ওপর বাড়তি ৫ শতাংশ জরিমানাও গুণতে হবে। এ বিধান আগে ছিল না।
জাতীয় সংসদে ২০২১ সালের যে অর্থবিল পাস হয়েছে, তাতে কালো টাকা সাদা করার বিষয় এভাবেই গৃহীত হলো। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন।
মূলত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এই ‘শ্বেতকরণ’ কিন্তু ক্রিকেট খেলার মতো ‘ধবল ধোলাই’করণ নয়, যদিও অনেকে অভিযোগ করেন, এটাও সে রকম ‘ডযরঃবধিংয’ যার অর্থ আসলে, চোখে ধুলা দেয়া বা বোকা বানানো। যাই হোক, আপাতত নয়া হারে কর-জরিমানা দিয়ে কালো টাকাকে সাদা বা বৈধ টাকা বানানো যাবে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে কালো টাকা কোনো দিন কি ভালো টাকা হতে পারে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা। কালো মনের মানুষরা নিঃসন্দেহে ভালো লোক নন- ব্যাপারটা তেমন।
এবার অর্থবিল পাসের ফলে নগদ, সেভিংস সার্টিফিকেট, ব্যাংকের হিসাবে গচ্ছিত টাকা, শেয়ার মার্কেট এবং প্লট ও ফ্ল্যাট কেনার কালো টাকা ‘ভালো’ করার অবকাশ দেয়া হয়েছে। এ টাকার বিরাট অংশই ‘ভালো-মন্দের টাকা’ বলে এর মালিকরা কতটা ভালো হতে পারবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এবার ১০ শতাংশ হারে কর আদায় করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার সুযোগ রয়েছে কালো টাকা দিয়ে। এমনিতেই, আগে থেকে রয়েছে একই পরিমাণ কর দিয়ে ২০২৪ সাল নাগাদ ইকোনমিক জোন এবং হাইটেক পার্কে কালো টাকা বিনিয়োগের।
কালো টাকার বেলায় ২৫ শতাংশ পরিমাণ কর এবং এর ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিলে কর (২৫+৫) = ৩০ শতাংশ নয়; বাস্তবে হবে ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। কারণ এটা ১০০ শতাংশ নয়, ২৫ শতাংশের ৫ শতাংশ। ঢাকা-চাটগার শেয়ারবাজারে কালো টাকা খাটালে এ হারে কর দিতে হবে। আর কালো টাকায় ক্রয়কৃত শেয়ার এক বছরের মাঝে বিক্রি করা হলে জরিমানা হবে ১০ শতাংশই।
সরকারের অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তফা কামাল টাকার বৈধতা, অর্থাৎ বিনিয়োগের সুযোগ প্রদানের সপক্ষে যতই ভালো ভালো কথা বলুন, খোদ সংসদীয় বিরোধী দলের উপনেতা, সরকারের মহাজোট সঙ্গী, জাতীয় পার্টির প্রধান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সমালোচনায় বলেছেন, ‘কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ প্রদান আসলে দুর্নীতির বৈধতার সমান এবং এটা সুশাসনের বিরোধী। অবৈধ অর্থের বৈধতা দেয়া হলে তা হবে দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির পরিপন্থী। তাই তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় তা নিশ্চিতভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। যে কারণে এ সুযোগ দেয়া হয়, সেটা হলো বিনিয়োগ বাড়ানো ও পাচার বন্ধ করা। বেশ কয়েকবার এ সুযোগ দিলেও ফলাফল শূন্য।’
এ বছর সরকার কেবল কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগই দেয়নি। তা করা হয়েছে কারচুপির মাধ্যমে এবং অগণতান্ত্রিকভাবে- এমন অভিযোগও উঠেছে সাথে সাথে। প্রসঙ্গক্রমে, একটি পত্রিকা লিখেছে, গত ৩ জুন জাতীয় বাজেট ঘোষণার সময় ঢালাওভাবে কালো টাকার সুযোগ দেয়া হয়নি। সবাই ধরে নিয়েছিল এবার ৩০ জুন এ সুযোগ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু অর্থবিল পাসের সময় ঢালাওভাবে ফ্ল্যাট, জমি, শেয়ারবাজার, নগদ টাকা, ব্যাংকে রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্র- এসব খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রেখে বিলে সংশোধনী আনা হয়। ফলে সংসদে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ হলো না। তাই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তদুপরি, ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে বলে তারা উল্লেখ করেছেন। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, ঢালাও সুযোগ দেয়া ঠিক নয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (টিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক বিশেষজ্ঞ আহসান এইচ মনসুর প্রশ্ন রেখেছেন শেষ মুহূর্তে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে। তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কেন বাজেট ঘোষণার সময়ে অর্থবিলে দেয়া হলো না? অর্থবিলে তা থাকলে এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা করা যেত। কিন্তু সেটা অর্থবিল পাস করার আগে আগে ঢোকানো হলো। অর্থাৎ অনেকটা অগণতান্ত্রিক উপায়ে এটা পাস করা হলো। এ নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেয়া হয়নি। এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে- অগণতান্ত্রিক উপায়ে এটি করা হয়েছে মহলবিশেষের স্বার্থে। তা কাম্য নয়। প্রতি বছর এ ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সরকার যেন কালো টাকা আয় করাকে উৎসাহ দিয়েছেন।
অপর দিকে, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, ‘বারবার সুযোগ দেয়া মানে, কালো টাকার মালিকদের গলায় ফুলের মালা দেয়া। কর দেয়ার বিষয় এ ক্ষেত্রে নিছক লোক দেখানো মাত্র। যারা কালো টাকার মালিক, তাদের কাছে করের মূল্য নেই। এই সুযোগ অপরাধীকে মালা দেয়া যেন। এটা আমাদের দেশের সংবিধানসম্মত নয়। এর মধ্য দিয়ে সৎ করদাতাদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়েছে। এটা অনৈতিক। শেয়ারবাজার, প্লট-ফ্ল্যাট, কলকারখানার ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর অর্থ, এই খাতগুলোতে কালো টাকার মালিকেরাই আধিপত্য বিস্তার করবেন একচ্ছত্রভাবে।’
এমনকি, দেশের ব্যবসায়ীরাও চান না যে, কালোকে সাদা করার সুযোগ ঢালাও হবে। দেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ ফোরাম, এফবিসিসিআইয়ের নতুন সভাপতি এবং সরকারি দলের একজন এমপির ভাই জসিম উদ্দিন বলেছেন, ‘এতে সৎ করদাতাদের মনোবল ভেঙে যায়। এফবিসিসিআই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ চায়নি। এর পরও এ সুযোগ দেয়া হলে তা সীমিত সময়ের জন্য হওয়া উচিত। প্রত্যেক বছর এটা করা হলে সৎ লোকের মনোবল আর থাকে না। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ অল্প সময়ের জন্য কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে।’
স্মর্তব্য, টাকা কালো কিনা অথবা কালো টাকার উৎস সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ জানতেও চাইতে পারবে না বলে ইতোপূর্বে সরকার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা-ও বিভিন্ন মহল কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে।