সাংবাদিক সায়েরকে সেনা কর্মকর্তার খোলা চিঠি

খোলা চিঠি

প্রিয় জুলকারনাইন,

নর্থ কোরিয়ান বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ পুনঃস্থাপনের পর ভিপিএন দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঢু মারলাম। অনেক পোস্টের ভীড়ে তোমার পোস্টগুলো চোখে পড়লো। দেশের এই ক্রান্তিকালে তোমরা যে কাজ করে যাচ্ছো, আল্লাহ যেন তার যথাযথ প্রতিদান তোমাদেরকে দেন।

তোমরা তো অনেক করলে বা করছো এখনও। সেনাবাহিনীতে থেকেও আমি কিছু করতে পারলাম না। একবার ভাবলাম, সামরিক পোশাক গায়ে দিয়েই মিছিলকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে সংহতি জানাই। এতে অবশ্য সাথে সাথেই ভাইরাল হয়ে যেতাম নিঃসন্দেহে! কিন্তু তারপরই সরকারের খড়গহস্ত নেমে আসতো আমার ওপর, আমার পরিবার সহ চৌদ্দগুষ্টির ওপর। তাই ঝুঁকি নেয়ার সাহস আমার নেই, এটা আমি অকপটেই স্বীকার করি। ভাবছিলাম, ১৯৭১ সালের কথা। সে সময় সশস্ত্রবাহিনীতে যারা কর্মরত ছিলেন, তারা কিন্তু বেতন-ভাতা,নিরাপদ জীবন, পরিবারের মায়া সব কিছু উপেক্ষা করেই যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। আমি তাদের মতো হতে পারলাম না, এই মানসিক যন্ত্রনা আমাকে অনেক ভোগাবে। অবশ্য এটাও সত্য যে, পাকিস্তানী জান্তা কিন্তু আমাদের বীরদের পরিবারকে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি যেটা এই নর্থ কোরিয়ান আওয়ামী লীগ অনায়াসেই করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের সব অংগকে তারা আমার পরিবার ও আত্মীয়দের পেছনে লেলিয়ে দিবে। আমি জানিনা, সামরিক পোশাক পরে আন্দলোনের সাথে সামিল হলে সেটা আন্দোলনকে কতটুকু বেগবান করতো, কিন্তু এতটুকু নিশ্চিত যে তার বিপরীতে যে অত্যাচার আমার পরিবারের ওপর আসবে (নিজের টা গায়ে মাখলাম না), সেটার ঝুঁকি নেয়ার মতো সাহস আমার নেই। আমার মানসিক পীড়নের উৎস এটাই।

অবশ্য এটা আমার বেশীর ভাগ কোর্সমেট এবং সিনিয়র জেনারেলদেরকে বিচলিত করে না। তারা ব্যস্ত আছেন তাদের সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলোকে সমুন্নত রাখার জন্য। আর এ জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন এই জালিম সরকারকে যেনতেন প্রকারে টিকিয়ে রাখার জন্য। কারণ, জনগণ এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না, সরকারও না, শুধু গুরুত্বপূর্ণ হলো সুযোগ-সুবিধা। গত ১৫ বছরে সেনাবাহিনীর এই সর্বনাশটাই সুকৌশলে করে দিয়েছে ভারতীয় ’র’।

আর এর ফলাফল তুমি কিন্তু দেখছো হাতে নাতে। আমরা ২০০৯ এ আমাদের ভাইদেরকেই বাঁচাতে পারি নাই, আর তুমি আশা করছো ২০২৪ সালে সেনাবাহিনীর হাত ধরে পরিবর্তন আসবে। মিছে আশা হবে সেটা। আমরা জনতা কি রক্ষা করবো, কুকি চীন ইদানীং আমাদের ক্যাম্পে এসে হামলা চালিয়ে যায়, আমাদের এতটাই দুরাবস্থা। আমরা শুধু পারি নিজ দেশের জনতার ওপর সাহস দেখাতে।

টিভিতে ব্রিগেডিয়ার জাকারিয়ার (কমান্ডার ১৪ সতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড) দম্ভোক্তি দেখলাম। অনায়সেই তিনি আন্দোলনকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে দিলেন। আমি অবাক হইনি। এই ভদ্রলোকের বাড়ি গোপালগঞ্জ। ২০১১-২০১২ সালে আর ই ব্যাটালিয়নের টুআইসি হিসেবে, যমুনার তীরে অবস্থিত সেনানিবাসে পোস্টিং আসলেন। তখন তিনি মেজর। এসেই চারপাশে আওয়াজ তুললেন, আমার পিতা ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষক। ব্যস, আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাকে যতটুকু চিনেছি জেনেছি, তিনি স্বার্থের জন্য নিজের মাকেও বিক্রি করে দিবেন। তাই এদের দম্ভোক্তিতে অন্ততঃ আমি বিস্মিত হইনা।

আমার অনুজ অফিসারদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করি। ওরাও এসবের বিরুদ্ধে কিন্তু ওরাও অসহায়। মুখ ফুটে কিছু বলার অবস্থায় ওরা নাই। ভাবলাম, দৈবক্রমে যদি কোনো একজন ফর্মেশন কমান্ডার এই আদেশ না মেনে তার ফর্মেশন নিয়ে জনতার কাতারে দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো একটা বড় ধরণের নাড়াচাড়া পড়তো। বাস্তবতা হলো, সেই ফর্মেশন কমান্ডার তার নিজের অধীনস্থঃ সবাইকে আদৌ পাশে পেতেন কিনা, সেটা নিয়েও আমার বিস্তর সন্দেহ আছে। ‘র’ এভাবেই আমাদের একতা কে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। চালাক সেনাবাহিনী এখন নিজ দেশের জনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার পায়তারা করছে, আবার তাদেরই ছত্রছায়ায় র‍্যাব, পুলিশ আর বিজিবি যখন মরণখেলায় মাতে, তখন তারাও নিছক দর্শকের ভূমিকায় থাকছে।

আমি লজ্জিত সায়ের। আমাকে ক্ষমা করো। আমার মাথা হেট হয়ে গেছে, আয়নায় নিজেকে দেখলেও খারাপ লাগে। এই ডিফাইনিং মুহুর্তে দেশ যখন আক্রান্ত, তখন আমি কিছুই করতে পারলাম না। শুধু দু’কলম লিখে হালকা হবার বৃথাই চেষ্টা করলাম। মনে রেখো সায়ের, এ দুর্যোগ একদিন কেটে যাবে। ইতিহাস তখন স্বাক্ষ্য দিবে, কারা দেশপ্রেমিক ছিলো আর কারা ছিলো নর্থ কোরিয়ান আওয়ামী লীগের দালাল।

ভালো থেকো ভাই। আমার জন্য দোয়া করার দরকার নেই। দোয়া আমি ডিযার্ভ করিনা। দেশের জন্য করো। আল্লাহ তোমাকে এবং তোমার পরিবারকে সুরক্ষায় রাখুক।

সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরের ফেসবুক পেজ