সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এলসি নিষ্পত্তি সেপ্টেম্বরে

 

আমদানি-রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার ব্যাংকগুলো দিতে না পারায় এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে এখন ব্যবসায়ীরা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। দিনকে দিন এই সংকট তীব্রতর হচ্ছে। বিভিন্ন পণ্যের আমদানিতে এলসি খোলা কমছেই।

ফলে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এলসি খোলার পরিমাণও আগস্টের তুলনায় প্রায় ১৬.১% কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এলসি সেটেলমেন্ট বা আমদানি পেমেন্ট সেপ্টেম্বরে ছিল ৪.৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২০ সালের অক্টোবরের পর থেকে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো ৪.৬৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছে, যা আগস্টে ছিল ৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার। জুলাই-আগস্ট মাসে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৩৯.২৫ শতাংশ।

সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পেমেন্টের চাপ কমাতে গত এক বছর ধরে ব্যাংকগুলো এলসি খোলা কমিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তার একটা আভাস আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ দেখলেই পাওয়া যাবে। ডলারের সংকটের কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ভবিষ্যতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই।

ব্যাংকগুলোরও কিছু করার নেই। কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এখন যে পেমেন্ট করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশ ছয় মাস আগে খোলা ডিফার্ড এলসি পেমেন্ট। সাইট এলসি এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এসব এলসি খোলার এক মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। ব্যাংকের কাছে এখন আগে খোলা ডিফার্ড এলসি’র ম্যাচিউরিটি পোর্টফোলিও রয়েছে, সে অনুসারে তারা পেমেন্টের সময় নির্ধারণ করছে।
রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমাদের ডলারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫০০-৬০০ মিলিয়ন ডলার কম। এর ফলস্বরূপ আমরা সহজে এলসি খুলছি না। আমার নিজের ব্যাংকে যেসব এলসি খোলা হয়েছে তার ৯০%ই ডিফার্ড ছিল। ব্যাংকগুলো এখন ডলারের প্রবাহ বজায় রাখার জন্য ডিফার্ড এলসি খুলছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই এলসিগুলো ৪-৬ মাসের জন্য খোলা হয়। তবে ব্যাংকগুলো এর চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ডিফার্ড এলসি খুলছে। এর ফলে ভবিষ্যতে এসব পেমেন্ট বকেয়া হবে, যা রিজার্ভের উপর চাপ বাড়াবে।

আরেক ব্যাংকার বলেন, জুলাই ও আগস্টে ব্যাংকগুলোর ডলারের তারল্য ভালো ছিল। সেপ্টেম্বরে তারল্য কিছুটা কমেছে, তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তা ভালো। ব্যাংকগুলো এখন এলসি খোলার ব্যাপারে খুবই সতর্ক। তার মতে, আগামী দিনে ডলারের অবস্থা কেমন হবে তা বোঝা যাচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এখন আমরা ২৭০ দিন বা নয় মাসের জন্য ডিফার্ড এলসি খুলতেও দেখছি। এই এলসিগুলোর পেমেন্ট ১০ থেকে সাড়ে ১০ মাস পরে করতে হয়। দেরিতে পরিশোধের কারণে আলাদাভাবে ডলারে সুদ দিতে হয় এবং সুদের উপর ২০% ট্যাক্স এনবিআরকে দিতে হয়। এই খরচটাও আলাদাভাবে পণ্যের দামের সঙ্গে যোগ হবে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী সুদের হার বাড়ছে। বর্তমান বাজেটে সুদের অর্থ প্রদানের উপর আরোপিত ২০% ‘উইথহোল্ডিং ট্যাক্স’ বিদেশি ঋণকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে। ঋণের খরচ প্রায় ১১% বেড়েছে।

বৃহৎ শিল্পের ৮ খাতে সর্বোচ্চ মন্দা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক সংকটেই কেটেছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরোটা। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস, ক্রমবর্ধমান লোডশেডিং, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, ডলার সংকটে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারা সব মিলিয়ে উৎপাদন খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে না পারাসহ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিতে এ সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে দেশের বৃহৎ শিল্প খাত। ৮টি খাত বড় ধরনের মন্দার সম্মুখীন হয়। এসব খাতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছর বৃহৎ শিল্পগুলোর মধ্যে খাদ্যপণ্য উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নামে। এতে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৭ মাসই এ শিল্পে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রান্তিকে খাদ্যপণ্য উৎপাদনে ৩২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়, তৃতীয় প্রান্তিকে ৩৬ শতাংশ ও চতুর্থ প্রান্তিকে ৩১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়।

২০২২-২৩ অর্থবছর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে এর পরের অবস্থানে রয়েছে বেসিক মেটাল (মৌলিক ধাতু)। এ খাতে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৩৫ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়, তৃতীয় প্রান্তিকে ২৪ শতাংশ ও চতুর্থ প্রান্তিকে ২৬ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ওষুধজাতীয় পণ্য। এ খাতে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১২ শতাংশ, তৃতীয় প্রান্তিকে ২৪ শতাংশ ও চতুর্থ প্রান্তিকে ২৪ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। এর পরের অবস্থানে রয়েছে কম্পিউটার ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন। এ খাতে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১০ শতাংশ, তৃতীয় প্রান্তিকে ১২ শতাংশ ও চতুর্থ প্রান্তিকে ১১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। আর কাঠ ও কাঠের তৈরি পণ্যের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১৬ শতাংশ, তৃতীয় প্রান্তিকে ৯ শতাংশ ও চতুর্থ প্রান্তিকে ৬ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়।

এদিকে কাগজ ও কাগজের তৈরি পণ্যে দ্বিতীয় প্রান্তিকে তিন শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে ২৪ শতাংশ ও চতুর্থ প্রান্তিকে ২৪ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। একই ধরনের চিত্র কেমিক্যাল জাতীয় পণ্যে। এ খাতে দ্বিতীয় প্রান্তিকে তিন শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে ৬ শতাংশ ও চতুর্থ প্রান্তিকে ১৪ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। আর অন্যান্য শিল্প খাতে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১০ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। তৃতীয় প্রান্তিকে এসব শিল্প কোনো প্রবৃদ্ধি ছিল না। অর্থাৎ শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়। তবে চতুর্থ প্রান্তিকে আবারো এসব শিল্পে ১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। উল্লিখিত খাতগুলো ছাড়াও আরও কিছু শিল্পে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে এগুলোর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মাত্রা তুলনামূলক কম।

দেশের একটি শীর্ষ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এলসি খোলার বিষয়ে আমরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। এর কারণে আমাদের সাপ্লাই চেন ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানিমুখী বাজারের জন্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।