২০১২ সালের পর প্রায় ১১ বছর সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুতা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসায় একধরনের স্বস্তিতে ছিলেন জাহাজমালিকেরা। আফ্রিকা উপকূল থেকে বা ওই পথ দিয়ে পণ্য আমদানিতেও এ নিয়ে বাড়তি ব্যয়ের কথা ভাবতে হয়নি। তবে ১১ বছরের স্বস্তি গত নভেম্বর থেকে উধাও হতে শুরু করে। এ সময়ে সোমালিয়ার উপকূল ও এডেন উপসাগরে আবার দস্যুতার ঘটনা ঘটতে থাকে। একই সঙ্গে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে হুতিদের পণ্যবাহী জাহাজে হামলায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বাড়তে থাকে।
সর্বশেষ গত মার্চে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি হওয়ার পর বাংলাদেশি জাহাজমালিকদের উদ্বেগ বেড়ে যায়। ৩৩ দিনের মাথায় মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজটি ছাড়া পেলেও সমুদ্রপথে বাংলাদেশি জাহাজ পরিচালনা কিংবা পণ্য আমদানিতে অস্বস্তি কাটেনি। কারণ, সোমালিয়ার উপকূল ও লোহিত সাগর ঘিরে ইয়েমেনের হুতিদের হামলার ঘটনায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশি জাহাজ পরিচালনায় খরচ বেড়ে গেছে। বিদেশি জাহাজেও পণ্য আমদানিতে বাড়তি খরচ হচ্ছে।
বাংলাদেশের বহরে এখন ৯৭টি সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে কনটেইনার জাহাজ ও ছোট আকারের গুটিকয়েক জাহাজ ছাড়া বেশির ভাগই আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপ–আমেরিকায় পণ্য পরিবহন করছে। এ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পাড়ি দিতে হচ্ছে এসব জাহাজকে।
বাংলাদেশি সমুদ্রগামী জাহাজমালিকেরা জানান, পণ্য আমদানিতে তিন ধাপে খরচ বেড়েছে। প্রথমত, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চলাচলের জন্য বাংলাদেশি জাহাজগুলোকে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা বাবদ খরচ বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চলাচলের জন্য বিমার প্রিমিয়াম বেড়েছে। তৃতীয়ত, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে চলাচলের জন্য নাবিকদের সুযোগ–সুবিধাও দিতে হয় বেশি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যায় শীর্ষস্থানে থাকা কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়া উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরের নিরাপদ এলাকা দিয়ে চলাচল করেও রক্ষা পায়নি। এ কারণে এখন বাড়তি খরচ হলেও ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার আশপাশ দিয়ে চলাচলের সময় আমরা জাহাজে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিচ্ছি।’
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বাড়ছে
ইন্টারন্যাশনাল বার্গেইনিং ফোরাম বা আইবিএফ সাগরপথের নিয়মিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকা অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চলাচলের জন্য জাহাজে কী কী সুরক্ষা নিতে হবে এবং নাবিকদের কী কী সুবিধা দিতে হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন ও ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম এমপ্লয়ার্স কাউন্সিলের যৌথ উদ্যোগ হলো এই আইবিএফ।
আইবিএফের তালিকায় গত বছরের এই সময়ে পাঁচটি এলাকা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল আইবিএফ যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সংখ্যা বেড়ে সাতটিতে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বাড়ানো হয়েছে। আবার এই দুই এলাকার দক্ষিণে সোমালিয়া উপকূলও তালিকাভুক্ত করেছে সংস্থাটি। এসব এলাকায় চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিরাপত্তাব্যবস্থার পাশাপাশি নাবিকদের ঝুঁকিভাতার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করেছে তারা।
আইবিএফের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার চিত্র কেমন, তা উঠে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর প্রতিবেদনে। গত শুক্রবার সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুতা ঝুঁকিবিষয়ক সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত হওয়ার পর পাঁচটি বাণিজ্যিক জাহাজ ও দুটি মাছ ধরার নৌযান নিশানা করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। যদিও কোনো জাহাজ ছিনতাই করতে পারেনি তারা। বর্তমানে সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে কোনো জাহাজ না থাকলেও জলদস্যুতার ঝুঁকি কমেনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী সোমালিয়া ছাড়াও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের জাহাজে হামলার চিত্রও তুলে ধরেছে আরেকটি প্রতিবেদনে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত ইয়েমেন উপকূলে নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৯ নভেম্বর গ্যালাক্সি লিডার জাহাজ ছিনতাইয়ের মাধ্যমে হুতিদের হামলা শুরু হয়। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৭টি যুদ্ধজাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা ও হামলার চেষ্টা করেছে হুতিরা।
ইউরোপীয় নৌবাহিনীর এই প্রতিবেদনের পরও প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো জাহাজে হামলার নিশানা করার খবর আসছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে হুতিরা জানিয়েছে, তারা আন্ড্রোমেডা স্টার অয়েল ট্যাংকার নামের একটি জ্বালানিবাহী জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
বাংলাদেশি জাহাজে বাড়তি খরচ
গত ১২ মার্চ এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি হওয়ার আগেও বাংলাদেশি জাহাজে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার নজির ছিল কম। তবে এমভি আবদুল্লাহ জিম্মির ঘটনার পর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চলাচলের সময় জাহাজে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে শুরু করেন জাহাজ পরিচালনাকারীরা।
যেমন সম্প্রতি কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বন্দরে পণ্য পরিবহনের ভাড়া পেয়েছিল মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) একটি জাহাজ। উপকূল থেকে অনেক দূরে চলাচল করেও এমভি আবদুল্লাহ রক্ষা না পাওয়ায় এমজিআইয়ের জাহাজটি এ–যাত্রায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়। এ জন্য জাহাজটিতে তিনজনের সশস্ত্র দল ওঠানো হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রমের জন্য সশস্ত্র দল ভাড়া নেওয়ার পাশাপাশি জাহাজে নেওয়া হয় নিরাপত্তাব্যবস্থা। কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয় জাহাজে।
জানতে চাইলে এমজিআইয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল শিপিং লাইনসের মহাব্যবস্থাপক মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চলাচলের জন্য এখন প্রতি যাত্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার ডলার বাড়তি খরচ হচ্ছে। জাহাজমালিক বা যাঁরা জাহাজভাড়া নিচ্ছেন, তাঁরা এই খরচ প্রথমে বহন করছেন। তবে দেশের আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্যের দামে যুক্ত হয়ে তা ভোক্তাদের কাঁধে পড়ছে এই খরচ।
সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এখন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চলাচলের সময় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন জাহাজমালিকেরা। আবার বিমার প্রিমিয়াম বাবাদ বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
দস্যুতার সরাসরি খরচ যত
দস্যুতার ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই খরচ বৃদ্ধি করে থাকে। এখন পর্যন্ত দস্যুতা নিয়ে সবচেয়ে বড় সমীক্ষা হয়েছিল ২০১৩ সালে। ওই সময় বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) এবং আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মেরিটাইম টাস্কফোর্স সম্মিলিতভাবে জলদস্যুতা নিয়ে সমীক্ষা করে।
‘পাইরেট ট্রেইলস’ শীর্ষক ওই সমীক্ষায় বলা হয়, ২০০৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০ বছরে সোমালিয়া ও হর্ন অব আফ্রিকার উপকূলে ছিনতাই করা জাহাজের মুক্তিপণ বাবদ ৩৩ দশিমক ৯ কোটি থেকে ৪১ দশমিক ৩ কোটি ডলার মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছিল। এটি হলো প্রত্যক্ষ খরচ। অন্যদিকে পরোক্ষ খরচের মধ্যে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নেওয়া নিরাপত্তাব্যবস্থা ও দস্যুতা প্রতিরোধে নেওয়া আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
জলদস্যুতার শিকার বাংলাদেশি জাহাজে মুক্তিপণের প্রত্যক্ষ খরচও কম নয়। এখন পর্যন্ত দুটি জাহাজ দস্যুরা জিম্মি করেছিল। ২০১০ সালে এমভি জাহান মণি এবং চলতি বছর এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ জিম্মি হওয়ার পর দুটিই মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনে জাহাজ দুটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, এমভি জাহান মণি জাহাজ চার মিলিয়ন (৪০ লাখ) ডলার এবং গত ১৪ এপ্রিল মুক্ত হওয়া এমভি আবদুল্লাহ ছাড়িয়ে আনতে ৫ মিলিয়ন (৫০ লাখ) ডলার মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে। যদিও মালিকপক্ষ মুক্তিপণের অঙ্ক প্রকাশ করেনি।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি মুক্তিপণ ছাড়াও ৩৩ দিন কোনো পণ্য পরিবহন করতে পারেনি। প্রতিদিনের ভাড়া ১০ হাজার ডলার করে ৩ লাখ ৩০ হাজার ডলারভাড়া আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অর্থাৎ এই অর্থ লোকসান হয়েছে কোম্পানির। যদিও বিমা প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতির অঙ্ক কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া গেলেও কোম্পানির ঘাড়েও পড়বে এই বাড়তি ব্যয়ের বোঝা।
সমাধান কী
সমুদ্রপথে জাহাজ পরিচালনা বা সমুদ্রপথে পণ্য আমদানিতে ঝুঁকি মেনে পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা। ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে। এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় এখন বিনিয়োগের সুরক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে নাবিকদের স্বার্থ সুরক্ষাকারী সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা বৈশ্বিক ব্যবসা। এই ব্যবসা করতে হলে বাংলাদেশের নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়।
ফলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। লাখ ডলার খরচ করে যদি মিলিয়ন ডলারের সম্পদ রক্ষা করা যায়, তাহলে খরচ করাই উচিত। তাতে নাবিকদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
prothom alo