মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এ এন এম মুনীরুজ্জামান। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, বাংলাদেশ সীমান্তে এর অভিঘাত, রাখাইন অঞ্চলকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব
প্রথম আলো:মিয়ানমার পরিস্থিতি এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত চিন প্রদেশের একজন গেরিলা নেতা দাবি করেছেন, এক বছরের মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পতন ঘটবে। আপনার কী মনে হয়?
মুনীরুজ্জামান: ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে চলে গেল, সেটি গত বছরের অক্টোবর মাসে নতুন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়।
জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এত দিন ধরে লড়াই করে আসা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তিনটি গোষ্ঠী এক হয়ে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে জোট গঠন করে। এখানে আছে আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি এবং টাং লিবারেশন আর্মি। এই অ্যালায়েন্স গত বছরের অক্টোবরে অপারেশন ১০২৭ নাম দিয়ে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান শুরু করে, যেটি অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। এর মধ্য দিয়ে জান্তা সরকার চরম হুমকির মুখে পড়ে যায়।
থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স যে গতিতে বিভিন্ন অঞ্চলের শহর ও সামরিক স্থাপনা দখল করে নিচ্ছে, তাতে অনেকে আশঙ্কা করছেন, সমগ্র মিয়ানমারের বিস্তীর্ণ এলাকা এসব গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৪৮ শতাংশ অঞ্চল জান্তা সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশের কাছাকাছি রাখাইন ও চিন প্রদেশে বেশ কিছু বড় শহর ইতিমধ্যে দখল করে নিয়েছে। এমনকি এটিও আশঙ্কা করা হচ্ছে, রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিতওয়ে হয়তো শিগগিরই আরাকান আর্মির হাতে চলে যেতে পারে।
সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের এ লড়াইয়ে পিডিএফও যোগ দিয়েছে। পিডিএফ মূলত প্রধান জাতিগোষ্ঠী বামারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বামাররা এর আগে কখনো সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। ফলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই সম্মিলিত প্রতিরোধ নতুন প্রকৃতি ও আকার ধারণ করেছে।
তবে বেশ কিছু পশ্চিমা সংবাদপত্রের বিশ্লেষণে যেভাবে বলা হচ্ছে, এক বছরের মধ্যে মিয়ানমার জান্তা সরকারের পতন ঘটবে এবং মিয়ানমারের গেরিলা নেতারাও সেটি দাবি করছেন, তা খুব বাস্তবসম্মত মনে হয় না।
এর কারণ হচ্ছে, দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে জান্তা সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ, তার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়নি। যেসব জায়গায় তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা মূলত জাতিগত অঞ্চলভিত্তিক এলাকা এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চল। কাজেই মিয়ানমার বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হবে, সেটি এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
প্রথম আলো:মিয়ানমারের এসব অভ্যন্তরীণ ঘটনার অভিঘাত বাংলাদেশ সীমান্তে পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিষয়টি কীভাবে দেখছে বলে মনে করেন?
মুনীরুজ্জামান: মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন অঞ্চল বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হওয়ায় দেশটির সংঘাতের প্রভাব আমাদের এখানেও পড়তে শুরু করেছে। আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছি মিয়ানমার থেকে ছুটে আসা মর্টার শেলে আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকার জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।
এ ছাড়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে জান্তা সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এই সবকিছু বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর বড় ধরনের হুমকি ও চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত খুবই সতর্ক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছে। যার কারণে পালিয়ে আসা মিয়ানমার বাহিনীর সদস্যদের এ দেশে আশ্রয় ও চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সংগঠিত করে ফেরতও পাঠানো হয়েছে।
তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত আরও বাড়তে থাকবে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে আরও বেশি পড়তে পারে। এর ফলে আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে বিঘ্ন হতে পারে। জান্তা বাহিনীর তাড়া খেয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়টি এখন থেকেই আমাদের আরও বেশি জোরদার করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রথম আলো:সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে মিয়ানমার সম্পর্কে বাংলাদেশের জানা–বোঝা কম। সে কারণে মিয়ানমার প্রশ্নে যথাযথ নীতি গ্রহণ বা কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। আপনি কি সেটাই মনে করেন?
মুনীরুজ্জামান: ভারত ছাড়া মিয়ানমার আমাদের একমাত্র অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তবে সবাই একমত যে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো সময়েই আমরা গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি বা প্রচেষ্টা নিইনি।
স্বাধীনতা–উত্তরকালে বাংলাদেশকে মিয়ানমার স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু পরে মিয়ানমারের সঙ্গে বোঝাপড়া স্থাপনের জন্য কোনো ক্ষেত্র স্থাপন করিনি।
যার কারণে অনেকে মনে করেন, মিয়ানমার আমাদের অজানা প্রতিবেশী। কূটনৈতিক, নিরাপত্তা পর্যায়ে এবং দুই দেশের মানুষের ভেতরে যোগাযোগের জন্য যে ধরনের সক্ষমতা দরকার, তা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করিনি।
মিয়ানমার নিয়ে যে ধরনের জ্ঞান থাকা দরকার, আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সেটি কোনো সময় যথেষ্ট ছিল না। এমনকি কূটনৈতিক পর্যায়েও যদি দেখি, শুধু রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পরে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের জন্য আলাদা একটি ডেস্ক স্থাপন করা হয়। এর আগে মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর জন্য এককভাবে কোনো বন্দোবস্তও ছিল না।
যার কারণে যে ধরনের দক্ষ কূটনীতি গড়ে তোলা ও সক্ষমতা সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল, তা কোনো সময় করা হয়নি। ফলে মিয়ানমারের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় আমাদের যে নীতিনির্ধারণ হয়েছিল, সেটি খুবই অস্থায়ী বা অপর্যাপ্তভাবে করা হয়েছে। যার প্রতিফলন আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে দেখতে পেয়েছি।
প্রথম আলো:মিয়ানমার পরিস্থিতির প্রভাব ভারতেও পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি ডোনাল্ড লু সম্প্রতি বলেছেন, মিয়ানমার পরিস্থিতি শোচনীয় হতে পারে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে। এই ‘সতর্ক’ থাকার অর্থ কী? কী করতে পারে দেশ দুটি?
মুনীরুজ্জামান: মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত হচ্ছে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে। এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের অভিঘাত বাংলাদেশের মতো একইভাবে ভারতের ওপরেও পড়েছে।
তবে ভারতের পরিস্থিতি আরও নাজুক, এ কারণে যে দেশটির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিভিন্ন প্রদেশে নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা অব্যাহত আছে এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অভিযান তাদের প্রভাবিতও করছে। এ কারণে এর আগে ভারত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের এসব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত অভিযান চালিয়েছিল।
বর্তমানে মিয়ানমারের ভেতরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর যেসব অভিযান চলছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত আরও বেশি উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া রাখাইন প্রদেশে ভারতের একটি প্রকল্প আছে। কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট নামের এই প্রকল্প ভারতের সঙ্গে নদীপথে ও সড়কপথে মিয়ানমারকে যুক্ত করবে। ইতিমধ্যে সেখানে অর্ধবিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু রাখাইনে আরাকান আর্মির তৎপরতার কারণে এ প্রকল্পের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে গেছে। এখানে কোনো অগ্রগতিও দেখা যাচ্ছে না। ফলে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের সংঘাতের সরাসরি বিরূপ প্রতিক্রিয়া এ অঞ্চলে ভারতের কার্যক্রমের ওপর এসে পড়েছে। বিষয়টি সামনে আরও জটিল হয়ে উঠবে।
এ কারণে ডোনাল্ড লুও বাংলাদেশ ও ভারতকে সতর্ক থাকতে বলেছে। আমাদের উচিত হবে, সীমান্তে যেখানে শক্তি বৃদ্ধি করা দরকার, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। সীমান্তের ওপারে কী ঘটছে, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা।
প্রথম আলো:অনেক আশঙ্কা করছেন, মিয়ানমার ভেঙে যেতে পারে। আপনার কী মনে হয়?
মুনীরুজ্জামান: এখানে যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের লক্ষ্য নির্দিষ্ট ও সীমিত। তারা এককভাবে কেউ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে না। তারা কেউ নিজেদের অঞ্চলকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেও দেখতে চাইছে না। তারা চাইছে, নিজেদের অঞ্চল ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকবে। এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নির্বাচন—এসব নিয়ে তাদের কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। যদিও পশ্চিমাদের আগ্রহ সেগুলো নিয়েই। মূলত প্রদেশভিত্তিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিশ্চিত করতে চায়, রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে তাদের ওপর যাতে কোনো ধরনের চাপ না আসে। ফলে মিয়ানমার ভেঙে যাবে, এমন আশঙ্কা বাস্তবসম্মত নয়।
প্রথম আলো:এখন এ অঞ্চল ঘিরে ভূরাজনৈতিক যে তৎপরতা আছে, মিয়ানমারের পরিস্থিতি তার ওপর কী প্রভাব ফেলবে? তার গতিপ্রকৃতি কেমন হবে?
মুনীরুজ্জামান: মিয়ানমারের যে সংঘাত বা পরিস্থিতি, তার সঙ্গে বেশ কিছু আঞ্চলিক শক্তি এখানে সরাসরি যুক্ত এবং তাদের প্রভাববলয় সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে চীন ও ভারতের নাম বলতে হয়।
এখানে দেখা যাচ্ছে, চীন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে সরাসরি সমর্থন দিয়ে আসছে, আবার একই সঙ্গে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তারা সংযোগ রেখে চলেছে। দুই পক্ষের সঙ্গেই চীন সম্পর্ক বজায় রেখেছে। একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারত বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। কারণ, এত দিন তারা জান্তা সরকারের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখেছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের কার্যত কোনো যোগাযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে চীন ভারতের চেয়ে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
আঞ্চলিক শক্তির বাইরে যুক্তরাষ্ট্র এখানে তাদের প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাশিয়াও এই প্রতিযোগিতায় যুক্ত হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর।
এখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতা বিশ্বজুড়ে চলছে, তার প্রভাবও মিয়ানমারে পড়েছে। আমরা ইতিমধ্যে জানি যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট নামে একটি আইনও প্রণয়ন করেছে। যার মাধ্যমে তারা মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীকে সাহায্য করতে পারে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারবে।
ধারণা করা যায়, বার্মা অ্যাক্টের প্রতিফলন বা বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখানে আরও সক্রিয় হবে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীনের কৌশলগত প্রতিযোগিতার সরাসরি প্রভাব এ অঞ্চলে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রথম আলো:বার্মা অ্যাক্ট এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রভাব মিয়ানমারের কোন অঞ্চলে বেশি পড়তে পারে বলে আপনার মনে হয়? কারণ, লড়াইরত জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর কোনো কোনোটির ওপর চীনের আর কিছু গোষ্ঠীর ওপর পশ্চিমাদের প্রভাব রয়েছে।
মুনীরুজ্জামান: সার্বিকভাবে মিয়ানমারের ওপরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ যুক্ত আছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাখাইন অঞ্চলের ওপর তবে দুই দেশেরই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এর প্রধান কারণ রাখাইনে ইতিমধ্যে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। এ বন্দরের ৮০ শতাংশ মালিকানা চীন ইতিমধ্যে লাভ করেছে।
এ বন্দর চীনের কৌশলগত গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এটি শুধু গভীর বন্দর নয়, এখান থেকে দুটি পাইপলাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছে চীনের কুনমিং পর্যন্ত। একটি দিয়ে পেট্রোলিয়াম, আরেকটি দিয়ে গ্যাস সরাসরি কুনমিং পৌঁছে যাবে।
চীনের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান প্রণালি হলো মালাক্কা প্রণালি। কোনো কারণে মালাক্কা প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে চীনের জন্য তা হবে হুমকিস্বরূপ। তখন সেটিকে বাইপাস করে রাখাইনের গভীর সমুদ্র দিয়ে জ্বালানি নিয়ে আসতে সক্ষম হবে চীন। এ কারণে গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য খুবই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান বিশ্বে যে ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশলগত নীতি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রটা প্রকাশ করেছে, তার মাধ্যমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হলো বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর। এ বঙ্গোপসাগরের একটি এলাকা হচ্ছে রাখাইন প্রদেশে একটি প্রবেশস্থল। যার কারণে চীন এখানে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে গুরুত্ব দিয়েছে। এর মাধ্যমে চীন বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশের একটি দ্বার তৈরি করেছে।
তৃতীয়ত হচ্ছে, রাখাইনে বিভিন্ন জায়গায় কিছু বিশেষায়িত অর্থনৈতিক এলাকায় তৈরি করা হচ্ছে, যার মালিকানা মূলত চীন ও রাশিয়ার হাতে। চতুর্থত, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে যে ছয়টি অর্থনৈতিক করিডর স্থাপন করার কথা, তার মধ্যে দুটি হচ্ছে নৌভিত্তিক। এর একটি চীন-মিয়ানমার করিডর নামে পরিচয়।
কাজেই বহুমাত্রিকভাবে রাখাইন প্রদেশ চীনের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র এখানে চীনের প্রভাববলয় সৃষ্টি হতে দিতে চাইবে না বা এটিকে প্রতিহত করতে চাইবে। যেহেতু এ প্রদেশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী, ফলে এখানে যা কিছু ঘটবে, তার প্রভাব আমাদের ওপর এসে পড়বে।
প্রথম আলো:বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এখন অনেকে বলছেন, মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ করা উচিত। মিয়ানমারের এই পরিস্থিতিতে আসলে বাংলাদেশের কী নীতিকৌশল হওয়া উচিত এবং সেটি কীভাবে?
মুনীরুজ্জামান: প্রথমত, নিরাপত্তাজনিত পদক্ষেপগুলো সুসংহতভাবে নিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে যে সার্বক্ষণিক পর্যালোচনা দরকার, সেটির জন্য সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গেও এ ব্যাপারে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখতে হবে। যার মধ্যে চীন, ভারত বা আসিয়ান থাকবে। বিশ্বের যেসব পরাশক্তি এখানে প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য ও গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে হবে।
আমরা যে ধরনের গতানুগতিক কূটনীতি করে এসেছি, তা দিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখানে উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল কূটনৈতিক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখে এসেছি। এখন সময় চলেছে, মিয়ানমারের যেসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী আমাদের সীমান্তবর্তী পর্যন্ত এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে, তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে হলেও কোনো না কোনো সংযোগ স্থাপন করা।
তবে এমন একটি জটিল আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে যে রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করা উচিত, সেভাবে আমরা এগোচ্ছি বলে মনে হয় না। এখানে যা করণীয়, তা শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নয়, ফলে আন্তমন্ত্রণালয় একটি টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার। এখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সুপারিশও জরুরি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনার বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও ক্ষীণ হয়ে গেছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছেও এটি এখন আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। তবে এ ব্যাপারে অন্য গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে হয়তো পরিস্থিতি বিবেচনায় ভবিষ্যতে আমরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকব।
প্রথম আলো