সাংস্কৃতিক হামলা ও বিপন্ন স্বাধীনতা
ফিরোজ মাহবুব কামাল 2 December 2018
বিপন্ন স্বাধীনতা
প্রতিদেশে ভৌগলিক মানচিত্রের সাথে একটি আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক মানচিত্রও থাকে। আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক মানচিত্রটি গড়ে উঠে দেশবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাস,ধ্যানধারণা এবং সংস্কৃতির ভিত্তিতে। ভৌগলিক মানচিত্রের স্থায়ীত্বের জন্য আদর্শিক মানচিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ,আদর্শিক মানচিত্র থেকেই নির্ধারিত হয় ভৌগলিক মানচিত্রের সীমারেখা। এটি বাড়লে ভৌগলিক মানচিত্রও বাড়ে;এবং দুর্বল হলে দেশের ভূগোল বাঁচে না। ভূগোলের অখণ্ডতা বাঁচাতে যেটি সিমেন্টের ন্যায় কাজ করে সেটি ভূমি,জলবায়ু বা আলোবাতাস নয়,বরং জনগণের ধর্ম,দর্শন ও সংস্কৃতি। দেশের অখণ্ড ভৌগলিক মানচিত্র ভেঙ্গে যায়,আবার বিচ্ছিন্ন বহু ভূখণ্ড,বহু গোত্র ও বহু জনগোষ্ঠি একীভূত হয় সে আদর্শিক মানচিত্রের কারণে। ইসলামের পূর্বে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য খণ্ডিত ছিল নানা ভাষা ও নানা গোত্রের নামে। কিন্তু সে বিভক্ত মানচিত্রকে একীভূত করে সে ভূমিতে গড়ে উঠেছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তি। আরব, কূর্দি, ইরানী,তুর্কি তখন এক উম্মাহতে পরিণত হয়েছিল।পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদ,গোত্রীয়বাদ ও রাজতন্ত্রের হামলায় সে আদর্শিক মানচিত্র বাঁচেনি। ফলে বাঁচেনি সে বিশাল ভৌগলিক মানচিত্রও। একই কারণে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের ভূগোলও অখণ্ড থাকেনি,সেটি ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান এ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। আবহমান বাংলার ভৌগলিক মানচিত্র এক হলেও তার আদর্শিক মানচিত্রটি দ্বিখণ্ডিত। ফলে বাংলাও খণ্ডিত হয়েছে;একটি হিন্দুপ্রধান পশ্চিম বাংলায়,অপরটি মুসলিমপ্রধান পূর্ব বাংলায়। একাত্তরে পাকিস্তান খণ্ডিত হয়েছে,কিন্তু পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা একীভূত হয়নি। এবং পূর্ব পাকিস্তান ভারতে মিশে যায়নি।সেটি হয়নি আদর্শিক ও ধর্মীয় বিভক্তির কারণে
প্রতিটি আগ্রাসী দেশই তার ভূগোল বাড়াতে আদর্শিক মানচ্ত্রিটিও বাড়াতে চায়। শত্রুর হামলা তাই শুধু ভৌগলিক মানচিত্রের উপর হয় না,প্রচণ্ড হামলা হয় আদর্শিক মানচিত্রের উপরও। আদর্শিক মানচিত্রের উপর হামলাটি নীরবে হয়,সেখানে বোমা বা কামানের গর্জন থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্র ধ্বংসে এটি সীমান্ত-হামলার ন্যায়ই সমান ক্ষতিকর। এটিকে বলা যায় ঠান্ডা যুদ্ধ। উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে প্রায় তিরিশটি রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে এরূপ আদর্শিক হামলার কারণে। এ হামলায় শত্রুর সৈনিক রূপে কাজ করেছে সেক্যুলারিস্ট ও জাতীয়তাবাদীরা। একই স্ট্রাটেজী নিয়ে আফগানিস্তানের ভূগোল দখলের আগে সোভিয়েত রাশিয়া বহু আফগানের মনে সমাজতন্ত্রের রাজ্য বিস্তার ঘটিয়েছিল। পরে প্রবল বিক্রমে এসেছিল বিশাল সামরিক বাহিনী নিয়ে।
যে কোন দেশের সরকার ও জনগণের দায়িত্ব হলো ভৌগলিক ও আদর্শিক– এ উভয় মানচিত্রকে হেফাজত করা। নইলে স্বাধীনতা বাঁচে না।কারণ,একটি অপরটির পরিপূরক;ভৌগলিক মানচিত্র বিলুপ্ত হলে যেমন আদর্শিক মানচিত্র থাকে না। তেমনি আদর্শিক মানচিত্র বিলুপ্ত হলে ভৌগলিক মানচিত্রও বাঁচে না। তাই শুধু সেনাবাহিনী দিয়ে দেশ বাঁচানো যায় না। লড়াকু আদর্শিক সৈনিকও চাই। চাই সাহসী লেখক,কলামিস্ট, আলেম ও চিন্তাবিদ। সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল কোন সশস্ত্র যুদ্ধে নয়। বরং বিপুল সংখ্যক আদর্শিক সৈনিকের লাগাতর লড়াইয়ের ফলে,পাকিস্তানের পক্ষে তুমুল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটি সে সময়ের ইসলামী চিন্তানায়কেরা অতি সফল ভাবে লড়েছিলেন। আল্লামা ইকবাল,মাওলানা মহম্মদ আলী জওহরের ন্যায় বহু লড়াকু চিন্তানায়কগণ সেদিন সমগ্র ভারতব্যাপী প্যান-ইসলামিক চেতনা প্লাবন সৃষ্টি করেছিলেন। সে প্লাবনে বাঙ্গালী,পাঞ্জাবী,বিহারী,পাঠান,বেলুচ,সিন্ধি -প্রভৃতি ভাষাভাষি মুসলমান ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা ভূলে একাকার হয়ে গিয়েছিল।ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান। ইসলাম সেদিন সিমেন্টের কাজ করেছিল। কিন্তু ১৯৭১য়ে সেরূপ সৈনিক পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না,বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানটি তখন অধিকৃত হয়েছিল ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য ও ইসলামবিরোধী জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদীদের হাতে। একাত্তরের বহু আগেই এ ময়দান ভারত নীরবে দখল করে নিয়েছিল। বহু হাজার সাংস্কৃতিক সৈনিকের সমাবেশ ঘটিয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই,এবং তারা বিনাশ ঘটিয়েছিল প্যান-ইসলামিক চেতনার। যে সিমেন্ট ১৯৪৭য়ে ভারতীয় মুসলমানদের একতাবদ্ধ করেছিল তারা সেটি নীরবে সরিয়ে ফেলে। ফলে ১৯৪৭য়ের পাকিস্তান একাত্তরে বাঁচেনি। একই বিপদ ঘিরে ধরেছে একাত্তরের সৃষ্ট বাংলাদেশকেও।
তবে বাংলাদেশের বিপদটি আরো গভীর। পাকিস্তান খণ্ডিত হলেও একাত্তরের দুর্বলতা অবশিষ্ঠ পাকিস্তানের নাগরিকগণ বহুলাংশে কাটিয়ে উঠিয়েছে। একাত্তরের পরাজয় থেকে তারা বহু কিছু শিখেছে এবং এখন টিকে আছে পারমাণবিক বোমা, দূরপাল্লার মিজাইল ও শক্তিশালী সামরিক শক্তি নিয়ে। রয়েছে আদর্শের বলও। হাজার হাজার লড়াকু মোজাহিদ সৃষ্টি করতে পারে এমন ইসলামী দর্শনের বল সেখানে প্রবল। ফলে ভারতের পক্ষে এদেশটিকে নতজানু করা বা গিলে ফেলা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একাত্তরে যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে সাহস ভারতের আজ আর নেই। কিন্তু সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের অস্তিত্ব। কারণ,বাংলাদেশের হাতে সামরিক ও পারমাণবিক বল যেমন নেই,তেমনি দর্শনের বলও নাই। ইসলাম বাংলাদেশে লড়াকু মোজাহিদ সৃষ্টি না করে লক্ষ লক্ষ তাবলীগী সৃষ্টি করছে। আগ্রহ বাড়াচ্ছে সুফিবাদে। ফলে বিপুল সংক্ষ্যক মুসলিম অঙ্গিকারশূণ্য হচ্ছে ইসলাম ও বাংলাদেশের হেফাজতে। এবং বুদ্ধিজীবীরা খ্যাতি অর্জন করেছে ভারতের প্রতি নতজানু চরিত্রের কারণে। পাকিস্তানের মাত্র একটি সীমান্তে ভারত,আর বাংলাদেশের তিনটি সীমান্ত জুড়ে।সমগ্র স্থল সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল,ইয়াবা,হিরোইন ও মদই শুধু আসছে না,বুদ্ধিবৃত্তিক,সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক হামলাও চলছে।এক্ষেত্রে ভারতের বিপুল বিনিয়োগ। কারণ যে কোন সামরিক আগ্রাসনের চেয়ে এমন সাংস্কৃতিক হামলার ব্যয়ভার কম। ফলে ভারতের এতে আগ্রহও প্রচণ্ড।
মুসলিমবিরোধী নাশকতা যেখানে নীতি
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে বাঙালী হিন্দুদের মাঝে রেনেসাঁ এসেছিল। সে সাথে বেড়েছিল মুসলমানবিরোধী নাশকতাও। এটিই হিন্দুদের রাজনীতির স্থায়ী লক্ষ্য। মুসলমানদের কল্যাণ ভারতীয় হিন্দুগণ ১৯০৫ সালে যেমন চায়নি, তেমনি ১৯৪৭য়ে এবং ১৯৭১য়েও চায়নি। কল্যাণ চাইলে রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তি কেন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে মিছিল করবেন? ভারতীয় হিন্দুদের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে নিছক হিন্দু স্বার্থ ষোলকলায় পূর্ণ করার লক্ষ্যে,এবং সেটি মুসলমানদের ক্ষতি করে। ১৯৪৭ সালে মুসলমানগণ বাংলার বিভক্তকরণ চায়নি,তারা চেয়েছিল অখণ্ড বাংলা। কিন্তু সেদিন বাংলার বিভক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেটি কোলকাতা শহরসহ বাংলার বিশাল অংশকে ভারতভূক্ত করার লক্ষ্যে। অথচ তারাই বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিল ১৯০৫ সালে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করার কারণ,তাতে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের কল্যাণের সম্ভাবনা দেখেছিল।
মুসলমানদের প্রতি ভারত সরকারের মনোভাবটি যে কীরূপ সেটি সে দেশের শতকরা ১৫ ভাগ মুসলমানকে প্রশাসনে শতকরা ৩ ভাগের কম চাকুরি,মসজিদ ধ্বংস,মুসলিম বিরোধী ঘন ঘন দাঙ্গা,দাঙ্গাকালে মুসলিম গৃহে অগ্নিসংযোগ এবং মুসলিম রমনীদের ধর্ষণের মধ্য দিয়ে কি প্রকাশ পায় না? বাংলাদেশের প্রতি তাদের কি মনোভাব সেটিও কি তারা গোপন রেখেছে? মনের গোপন মটিভটি কখনোই গোপন থাকে না,আচরন ও কর্মের মধ্য দিয়ে সেটি প্রকাশ পায়। একাত্তরে ভারতের মূল লক্ষ্যটি কখনোই স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশের নির্মাণ ছিল না,বরং সেটি ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের শক্তিহানী করা এবং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শক্তি রূপে হিন্দুশক্তির উত্থান। একাত্তরে যুদ্ধজয়ের পর ভারত সেটি প্রমাণও করেছে। ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধটি ঢাল-তলোয়ারের ছিল না। দীর্ঘমেয়াদী এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পাকিস্তান বহুহাজার কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র জমা করেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে,এবং তার বেশীর ভাগই সে যুদ্ধে অব্যবহৃত ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানীরা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ,অতএব সে অস্ত্র ক্রয়ে ব্যয় হয়েছিল তাদের অর্থ। ফলে অস্ত্রের উপর মালিকানা ছিল তাদের। কিন্তু ভারত সে অস্ত্রের উপর বাংলাদেশের মালিকানা দেয়নি। তারা সমুদয় অস্ত্র ভারতে নিয়ে যায়।
ভারত বলে,একাত্তরের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমাণ্ড একত্রে কাজ করেছিল। কিন্তু কোথায় সে যৌথ কমাণ্ড? যৌথ কমাণ্ড থাকলে পাকিস্তানী অস্ত্র ভারতে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ভারত একা নেয় কি করে? বরং নিজেদের উদ্দেশ্যপূরণে মুক্তিবাহিনীকে তারা ব্যবহার করেছিল মাত্র। ভারতের লক্ষ্য,সামরিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে চিরতরে পঙ্গু রাখা। এমন একটি লক্ষ্য নিয়েই পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত যুদ্ধাস্ত্র ভারত বাংলাদেশকে দেয়নি। শুধু যুদ্ধাস্ত্র লুন্ঠনে নয়,ভারত তার বিবেকহীনতার প্রমাণ রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি লুন্ঠনের মধ্য দিয়েও। ভারতীয় সে লুন্ঠনের ফলেই ১৯৭৪য়ে নেমে এসেছিল ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এবং তাতে মারা পড়েছিল বহুলক্ষ মানুষ। বিবেকহীনতার আরো প্রমাণ,ফারাক্কাবাঁধ,টিপাইমুখ বাঁধ,বেরুবাড়ি দখল ও তালপট্টি দখল এবং বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। এগুলি কি বন্ধুত্বের লক্ষণ,এরূপ কাজ একমাত্র প্রতিবেশী শত্রু দেশই করতে পারে। প্রশ্ন হলো,বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন এক শত্রুসুলভ চেতনা নিয়ে ভারত কি বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে?
সাংস্কৃতিক দখলদারি
পতিতাপল্লি,ডাকাতপাড়া বা বাঘ-ভালুক কবলিত জঙ্গলের পাশে বসবাসের বিপদ অনেক। পতিতাপল্লির সংস্কৃতি যেমন প্রতিবেশীকে পাপের দিকে ডাকে,তেমনি বনের হিংস্র পশুও প্রতিবেশীর প্রাণনাশের সম্ভাবনা বাড়ায়। অনুরূপ বিপদ আগ্রাসী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে বসবাস করাতেও। সেখানে ভয় যেমন স্বাধীনতা হারানোর, তেমনি ধর্ম ও সংস্কৃতি হারানোর। দুর্বলদের প্রতি হানাদার হিংস্রপশুর করুণা থাকে না,তাদের ক্ষুধার্ত পেটে দুর্বলদের ঢুকাই নিয়ম। তেমনি দুর্বল প্রতিবেশীর প্রতি দরদ থাকে না আগ্রাসী প্রতিবেশীর। কাশ্মীর,হায়দারাবাদ,জুনাগড়,মানভাদর ও সিকিমের ন্যায় দুর্বল দেশগুলি তাই ভারত থেকে কোনরূপ করুণা পায়নি,বরং এদেশগুলি হারিয়ে গেছে দেশটির আগ্রাসী পেটে। একই কারণে একাত্তরের পর কোনরূপ করুণা পায়নি বাংলাদেশ। স্বাধীন রূপে বাঁচতে হলে ইতিহাসের এ শিক্ষাটি জরুরী। নইলে স্বাধীনতা বাঁচে না। নিজ ধর্ম নিয়ে বেড়ে উঠার সংস্কৃতিও বাঁচে না।
অমুসলিম দেশে মুসলমানের বসবাস যত অধিকই হোক, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেখানে যা বাড়ানো হয় সেটি ইসলাম নয়,বরং গোমরাহি তখা পথভ্রষ্টতা। পথভ্রষ্টতাই সেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি। ভারতে সেটিই ঘটছে। অমুসলিম দেশে বসবাসের মুল বিপদটি এখানেই।বিপদ বেড়েছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায়। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পকিস্তানের একটি ভৌগলিক সীমানার সাথে একটি সাংস্কৃতিক সীমান্তও ছিল। সে সীমান্ত ভারতীয় পণ্যের ন্যায় ভারতের সাংস্কৃতিক পণ্যের অনুপ্রবেশের উপর নিয়ন্ত্রন ছিল। কিন্তু একাত্তরে সাংস্কৃতিক সীমান্ত বিলুপ্ত হওয়ায় পর কূল উপচানো প্লাবনের ন্যায় সাংস্কৃতিক পণ্যপসারিরা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। আসছে বই ও সিনেমা, আসছে গায়ক-গায়ীকা ও নর্তকী, আসছে পত্র-পত্রিকা ও টিভি প্রচারণা। বাংলাদেশীদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদটি মূলত এখানেই। ফারাক্কা বাঁধ,টিপাইমুখ বাঁধ,সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার চেয়েও এটি ভয়ানক। কারণ এখানে ব্পিদ ঈমান হারানোর এবং সে সাথে পরকালে জান্নাত হারানোর। সে কান্ডজ্ঞানটুকু আছে বলেই জনসংখ্যায় বাংলাদেশের সমান হয়েও সীমান্তের সুরক্ষা বাড়াতে পাকিস্তান পারমানবিক বোমা বানিয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে জনসংখ্যায় সাত ভাগের এক ভাগ হয়েও তিরিশ বছর যাবত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আফগান জনতা।
কোন কিছুই এ পৃথিবীতে বীনামূল্যে মিলে না। স্বাধীনতা তো নয়ই। ভারতের ন্যায় আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ থেকে স্বাধীনতা তাই উপহার রূপে পাওয়ার বিষয় নয়। স্বাধীনতা অর্জনে বিপুল অর্থ, শ্রম ও রক্ত ব্যয়ের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক,সাংস্কৃতিক ও সামরিক বলও চাই। সেরূপ কোরবানী ও বল চাই স্বাধীন ভাবে টিকে থাকার জন্যও। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কান্ডজ্ঞান নজরে পড়ে না। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বরে যে ঘটনাটি মানব ইতিহাসে প্রধান ঘটনা রূপে ঘটেছিল সেটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় নয়,বরং ভারতীয় বাহিনীর বিজয়। এবং ভারতের সে বিজয়টি উৎসবে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু ভারতের বিজয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে এক জিনিষ নয় সে বোধটুকুই ক’জনের? রাজনীতি হচ্ছে আগ্রাসী ভারতের প্রতি নতজান কৃতজ্ঞতা নিয়ে। এমন আত্মসমর্পিত চেতনা নিয়ে কি স্বাধীনতা বাঁচে?
১৯৭১য়ে বহু হাজার ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে ঢুকেছিল। আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭২য়ে ভারত সে সৈন্য তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু দেশের আনাচে কানাচে সমাবেশ ঘটিয়েছে হাজার হাজার সাংস্কৃতিক সৈন্য। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে বহু লক্ষ সেক্যুলার এনজিও-কর্মী। দিন দিন তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে ১৯৭২য়ে তাদের সামরিক দখলদারি শেষ হলেও সাংস্কৃতিক দখলদারি শেষ হয়নি। বরং বিপুল ভাবে বেড়েছে। অথচ সরকারের ও নাগরিকদের দায়িত্ব শুধু দেশের ভৌগলিক সীমান্ত পাহারা দেওয়া নয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো,জনগণের চেতনা-রাজ্য পাহারা দেওয়াও। সেটি সুস্থ্য ঈমান-আক্বিদা নিয়ে নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার স্বার্থে।
ভৌগলিক সীমান্ত পাহারায় অবহেলা হলে অধিকৃত হয় দেশ,তখন আসে রাজনৈতিক পরাজয় ও গোলামী। এমন অধিকৃত দেশে জনগণের রাজস্বের অর্থ ব্যয় হয় জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে। চেতনা রাজ্যে তখন দখলদারি বাড়ে শয়তানী শক্তির। ব্রিটিশ শাসনামলে তো সেটিই হয়েছিল। নমরুদ,ফিরাউনগণ তো এভাবেই দেশ-দখলের সাথে সাথে মানুষের মনের রাজ্যও দখল করেছিল,এবং নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ভগবানরূপে। একই ভাবে মুসলিম দেশে নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছে সেক্যুলারিস্টগণ। এদের কারণে জনগন শুধু ইসলাম থেকেই দূরে সরেনি, বরং আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিতে। সে বিদ্রোহকে ব্যাপকতর ও দীর্ঘজীবী করা স্বার্থেই পুঁজিবাদী,সমাজবাদী,জাতীয়তাবাদীরা ইসলামের সনাতন শিক্ষার প্রচারকে নিষিদ্ধ করে। কারণ সে সনাতন ইসলামে যেমন জিহাদে আছে,তেমনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠার উপর বাধ্যবাধকতাও আছে। বাংলাদেশের আওয়ামী বাকশালী সরকার তাই দেশে জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করছে। মুজিব নিষিদ্ধ করেছিল সকল ইসলামী দল। একই উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বহুদেশ নিষিদ্ধ করেছে মিশরের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সৈয়দ কুতুব শহীদের বই। এবং কম্যুনিষ্ট শাসনামলে সোভিয়েত রাশিয়া হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসাকে ঘোড়ার খোয়ার বানিয়েছিল এবং নিষিদ্ধ করেছিল কোরআনচর্চা।
ঘরের শত্রু
সাংস্কৃতিক সীমান্ত বিলুপ্তির ফলে ভারতীয় টিভি সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশীদের বেডরুমে সরবে ও সশরীরে কথা বলার। সাংস্কৃতিক সীমান্ত বলে বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশের যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত আছে, এবং সেটির প্রহরারও যে প্রয়োজন রয়েছে সে হুশটিও সরকারের নাই। কারণ একটাই। আর তা হলো,বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ ভারতীয়দের থেকে এক ভিন্ন ভূগোলে বাস করলেও তাদের চেতনার বা আদর্শের ভূগোলটি এক ও অভিন্ন। সে ভূগোলে কোন সীমান্ত নেই, ফলে প্রহরাও নাই। পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতি আর বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তারা এক অভিন্ন মনে করে। তেমন এক অভিন্ন সংস্কৃতির ধারণা নিয়েই তারা কবি রবীন্দ্রনাথের গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত বানিয়েছে। এভাবে বাংলাদেশের সরকার ও সংস্কৃতির উপর যাদের দখলদারি তারা পরিণত হয়েছে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ারে। এরাই বাংলাদেশের ঘরের শত্রু।
বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের অভিযোগ,১৯৪৭ সালে ভারতের সাথে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার সাথে ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনটি গড়া হয়েছিল নিছক সাম্প্রদায়ীক চেতনায়। তারা পাকিস্তানের মানচিত্রে যেমন সাম্প্রদায়ীকতার গন্ধ পায়,তেমন গন্ধ পায় পাকিস্তানসৃষ্ট বাংলাদেশের মানচিত্রের মাঝেও। দেশের আওয়ামী-বাকশালীগণ নিজেদেরকে এরূপ সাম্প্রদায়ীক চেতনার উর্দ্ধে মনে করে, ফলে পাকিস্তানের গড়া বাংলাদেশের ১৯৪৭ সালে ভৌগলিক মানচিত্র তাদের কাছে বেমানান মনে হয়। বাংলাদেশের সীমানা বিলুপ্ত করতে পারছে না স্রেফ জনগণের ভয়ে। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের চেতনায় ভারতসেবী বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের ন্যায় ইসলামী চেতনা বিলুপ্ত হয়নি,ফলে মারা পড়েনি ১৯৪৭য়ে ভারত-বিভক্তির যৌক্তিকতার ধারণাটিও। জনগণের মনে সে চেতনাটি প্রবল ভাবে বেঁচে আছে বলেই বেরুবাড়ী ও তালপট্টির উপর ভারতীয় দখলদারি, ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধ এবং বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়।
আওয়ামী-বাকশালীগন জানে,ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত বিলুপ্ত হলে তাদের ঝামেলাটি কমবে। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রাজনৈতিক শত্রুদের শায়েস্তা করার দায়ভারটি তখন সরাসরি ভারত নিয়ে নেবে। ফলে তাদের দমনে কোন রূপ বেগ পেতে হবে না। যেমনটি পেতে হয়নি কাশ্মীরের ভারতসেবী ফারুক আব্দুল্লাহকে।ভারতবিরোধীদের শায়েস্তা করতে কাশ্মীরের শ্রীনগর,বারামোল্লা,আনন্দনাগ,জম্মুর মত নগরগুলির রাজপথে,এমনকি নিভৃত পল্লিতে মোতায়েন করা হয়েছে পাঞ্জাব,উত্তর প্রদেশ,রাজস্থান,হরিয়ানা,বিহার ও অন্যান্য ভারতীয় প্রদেশ থেকে নেয়া ৬ লাখের বেশী সৈন্য। বাংলাদেশের ভৌগলিক মানচিত্র বিলুপ্ত হলে ঢাকার রাজপথেও তখন ভারতীয় সৈন্য শোভা পেত। ফারুক আব্দুল্লাহর মত শেখ হাসিনাও তখন নিরাপদে আজীবন গদীতে থাকতে পারতেন। নির্বাচনি জয়ের এত ঝামেলা তাঁকে পোহাতে হতো না,সেটি সুচারু ভাবে সামাল দিত ভারত। কিন্তু অখণ্ড ভারত নির্মানের সে লক্ষ্যে পৌছতে হলে বাংলাদেশের মুসলিম মানস থেকে ইসলামী চেতনার বিলুপ্তি জরুরী। তখন বিলুপ্ত হবে বাংলাদেশের আদর্শিক মানচিত্র। ভারত এবং ভারতপন্থি বাঙালী জাতিয়তাবাদীরা জানে,বাংলাদেশের ভূগোল পরিবর্তের মূল বাধাটি আসবে ইসলামী চেতনাধারীদের থেকে। ভারতের যে কোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকে তারা জিহাদে পরিণত করবে। ভারত সে প্রতিবাদী চেতনার বিলুপ্তি চায়। সে লক্ষ্যেই দখলদারি জমিয়েছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের মিডিয়া,সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মাঝে ভারতসেবী মনভাব তো সে দখলদারিরই প্রমাণ। বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে করিডোর বা টিপাইমুখ বাঁধের পক্ষে সমর্থণ দিতেও এরা লজ্জাবোধ করে না। তারা সোচ্চার শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার বিরুদ্ধেও। বাঘ–ভালুকের ন্যায় শত্রু শক্তিও খবর দিয়ে হামলা করে না। ১৯৭১’য়ের ফেব্রেয়ারীতেও কেউ কি ভেবেছিল, পূর্ব–পাকিস্তান ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? সে ধারণা কি ১৯৭০’য়ের নির্বাচনেও কারো মুখে উচ্চারিত হয়েছিল? অথচ সে লক্ষ্যে কাজ চলছিল ১৯৪৭ সাল থেকেই –যা মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে ১৯৭২’য়ের ১০ জানুয়ারির সহরোওয়ার্দ্দী উদ্দানের জনসভায় ঘোষণা দেন (লেখক নিজ কানে সেটি শুনেছেন)। শত্রু ধাপে ধাপে এগুয়। ১৯৭১য়ে ভারতীয় পরিকল্পনার প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে মাত্র। ভারত এখন দ্বিতীয় পর্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে্। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে কতটা বিপন্ন সেটি কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে?