৩১ মে ২০২৩, ০৬:১৪ পিএম
মিয়ানমারে দুই বছর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়া সামরিক বাহিনীর সামনে নতুন সংকট হাজির হয়েছে। একদিকে জনগণের ব্যাপক বিরোধিতার কারণে বাহিনীর নিয়োগ কমে গেছে, অন্যদিকে সেনা সদস্যরা চাকরি ছেড়ে সামরিক বাহিনীবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোতে যোগ দিচ্ছেন।
দেশটির সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন সেনা সদস্যের সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। বিশেষ সেই সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করলে যে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে— তা হলো মিয়ানমারের রাজনীতি ও সাধারণ জনগণের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব।
সামরিক বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা নায়ে অউং বিবিসিকে জানান, দু’বার পালানোর চেষ্টা করে দ্বিতীয়বার সফল হয়েছেন তিনি। প্রথমবার পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর ঘাঁটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাকে বেধড়ক মারধর করেন। সেই সঙ্গে তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেও গালিগালাজ করেন তারা।
‘এখন আর কেউ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চান না। বরং তাদের নিষ্ঠুর আচরণ ও অন্যায়-অবিচারকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন মিয়ানমারের সাধারণ লোকজন,’ সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেন নায়ে অং।
মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী একটি থাই গ্রামের গোপন আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে অবস্থান করছেন নায়ে অং। তিনিসহ আরও শতাধিক সেনা সদস্য বর্তমানে রয়েছেন সেই শিবিরে; যারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী থেকে পালিয়ে এসেছেন। মিয়ানমারে সক্রিয় সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর জোট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (পিডিএফ) শিবিরটি পরিচালনা করছে।
থাইল্যান্ড-মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় এমন আরও কয়েকটি গোপন আশ্রয় শিবির রয়েছে জানিয়ে নায়ে অং বলেন, ‘আমার এক বন্ধু একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য। (বাহিনী থেকে) পালানোর পর প্রথমেই আমি তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম। তারপর তার কাছ থেকে ঠিকানা ও সুপারিশ নিয়ে থাইল্যান্ডের এই আশ্রয় শিবিরে উঠেছি।’
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রপন্থী এনএলডি সরকারকে হটিয়ে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং সেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন।
সামরিক বাহিনীবিরোধী ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট অব মিয়ানমারের (নাগ) কয়েকজন প্রতিনিধি বিবিসিকে বলেছেন, অভ্যুত্থানের পর গত ২ বছরে সরকারি চাকরি ছেড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন ১৩ হাজারেরও বেশি সেনা ও পুলিশ সদস্য। তারা যেন নিজেরা টিকে থাকতে পারেন এবং বাহিনী থেকে অন্যান্য সদস্যদেরও নিয়ে আসতে পারেন, সেজন্য নাগের পক্ষ থেকে তাদের নগদ আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে।
থাইল্যান্ডের গোপন সেই আশ্রয় শিবিরের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য মাউং সেইন। ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সে। বিবিসিকে মাউং বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল। এছাড়া আমি চাইতাম, আমার পরিবার যেন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। এ কারণেই সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম।’
একসময় সাধারণ জনগণের মনে সামরিক বাহিনীর প্রতি সম্মান থাকলেও ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রপন্থী সরকারকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে যে জনবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল—তা নিষ্ঠুরভাবে দমনের পর থেকে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ এখনকার সামরিক বাহিনীকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছে উল্লেখ করে মাউং বলেন, ‘একদিন অনলাইনে দেখলাম লোকজন আমাদের ‘মিলিটারি কুকুর’ বলে সম্বোধন করছে। এ ব্যাপারটিতে আমি খুব অপমান ও দুঃখ বোধ করলাম এবং ওই দিনই বাহিনী থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।’
প্রসঙ্গত, কাউকে কুকুর বা এই জাতীয় চতুষ্পদী প্রাণীর নামে সম্বোধন করা মিয়ানমারের সংস্কৃতিতে বড় ধরনের অপমান বলে গণ্য করা হয়।
সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে সেনা ও পুলিশ সদস্যদের গুলিতে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৪ হাজার মানুষ। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি রয়েছে— এমন বেশ কয়েকটি গ্রাম জান্তার নির্দেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মাউং সেইন জানান, বাহিনীর ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে হত্যা ও গ্রামে অগ্নিসংযোগ সম্পর্কিত কয়েকটি অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
‘আমার সামনে কোনো উপায় ছিল না। সেনা সদস্য হিসাবে আমি আমার ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিলাম,’ বলেন মাউং সেইন। পাশাপাশি তিনি আরও জানান, বর্তমানে সামরিক বাহিনী দুর্বল অবস্থায় আছে।
বিবিসির অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছায়া সরকার নাগের সহায়তায় ইতোমধ্যে অনেকের ধারণার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে পিপল’স ডেমোক্রেটিক ফোর্স (পিডিএফ) এবং পিডিএফের তৎপরতার কারণে ইতোমধ্যে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা।
এক সময় মিয়ানমারের মাগওয়ে এবং সাগাইং প্রদেশ থেকে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন এই দুই প্রদেশের তরুণ-তরুণীরা পিডিএফের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
মাউং সেইন জানান, পালানোর আগে সর্বশেষ একটি অভিযানে যেতে হয়েছিল তাকে। সেটি ছিল পিডিএফের একটি ঘাঁটি ধ্বংসের মিশন। কিন্তু সেই মিশন সফল হয়নি। পিডিএফের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পিছু হটতে বাধ্য হন।
‘তাদের (পিডিএফ) রণকৌশল সামরিক বাহিনীর চেয়ে ভালো। এই উন্নত রণকৌশলই পিডিএফকে এগিয়ে রেখেছে।’
উন্নত এই রণকৌশলের সঙ্গে যোগ হয়েছে সাধারণ জনগণের সমর্থন। এমনকি সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত নানা গোয়েন্দা তথ্যও বর্তমানে পিডিএফকে সরবরাহ করছেন গ্রামের সাধারণ জনগণ।
ক্যাপ্টেন জায়ে থু অউং ১৮ বছর মিয়ানমারের বিমান বাহিনীতে ছিলেন। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের এক বছর পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চাকরি ছেড়ে পিডিএফে যোগ দেন তিনি। থাইল্যান্ডের যে শিবিরটির বিষয়ে এই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সেটির অন্যতম পরিচালকও তিনি।
‘দেশজুড়ে তারা (সামরিক বাহিনী) হামলার শিকার হচ্ছে এবং পাল্টা হামলা চালানোর মতো পর্যাপ্ত জনবলও তাদের নেই। এ কারণেই তারা আমাদের ওপর ঘন ঘন বিমান হামলা চালাচ্ছে,’ বিবিসিকে বলেন ক্যাপ্টেন অউং।
তার এই মন্তব্যের সত্যতা মিলেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশজুড়ে দুই শতাধিক বিমান হামলা করেছে সামরিক জান্তা বাহিনী। এর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল গত এপ্রিলে সাগাইং প্রদেশে। এতে ১৭০ জন নিহত হয়েছিলেন। বিবিসিকে ক্যাপ্টেন অউং বলেন, ‘বিমান বাহিনী ছাড়া বর্তমান সামরিক সরকার টিকতে পারবে না।’
ক্যাপ্টেন অউং বলেন, আঠারো বছর আগে তিনি যখন বিমান বাহিনীতে যোগ দেন— সেসময় তাকে নিয়ে রীতিমতো গর্ব করতেন তার পরিবারের সদস্যরা। চাকরিতে ঢোকার পর সহকর্মী হিসাবে যেসব ক্যাডেটকে পেয়েছিলেন— তাদের অধিকাংশই ভালো লোক ছিলেন না বলেও দাবি করেন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা।
‘বিমান বাহিনীতে ঢোকার পর যাদের সহকর্মী হিসাবে পেয়েছিলাম, তাদের মধ্যে ভালো মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি— খারাপ লোকের সংখ্যা ছিল খুব কম। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে সব বদলে গেছে। যাদের আমি আমার বন্ধু মনে করতাম— তাদের প্রায় সবাই এখন এক একজন দানবে পরিণত হয়েছেন।’
‘আমার ইউনিটে আমিই একমাত্র লোক— যে চাকরি থেকে পালিয়ে পিডিএফে যোগ দিয়েছে। আমার ইউনিটের অন্যান্য বন্ধুরা এখন আমার লোকজনকে হত্যার জন্য অভিযান চালাচ্ছে।’
বিবিসি বলছে, পিডিএফের এসব প্রশিক্ষণ শিবিরের খরচ আসছে মূলত মিয়ানমারের প্রবাসী নাগরিকদের সহায়তা থেকে। এছাড়া গতানুগতিক ক্রাউডফান্ডিং এবং অন্যান্য উৎস থেকেও সহায়তা পাচ্ছে পিডিএফ।
‘আর্থিক তহবিল আমাদের একটি সমস্যা। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো, অর্থ থাকলেও আমরা মিলিটারি গ্রেড অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান পাচ্ছি না। সামরিক বাহিনী এই দিকে আমাদের থেকে এখনও এগিয়ে আছে,’ বিবিসিকে বলেন ক্যাপ্টেন অউং।