কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’। মহাসড়কটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে মহাসড়কটির প্রতি কিলোমিটার পেভমেন্ট বা পিচের পেছনে খরচ হয়েছে কিলোমিটারপ্রতি ২৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। নকশা অনুযায়ী, সড়কটির পিচের স্থায়িত্ব হওয়ার কথা ২০ বছর। যদিও ২০২০ সালের মার্চে চালু হওয়া ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে চালুর সাড়ে তিন বছর পেরোতেই ‘রাটিং’ দেখা দিতে শুরু করেছে। এতে মহাসড়কটিতে যাতায়াত যেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, তেমনি দেখা দিয়েছে বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও।
সড়কের যানবাহন চলাচলকারী অংশ, বিশেষ করে যে অংশের ওপর দিয়ে বেশির ভাগ যানবাহনের চাকা যায়, সেখানে চাকার আকৃতির সমান বা তার চেয়ে বেশি অংশ সমান্তরালে ডেবে যাওয়ার ঘটনাকে প্রকৌশলীদের ভাষায় বলা হয় রাটিং। সাধারণত সড়কে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হলে কিংবা সড়ক নির্মাণের ধাপগুলোয় সঠিক নিয়মে নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার না করলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আবার সড়কের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে যানবাহন চললেও দেখা দিতে পারে রাটিং। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে রাটিংয়ের জন্য যানবাহন বিশেষ করে পণ্যবাহী গাড়ির অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচলকে দায়ী করছেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা। অন্যদিকে যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘ওভারলোডের’ পাশাপাশি নির্মাণকাজের মান যথাযথ না হলেও এমনটি ঘটতে পারে।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে সরজমিন ঘুরে শরীয়তপুরের নাওডোবা থেকে মাদারীপুরের পাচ্চর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত অংশে রাটিংয়ের পরিমাণ বেশি দেখা গেছে। বিশেষ করে মহাসড়কটির এ অংশের ঢাকামুখী লেনে রাটিংয়ের পরিমাণ বেশি। পদ্মা রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ঢাকামুখী লেনের বিভিন্ন স্থানে এক ইঞ্চি বা তার চেয়েও বেশি গভীরতার রাটিং চোখে পড়েছে।
রাটিংয়ের ফলে মহাসড়কটি ডেবে যাওয়ার পাশাপাশি মাঝখানের রোড মার্কিংও আঁকাবাঁকা হয়ে পড়েছে। সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা এজন্য দায়ী করছেন রাটিংকে। গাড়ির চাকার ভারে মার্কিং এলাকার আশপাশের পিচ উঁচু বা নিচু হয়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
শুধু এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকামুখী লেনের নাওডোবা-পাচ্চর অংশ নয়, কম-বেশি রাটিং চোখে পড়েছে ঢাকা-মাওয়া এবং জাজিরা-ভাঙ্গা সড়কের বিভিন্ন অংশেও। এর মধ্যে কোথাও রাটিংয়ের পরিমাণ বেশি, কোথাও সামান্য। আবার কোথাও কোথাও সাম্প্রতিক সময়ে রাটিং দেখা দিতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা।
এছাড়া এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন সেতুর সঙ্গে দুই পাশের সড়কের সংযোগস্থলে দেখা দিয়েছে অসামঞ্জস্যতা। সেতুর পাটাতনের চেয়ে সংযোগস্থলের রাস্তা তুলনামূলক নিচু হয়ে পড়েছে বিভিন্ন স্থানে। সংযোগস্থলে সড়ক ও সেতুর এ অসামঞ্জস্যতার কারণে প্রায়ই ছোট ছোট দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সম্প্রতি ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে পরিদর্শন করে এসেছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। এক্সপ্রেসওয়ের সড়ক ও সেতুর অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়েছে তার চোখেও। পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুই ধরনের রাটিং আমার চোখে পড়েছে। একটি হলো সড়কের রাটিং। যেদিক দিয়ে গাড়ির চাকা গেছে, সেদিক দিয়ে রাস্তা ডেবে গেছে। আরেকটি রাটিং তৈরি হচ্ছে রাস্তা ও সেতুর সংযোগস্থলে। সেতুর কাঠামো কংক্রিটের। ফলে ব্রিজের পাটাতন ডেবে যাওয়ার কথা না। কিন্তু রাস্তা ডেবে যাওয়ায় সেতু ও রাস্তার সংযোগস্থলে এ অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে, যা এত দ্রুত হওয়ার কথা নয়, কিংবা কখনই হওয়ার কথা নয়।’
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সওজ অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের তত্ত্বাবধানে। রাটিং সম্পর্কে জানতে চাইলে এ জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটু একটু করে রাটিং হচ্ছে। বর্তমানে সড়কটিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলমান রয়েছে। কোনো ছোটখাটো ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করে ফেলা হচ্ছে। পাশাপাশি রাস্তার পাশের গাছপালা পরিষ্কার, গার্ড রেল (সীমানা দেয়াল) ঠিক করা হচ্ছে। তবে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বৃহদায়তনের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম আমরা এখনো শুরু করিনি। রাটিং দেখা দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঠিক করে ফেলব। যারা সড়কটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে (কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন), তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আমাদের চুক্তি করা আছে। আর যদি বড় ধরনের কিছু হয়, তখন আমাদের বড় চিন্তা করতে হবে। সড়কটি চালুর তিন বছরের বেশি হয়ে গেল। সবকিছু মিলিয়ে আমরা ছোট পরিসরে সড়কটি রক্ষণাবেক্ষণ করছি। যখন বড় পরিসরে রক্ষণাবেক্ষণের দরকার হবে, তখন আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
সড়কটির পিচ বা পেভমেন্টের নকশা অনুযায়ী, ২০ বছরের আগে রাটিং দেখা দেয়ার কথা নয়। বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘রাটিং তো বিভিন্ন কারণে হয়। একটা বড় কারণ হলো বিটুমিন। আগে সড়ক নির্মাণে আমরা ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করতাম। এখন আরো উন্নত বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আরেকটি কারণ হলো যানবাহনের ওভারলোড। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড লোডিং প্যাটার্ন হলো, ছয় চাকার দুই এক্সেলের গাড়িগুলোয় সাড়ে ১৫ টন পর্যন্ত ভার বহন করা যাবে। আর ১০ চাকার তিন এক্সেলের জন্য সর্বোচ্চ ওজনসীমা ২৩ টন। কিন্তু আমাদের মন্ত্রণালয় (সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়) দুই এক্সেলের যানবাহনে সর্বোচ্চ ২২ টন, আর তিন এক্সেলের যানবাহনের জন্য সর্বোচ্চ সাড়ে ২৭ টন ওজন বহনের অনুমতি দিয়েছে। বলা যায় আমরা এখানে অফিশিয়ালি ওভারলোড বহনের অনুমতি দিচ্ছি। যেহেতু আমরা অফিশিয়ালি দেড় গুণ বেশি লোড অনুমোদন করেছি, তার একটা প্রভাব তো রাস্তার ওপরে পড়বেই।’
অন্যদিকে ওভারলোডের পাশাপাশি নির্মাণকাজের গুণগত মানেও ত্রুটির কারণে রাটিং দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেন, ‘রাটিংয়ের জন্য প্রথমত দায়ী হলো রাস্তার নির্মাণকাজ। রাটিং যদি ধারাবাহিকভাবে না হয়ে বিভিন্ন জায়গায় হয়, তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে ওইসব জায়গায় নির্মাণকাজ মানসম্মত হয়নি। দ্বিতীয় কারণ হলো ওভারলোডিং।’
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের রাটিংয়ের বিষয়টি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে এ রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এ রাস্তা দেশের অন্যান্য রাস্তার চেয়ে গুণগতভাবে বেশি ভালো হওয়া উচিত ছিল। কারণ খরচের দিক দিয়ে কোনো ঘাটতি ছিল না। এ রাস্তায় রাটিং দেখা দিলে তা অবশ্যই তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করে দেখা উচিত। ভবিষ্যতে তো আমরা আরো এক্সপ্রেসওয়ে বানাব। সেগুলোয় যেন এমন সমস্যা না হয়, তার জন্য এ তদন্ত ভীষণভাবে জরুরি।’
বনিক বার্তা