সরেজমিন: গঙ্গাচড়া—১ মসিউরের কাছে রংপুরের ‘বহুত মানুষ’ টাকা পায়

মসিউর রহমান রংপুর জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। বিষয়টি স্বীকার করে ২৯ জানুয়ারি কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আফতাব উজ জামান বলেন, মসিউর রহমান পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন আবু বক্করকে। তাঁর (মসিউর) কিছু টাকা তাঁদের কাছে আছে। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি ঝামেলায় (জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার বুঝিয়েছেন) পড়লেন। এরপর আর কথা হয়নি।

সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়ায় গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী মসিউরের বিরুদ্ধে এমন ‘অর্থ কেলেঙ্কারি’র অভিযোগ তোলেন। তাঁদের অভিযোগ, সরকারি চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, স্কুল-কলেজ সরকারীকরণসহ বিভিন্ন খাতে ঘনিষ্ঠ লোক ও প্রতিনিধির মাধ্যমে টাকা নেন মসিউর। অধিকাংশই চাকরি পাননি। টাকাও ফেরত পাননি।

রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মসিউর রহমান একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মসিউরকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদ্যসহ সব পদ–পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

মসিউরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির কার্যালয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সিদ্দিক (আবু বক্কর) আমাকেও বলেছে, সে তার ভাবিকে (রাকিবা নাসরিন) কিছু টাকা দিয়েছে। কিন্তু তাঁর কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এটা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়, আদৌ টাকা দিয়েছে কি না। যদি সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে টাকা ফেরত দেব।’

২০১৯ সালে কোলকোন্দর তাকিয়া শরিফ দাখিল মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণির পাঁচটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তখন মাদ্রাসায় সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি হিসেবে বিদ্যোৎসাহী সদস্য ছিলেন বড়বিল ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সভাপতি আওরঙ্গজেব (বাদশা)।

মাদ্রাসাসংলগ্ন বাসিন্দা সামিউল হকের অভিযোগ, তিনি অফিস সহকারী পদে চাকরির জন্য ৫ লাখ, দিলরুবা আক্তার আয়া পদে ৩ লাখ, মিজানুর রহমান অফিস সহায়ক পদে ২ লাখ ৭০ হাজারসহ আরও দুজন টাকা দেন সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি আওরঙ্গজেব ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আমিনুর রহমানকে। কিন্তু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সময় জটিলতায় ওই নিয়োগ হয়নি। তাঁরা টাকা ফেরতও দিচ্ছেন না।

আওরঙ্গজেব চাকরির জন্য টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্য, সংসদ সদস্যের নির্দেশে পাঁচজন প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও তিনি। পরে অধ্যক্ষসহ তিনি ঢাকায় গিয়ে মসিউরের বাড়িতে এই নিয়োগের জন্য সাড়ে ১৩ লাখ টাকা দিয়ে আসেন।

তবে সংসদ সদস্য মসিউর রহমানের ভাষ্য, আওরঙ্গজেব বিভিন্ন জনের কাছে নিয়োগের নামে টাকা নিচ্ছে—এমন তথ্য জানার পর তাঁকে কমিটিতে রাখা হয়নি। তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

অবশ্য মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম নিয়োগের টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তবে তাঁর দাবি, এটি সংসদ সদস্য ও তাঁর প্রতিনিধির বিষয়। এতে তাঁর সম্পৃক্ততা কম।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, গঙ্গাচড়া উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগসহ সবকিছু মসিউরের ইচ্ছা ও পছন্দে। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কমিটির প্রধান তাঁর পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠজনেরা। নিয়োগ–বাণিজ্যসহ এসব কমিটির বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত এক বছরে গঙ্গাচড়া উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, আয়া ও শেখ রাসেল ল্যাব অপারেটর পদে ৫৩ জন নিয়োগ পেয়েছেন।

গঙ্গাচড়ার শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে) নিয়োগ থাকলে মসিউর রহমান তাঁর আস্থাভাজন ব্যক্তিকে ডিও লেটার দিয়ে সভাপতি করেন। যেমন ঠাকুরাদহ স্কুল অ্যান্ড কলেজে সভাপতি হয়েছেন তাঁর আস্থাভাজন উপজেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান (দুলু)। এই প্রতিষ্ঠানের তিনটি পদে নিয়োগ–বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।

তবে নিয়োগ–বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি করেন মসিউর রহমান। তাঁর ভাষ্য, তিনি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি নন। তাই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর হস্তক্ষেপ নেই।

২০১৯ সালে সংসদ সদস্যের ডিও লেটারে গঙ্গাচড়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার সভাপতি হন উপজেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি আলী আসিফ। তিনি তিনটি পদে নিয়োগের জন্য স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান, কাদের হোসেন ও বাদল মিয়ার কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা নেন। কিন্তু তাঁদের চাকরি হয়নি। তবে আলী আসিফ দাবি করেন, তিনি টাকা ফেরত দিয়েছেন।

স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, উপজেলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সংসদ সদস্যের স্থানীয় প্রতিনিধি (এপিএস) মমিনুর রহমান হস্তক্ষেপ করছেন। মমিনুর ছাড়াও মসিউর রহমানের পিএ জাকির হোসেন, সাবেক এপিএস আব্দুর রাজ্জাক ও শামছুল হকের বিরুদ্ধেও নিয়োগ–বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত হওয়ার অভিযোগ আছে।

স্কুল সরকারীকরণে টাকা নেওয়ার অভিযোগ

২০১৭ সালে গঙ্গাচড়ায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি কলেজ সরকারীকরণ হয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ নিয়েও টাকা নেওয়ার অভিযোগ মসিউরের বিরুদ্ধে।

গঙ্গাচড়ার হাজী দেলোয়ার হোসেন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয় সরকারীকরণ শুরু হলেও শিক্ষকপ্রতি ৪০ হাজার ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা ২০ হাজার করে মোট ১০ লাখ টাকা মসিউর রহমানকে দেন। কিন্তু তাঁদের প্রতিষ্ঠান সরকারি হয়নি।

মসিউর রহমান এ অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারীকরণে তিনি দুটি প্রতিষ্ঠানকে ডিও লেটার দিয়েছিলেন, সেগুলো সরকারীকরণ হয়েছে।

তবে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের ভাষ্য, দেড় বছর আগে রমজান মাসে কয়েকজন শিক্ষক টাকা ফেরত চাইতে মসিউরের বাড়িতে গিয়ে কথা বলেন। কিন্তু তিনি টাকা ফেরত দেননি। উল্টো পরবর্তী সময়ে তাঁরা বিদ্যালয় সরকারীকরণ চাইবেন না—এমন লিখিত দিতে বলেন।

লিখিত চাওয়ার বিষয়ে মসিউরের ভাষ্য, ‘প্রশ্নই উঠে না।’

গঙ্গাচড়ার মটুকপুরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম (নওশা) তাঁর ছোট ছেলে রায়হান কবীরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরীর চাকরি জন্য পাঁচ লাখ টাকা দেন। রফিকুল বলেন, ২০১৫ সালে মসিউরের রংপুরের বাড়িতে তাঁর উপস্থিতিতে স্ত্রী রাকিবা নাসরিন টাকা নেন। তিনি জমি বন্ধক রেখে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের চাকরি এখনো হয়নি।

এ বিষয়ে মসিউরের উল্টো প্রশ্ন, ‘আমি এমপি। আমার স্ত্রীকে টাকা দিতে যাবে কেন? তারা যদি আমার বউকে (প্রয়াত) দিয়ে থাকে, তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করুক গিয়ে।’

তবে রফিকুলের দাবি, টাকা লেনদেনের সময় মসিউরের তখনকার এপিএস আব্দুর রাজ্জাকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

মর্ণেয়া ইউনিয়নের খলিফার বাজারের গোলাম রহমানের অভিযোগ, ২০১৭ সালে তিনি তাঁর ছেলে বেলাল উদ্দিন আহমেদ ও মেয়ে সালমা বেগমের সরকারি চাকরির জন্য আধা পাকা ঘরসহ বসতভিটার ১৩ শতাংশ জমি বিক্রি করেন। এই চাকরির জন্য ১২ লাখ টাকা নেন মর্ণেয়া ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল কবীর। রেজাউল ওই সময় তাঁকে (গোলাম রহমান) জানান, এই টাকা মসিউরের স্ত্রী রাকিবা নাসরিন নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ছেলে-মেয়ের চাকরি হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাস ছয়েক আগে রেজাউল কবীর লিভার সিসোসিস রোগে মারা গেলে তাঁর লাশ দাফনে বাধা দেয় গোলাম রহমানের পরিবার।

রেজাউলের বড় ভাই শাহাজান কবীর ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, গোলাম রহমানসহ কয়েকজনের মোট ২১ লাখ টাকা রেজাউল সংসদ সদস্যের স্ত্রী রাকিবা নাসরিনকে দিয়েছিলেন চাকরির জন্য। কিন্তু সেই টাকা ফেরত পাননি।

রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির নির্বাহী সদস্য আতিকুর রহমান তাঁর শ্বশুরবাড়ির পক্ষের চার-পাঁচজনের চাকরির জন্য মসিউরকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের চাকরি হয়নি।

তবে মসিউর দাবি করেন, তাঁকে নয়, তাঁর স্ত্রীকে (রাকিবা নাসরিন) দিয়েছেন বলে শুনেছেন। আবু বক্করের মতো তিনিও (আতিকুর) সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে পারলে টাকা ফেরত দেবেন বলে জানান মসিউর।

আতিকুর এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি। তবে তাঁর কষ্টের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘সাড়ে সাত বছর ধরে আমি শ্বশুরবাড়ি যাইতে পারি না। শালির বিয়ে হয়েছে, যাইতে পারি নাই। ছোট বাচ্চার আকিকা ওরা শ্বশুরবাড়িতে করেছে। আমি ভয়ে যাইনি। গেলেই যদি থানায় ডাকি নিয়া বলে, আমার টাকা দিয়া যান। রংপুরের বহুত মানুষের টাকা এমন করে তাঁর (মসিউর) কাছে আটকে আছে।’