‘সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার ট্রাইব্যুনাল ছাড়া অন্য কোথাও সম্ভব নয়’

logo

স্টাফ রিপোর্টার

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সোমবার

mzamin

facebook sharing button

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার কেবল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই হতে পারবে, অন্য কোথাও নয়। এমন কি সামরিক আদালত কিংবা দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আদালতেও সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গতকাল আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনকালে এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর এ মন্তব্য করেন। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। আজ সোমবার আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হবে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া।

সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করে বলেন, ডিফেন্স সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বিচার কি এ ট্রাইব্যুনালে হবে, নাকি আলাদা ট্রাইব্যুনালে? জবাবে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল বলেন, এই বিতর্ক অহেতুক। আইন সংশোধন করে ডিফেন্সের অফিসারদের বিচারকে এর আওতায় আনা হয়েছে। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারা আদালতে পড়ে শোনান। প্রসিকিউটরের বক্তব্যের পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মন্তব্য করেন, “দ্যাটস অল।”

সূচনা বক্তব্যে তাজুল ইসলাম বলেন, আজ আমরা স্মরণ করছি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১৫০০ শহীদ ও হাজার হাজার ছাত্র-জনতা যারা পঙ্গুত ও অন্ধত্ববরণ করেছে। এসব অপরাধগুলো ছিল পূর্বপরিকল্পিত, পদ্ধতিগতভাবে ও ব্যাপকমাত্রায় সংগঠিত এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালিত। উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ করা, ভয় সৃষ্টি করা এবং জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করা।

তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে আশুলিয়া থানা এলাকায় ২৯ জন নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা ও শিশুসহ বহুসংখ্যক মানুষকে গুরুতর আহত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত ৫ই আগস্ট অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ০৫টি মৃতদেহ এবং ০১ জন জীবিত ও গুরুতর আহত ব্যক্তিকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয় শুধু আলামত ধ্বংস বা অন্যদের ওপর দায় চাপানোর উদ্দেশ্যে।

এ সময় যারা শহীদ হয়েছেন, তারা হলেন সাজ্জাদ হোসেন (সজল), আস সাবুর, তানজীল মাহমুদ সুজয়, বায়েজিদ বুসতামি, আবুল হোসেন ও একজন অজ্ঞাত। এ ছাড়া ৪ঠা আগস্ট আশুলিয়া থানার বাইপাইল মোড় হতে ইপিজেড, বাইপাইল মোড় ও আশপাশের এলাকাসহ আশুলিয়া থানা এলাকায় নিরীহ নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করে মো. শাহাবুল ইসলামকে হত্যা ও শিশুসহ অনেককে গুরুতর আহত করে।

তিনি বলেন, আমরা তদন্তে পেয়েছি জলন্ত লাশের ওপর আগুনের তীব্রতা বাড়ানোর জন্য আসামিরা শুকনো কাঠের টুকরা নিক্ষেপ ও একজন জলন্ত সিগারেট নিক্ষেপ করে। লাশ পোড়ানোর অপরাধ এতটাই গুরুতর যে, তা বিশ্ব সমপ্রদায়ের মধ্যেও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিস্টদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বিচার কার্যক্রম পুরনো রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রাষ্ট্র একটি ন্যায়সঙ্গত ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এটি প্রমাণ করে যে, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তিকেও আইনসম্মত জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনমনে আস্থা তৈরি হবে যে ন্যায়বিচার কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতদুষ্ট বা প্রভাবিত নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, দৃঢ় এবং নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং অপরাধ করলে তাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন চিরজীবী হোক এটিই প্রত্যাশা করি।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, এই মামলায় মোট ৫৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ পরিবার সাক্ষী ৭ জন, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ৪ জন, আহত সাক্ষী ৪ জন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাক্ষী ৭ জন, অজ্ঞাতনামা ২টি লাশ দাফনকারী সাক্ষী ২ জন, পুলিশ সাক্ষী ৪ জন, মসজিদে এলানকারী সাক্ষী ২ জন, মসজিদের মোয়াজ্জিন সাক্ষী ১ জন, সাংবাদিক সাক্ষী ১ জন, ভিডিও দেখে ভিকটিম শহীদ আস সাবুরকে শনাক্তকারী সাক্ষী ১ জন, জব্দ তালিকার সাক্ষী ১২ জন, জবানবন্দি লিপিবদ্ধকারী সাক্ষী ২ জন, বিশেষজ্ঞ সাক্ষী ৩ জন, বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ১ জন, তদন্ত কর্মকর্তা ১ জন।

যেসব ডকুমেন্ট দাখিল: মামলা প্রমাণে যেসব ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়েছে, সে সবের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, জব্দ তালিকা-২০ টি, ভিডিও ক্লিপ ২০ টি, অডিও ক্লিপ ২০ টি, স্থির চিত্র ১৮ টি, পত্রিকার নিউজ ৯ টি, শহীদ গেজেট ১ টি, আহতদের গেজেট ১০ টি, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন ২ টি, অধিকার রিপোর্ট ১ টি, গুম কমিশনের রিপোর্ট ১টি, বিভিন্ন বই ১ টি, ফরেনসিক প্রতিবেদন ১৫ টি, একটি চার্জারসহ ৬ রাউন্ড গুলি।

ইনু ও হানিফের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় কুষ্টিয়ায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউটর বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-১কে অবহিত করেছেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন। পরে তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কুষ্টিয়ায় জুলাই আন্দোলন চলাকালে ৭ জনকে হত্যা এবং অনেককে আহত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আগামী ২৮শে সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানান তিনি।

আবু সাঈদের মামলা:  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে রংপুরের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মামলায় এসআই আনিসুর রহমানের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। আগামী ২১শে সেপ্টেম্বর পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল-২।

চানখাঁরপুলের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ: গত বছরের ৫ই আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। আগামী ১৮ই সেপ্টেম্বর মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুরাল-১।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here