সরকার কাজে লাগাতে চাইলে সাড়া দেব

সরকার কাজে লাগাতে চাইলে সাড়া দেব 

বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসা ও তিন শূন্যের পৃথিবী ধারণার প্রবক্তা। এই অর্থনীতিবিদ প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রামীণ ব্যাংক মডেল’ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় মুহাম্মদ ইউনূস স্বাধীনতার পর পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন; তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও উপদেষ্টা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, যুক্তরাষ্ট্রের ভেন্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্ধশতাধিক সম্মানসূচক ডক্টরেটও পেয়েছেন। নোবেল ছাড়াও পেয়েছেন রামোন ম্যাগসেসে, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অনেক স্বীকৃতি। থ্রি ফারমার্স অব জোবরা, ব্যাংকার টু দ্য পুওর, ক্রিয়েটিং এ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পোভার্টি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে

সমকাল: আমরা আনন্দিত যে, আপনি সাক্ষাৎকারের জন্য সময় দিয়েছেন। দেশীয় সংবাদমাধ্যমে আপনার সাক্ষাৎকার দেখা যায় না। এ ব্যাপারে সাংবাদিক মহলে আক্ষেপও রয়েছে।

মুহাম্মদ ইউনূস: আমিও খুব খুশি যে আপনারা এসেছেন। আমি আসলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেই চাই। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সময়সূচি মেলে না। এ ছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, আমি বলি একভাবে, প্রকাশ হয় আরেকভাবে। তাতে করে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে। সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার ক্ষেত্রে আমার কখনোই অসম্মতি নেই।

সমকাল: এই সাক্ষাৎকার এমন সময় নিচ্ছি, যখন আপনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একাধিক মামলার বিষয় দেশে-বিদেশে আলোচিত। বিরল কিছু স্থানে আপনার উপস্থিতিও লক্ষণীয়। যেমন গত ৩ মার্চ সকালে কাকরাইলে ও দুপুরে পুরান ঢাকায় জামিনের জন্য গিয়েছিলেন। এরই ফাঁকে জনসন রোডের একটি হোটেলে নাশতা করতে হয়েছে। কতদিন পর এভাবে জনপরিসরে গিয়ে আহার করলেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: নাশতা করা যেমন তেমন, এভাবে আদালতে যাওয়ার বিষয়টিই আমার কাছে মনে হলো যেন দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছি। দুঃস্বপ্ন এ জন্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে আদালতে বিচারপ্রার্থী হতে হচ্ছে। শুধু আমি নই, সব মিলিয়ে আটজন এমন ব্যক্তিকে আদালতে যেতে হয়েছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে সারাজীবন নিয়োজিত থেকেছেন দরিদ্র মানুষের উন্নয়নে। দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবায়ন ছাড়া তাদের জীবনে আর কোনো লক্ষ্যই ছিল না।

সমকাল: আমরা এভাবে বলতে পারি, স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি?

মুহাম্মদ ইউনূস: একটা উদাহরণ দিই। সারাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত নারীর প্রায় সবারই অক্ষরজ্ঞান ছিল না। তাদের ও তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম আমরা। শুধু অক্ষরজ্ঞান ছিল না বা নাম লিখতে পারত না, এমন নয়। আমরা নাম জিজ্ঞেস করার আগপর্যন্ত অনেকে ছিল কারও মেয়ে, কারও স্ত্রী বা কারও মা। নিজের নাম লেখা শেখার পর তার যে আত্মবিশ্বাস, সেটা দেখার মতো। সেই যে শুরু হলো স্বপ্ন বাস্তবায়নের দীর্ঘ যাত্রা শেষে, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমাকে আদালতে দাঁড়াতে হচ্ছে। কীসের জন্য? জালিয়াতির অপরাধ, অর্থ আত্মসাতের অপরাধ, মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে! আদালতে দাঁড়িয়ে পুরো বিষয়টি সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মতো মনে হচ্ছিল।

সমকাল: বিষয়গুলো আপনার দৈনন্দিন জীবনযাপনে কতটা প্রভাব ফেলেছে?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমার স্ত্রী ডিমেনশিয়া রোগী। সে কিছুই বোঝে না, কাউকে চেনে না। আমাকেও চেনে না। শুধু জানে যে, এই ব্যক্তির ওপর আস্থা রাখা যায়। আমাকে দিয়েই সবকিছু করতে চায়। একটি মামলায় সাজা তো হয়েই গেছে। আমাকে যদি জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর কী অবস্থা হবে? আমার দুই মেয়ে; একজন বিদেশে, একজন দেশে। তারা বুঝতে পারছে না, আব্বা কেন জেলে যাবে? আমার একজন নাতি, ৮-৯ বছর বয়স। সে খুব ক্রিয়েটিভ শিশু। সুন্দর গান গায়, ইনস্ট্রুমেন্ট বাজায়, টেলিভিশনে শিশুদের অভিনয় করে। সে বুঝতে পারছে না, জেল কী জিনিস, নানা সেখানে কেন যাবে?

সমকাল: মামলা হওয়ার পর বিশ্বের খ্যাতনামা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিবৃতি দিয়েছেন, খোলা চিঠি লিখেছেন। এতে পরিস্থিতির কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়েছে?

মুহাম্মদ ইউনূস: মামলার পর দেশের সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত ছিল। আমি সারাদেশে গ্রামে গ্রামে গিয়েছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে বৈঠক করেছি, তাদের সন্তানদের লেখাপড়া, ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছি। তারা আমাকে নোবেল পুরস্কার পেতে দেখেছে। হঠাৎ কী হলো, তারা বুঝতে পারছে না। কিন্তু যখন বিবৃতিগুলো এসেছে, তারা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কারণ পৃথিবীর সব মান্যগণ্য ব্যক্তি বলছেন, তিনি নির্দোষ। নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছে।

সমকাল: শ্রম আইন লঙ্ঘন ও অর্থ আত্মসাৎ মামলা দুটির আইনি ভিত্তি নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

মুহাম্মদ ইউনূস: কোনো ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। সবাই বলছে, এগুলো হয়রানিমূলক মামলা। অর্থ আত্মসাতের কোনো কারণই নেই। ব্যক্তিগতভাবে অর্থ উপার্জন আমার জীবনে কখনোই কাম্য ছিল না। কেন অর্থ আত্মসাৎ করতে যাব! কেন জালিয়াতির আশ্রয় নেব! গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়েছে একটি শব্দের ভিত্তিতে– বিশ্বাস বা ট্রাস্ট। ক্রেডিট শব্দটির মূল অর্থ হলো ট্রাস্ট। কিন্তু পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ডিসট্রাস্ট বা অবিশ্বাস দিয়ে। ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে বিশ্বাস করে না। ফলে দলিল বা সম্পত্তি জিম্মি রাখতে হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছি, ঋণ পেতে দলিল বা সম্পত্তি জিম্মি রাখতে হবে না। বিশ্বাসের ভিত্তিতে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া একটা প্রতিষ্ঠান কেন জালিয়াতির আশ্রয় নেবে?

সমকাল: এখন আপনি জামিনে রয়েছেন। মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী?

মুহাম্মদ ইউনূস: বিশ্বজুড়েই মামলা পর্যবেক্ষণ করে যেসব প্রতিষ্ঠান, এর একটি হলো আমাল ক্লুনি ফাউন্ডেশন। যে মামলার বিচার নিয়ে শঙ্কা জাগে, তারা সেখানে টিম পাঠিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। তারা রিপোর্ট দিয়ে বলেছে, এই মামলা ডিসমিস করে দেওয়া উচিত। এখন যে মামলার ভিত্তিই নেই, সেখানে তো আর কিছু করার নেই। ধরে নিচ্ছি আমাদের হয়রানি চলতেই থাকবে।

সমকাল: ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে গ্রামীণ টেলিকম ভবনে একদল মানুষ এসেছিল আপনার নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘দখল’ নিতে। এর নেপথ্যের বিষয়টি কী?

মুহাম্মদ ইউনূস: দেখুন, গ্রামীণ ব্যাংকে যখন থাকতে পারলাম না, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বহু কষ্টে জমি জোগাড় করে এই ‘গ্রিন বিল্ডিং’ নির্মাণ করেছি। মাত্র দু’বছর হলো আমরা এখানে এসেছি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ একদল লোক হইহই করে ঢুকে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। তারা বলল, গ্রামীণ ব্যাংক বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তে আমরা এটি দখল নিতে এসেছি। ১৫ ফেব্রুয়ারি আমরা সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিলাম। ওই দিন সকাল থেকে ভবনের বাইরে জমায়েত, রাজনৈতিক বক্তৃতা ও স্লোগান শুরু হলো। কিছু নারী ঝাড়ু নিয়ে এলেন। যা হোক, দেরিতে হলেও প্রেস কনফারেন্স করলাম। তার পর থেকে তারা আসা বন্ধ করেছেন।

সমকাল: গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও একটি সংবাদ সম্মেলন করে মালিকানা বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা বলেছি, এটি নিয়ে বিতর্ক করার কিছু নেই, আইনিভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে। মানুষ ঢুকিয়ে জবরদখল তো ন্যায়নীতির বিষয় হলো না! আমরা বলেছি, আদালতে যান, প্রমাণ করেন কীভাবে এটির মালিক হলেন। আমরাও বলি কীভাবে আমরা এটির মালিক।

সমকাল: মালিকানার বিষয়টি তাহলে কীভাবে নির্ধারিত হবে?

মুহাম্মদ ইউনূস: এসব প্রতিষ্ঠানের আসলে কোনো ব্যক্তিমালিকানা নেই। এগুলো কোম্পানি আইনে বিশেষ একটি ধারা সেকশন টোয়েন্টিএইট কোম্পানি। এ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কোনো পুঁজি নেই। যে কয়েকজন মিলে কোম্পানি গঠন করেন, তাদের সর্বোচ্চ দায়ভার এক হাজার টাকা। কোম্পানির কোটি কোটি টাকা লোকসান হলেও এক হাজার টাকার বেশি তার দায় নেই। ধারাটি আমরা পছন্দ করেছি, কারণ এটি সামাজিক ব্যবসা ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এ ব্যবসা থেকে মালিক কোনো মুনাফা নেবেন না।

সমকাল: বিশ্বজুড়ে সামাজিক ব্যবসা মডেল ও তিন শূন্যের পৃথিবী নিয়ে আপনার স্বপ্নের বাস্তবায়ন কি দেশীয় আইনি ঝামেলায় বাধাগ্রস্ত হতে পারে?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা তো সৎভাবে শুরু করেছিলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর প্রসার হচ্ছে। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার খোলা হচ্ছে। প্যারিসে সোশ্যাল বিজনেস অলিম্পিক হতে যাচ্ছে। এখন একটু থমকে যেতে পারে।

সমকাল: আপনার তিন শূন্যের পৃথিবীতে শূন্য কার্বন নির্গমনের ধারণা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে প্রথম সারিতে থাকা বাংলাদেশের জন্য সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

মুহাম্মদ ইউনূস: গোটা বিশ্বের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং আমাদের জন্য আশু সমস্যা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, আমরা সবার আগে তলিয়ে যেতে পারি। এ জন্য আমরা ‘থ্রি জিরো ক্লাব’ গঠন করে দিচ্ছি। বলছি, পাঁচজন মিলে একটি গ্রুপ হবে– যাদের বয়স ১২ থেকে ৩৫ বছর। তাদের উদ্দেশ্য হলো জিরো কার্বন এমিশন, জিরো ওয়েলথ কনসেন্ট্রেশন, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট। এ ধরনের একটি বিশ্ব নিজে নিজে হবে না, তরুণদের নিজেদের গড়তে হবে। আমাদের হয়রানি অব্যাহত থাকলে তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ার কার্যক্রম থমকে যেতে পারে।

সমকাল: বর্তমান সরকারের সঙ্গে দূরত্বের কারণেই কি আপনার কার্যক্রম নিয়ে জটিলতা বাড়ছে?

মুহাম্মদ ইউনূস: দূরত্ব বললে কথাটা খুব হালকা হয়ে যায়। আমার নাম না ধরে ‘রক্তচোষা’ বলা হয়। আমাকে পদ্মায় চোবানোর কথা বলা হয়। এমন ক্ষোভের কারণ আমার জানা নেই। কথায় বা আচরণে এমন কিছু করিনি যে সরকারের কেউ আমার ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারেন।

সমকাল: বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের। আপনিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের পরিকল্পনা কমিশনেও যোগ দিয়েছিলেন।

মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা বোধ হয় বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি বলে একটি কমিটি করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি স্টেটের ন্যাশভিলে আমরা পূর্ববঙ্গের ছয়জন ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর খবর টেলিভিশনে দেখেই আমরা ঘোষণা করলাম– আমরা আর পাকিস্তানি নাগরিক নই। আমরা বাংলাদেশি নাগরিক। ন্যাশভিলে যত টেলিভিশন স্টেশন ছিল, সেখানে গিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছি। যাতে সবাই জানতে পারে, বাংলাদেশি নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্রেও অবস্থান নিয়েছে।

সমকাল: একটি নিউজলেটারও প্রকাশ করেছিলেন।

মুহাম্মদ ইউনূস: আমার বাসা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিউজলেটার প্রকাশ হতো। আমার স্ত্রী টাইপ করতেন, আর আমি গ্যাস্টেটনার সাইক্লোস্টাইল মেশিন ঘুরিয়ে সেই নিউজলেটার কপি করতাম। নিউজলেটারের জন্য আমি নিজে কার্টুন আঁকতাম। তারপর সেই নিউজলেটার আমি বিতরণ করতাম। সেখানে আমার নাম ও বাসার ঠিকানা ছিল। ফলে পাকিস্তানিরা বাসার সামনে এসে আমাকে ‘গাদ্দার’ বলে গালাগাল করত।

সমকাল: কেবল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে নয়; আওয়ামী লীগ সরকারও দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলে। তাহলে দূরত্বের ইস্যু কী?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বুঝি না। আপনারা সাংবাদিকরা ভালো বলতে পারবেন।

সমকাল: বর্তমান সরকারপ্রধানের সঙ্গে একসময় আপনার সুসম্পর্কই আমরা দেখেছি। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আপনার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মাইক্রোক্রেডিট সম্মেলনে তিনি কো-চেয়ার ছিলেন। গ্রামীণফোনের অনুমোদনও পেয়েছিলেন শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে।

মুহাম্মদ ইউনূস: ঠিকই বলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার সুসম্পর্কই ছিল। সেটা কোন দিক থেকে হারিয়ে গেল, জানি না। আমি কী অপরাধ করেছি, তাও জানি না।

সমকাল: আপনি নিজে কখনও দূরত্ব বা বিরোধের সম্ভাব্য সূত্র নিয়ে ভেবে দেখেছেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমাকে তো ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হলো। বলা হলো, আমার বয়স বেশি হয়ে গেছে। আমরা বললাম, আমরা তো সরকারি ব্যাংকের আইন মানি না। আমরা তো বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলি। বলা হলো, সরকারি ব্যাংকের আইনই মানতে হবে। আমি পদত্যাগ করে চলে এলাম। এটুকুই তিক্ততার জায়গা ছিল। এর বাইরে আর কোনো ঘটনা তো নেই!

সমকাল: বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের পর ‘নাগরিক শক্তি’ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘটনাটি কি তাহলে মূল কারণ?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমি সেটাকে কারণ হিসেবে মনে করি না। কারণ যে কোনো নাগরিকই তো রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। এটা তো সাংবিধানিক অধিকার। যে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। আপনারা দীর্ঘদিনের বিশাল রাজনৈতিক দল। একটা লোক কোথা থেকে এসে বলল, রাজনৈতিক দল গঠন করবে। করবে বলেছে, করেওনি। তাতেই ক্ষুব্ধ হওয়ার কী আছে?

সমকাল: মনে হতে পারে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নাজুক সময়ে আপনি ক্ষমতার সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন।

মুহাম্মদ ইউনূস: সে সময়ের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব আমাকে বলেছিল সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। বারবার বলেছিল, চাপ দিয়েছিল। বাসায় এসে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বসে থেকে জেনারেলরা আমাকে বুঝিয়েছেন, চাপ দিয়েছেন, তর্ক-বিতর্ক করেছেন, ভয় দেখিয়েছেন। আমি রাজি হইনি। বলেছি, আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করব না। আমার পেছনে সময় নষ্ট না করে অন্য লোক খুঁজে বের করেন। সুতরাং আমাকে তো ক্ষমতা সাধা হয়েছে! যদি ক্ষমতার খায়েশ থাকতই, তাহলে এত কষ্ট করে রাজনৈতিক দল গঠন করার দরকার ছিল না। ক্ষমতার লোভ থাকলে আমি সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেই রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারতাম। ক্ষমতা আছে, সামরিক বাহিনী আছে পেছনে, আর কী চাই? আমি তো সেই পথে যাইনি। দৃঢ়ভাবে ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেছি। এমন নয় যে আরেকবার সাধিলে খাইব।

সমকাল: অভিযোগ করা হয়, ওয়ান-ইলেভেনকালে ‘মাইনাস টু’ তত্ত্বের নেপথ্যে আপনার হাত রয়েছে।

মুহাম্মদ ইউনূস: ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা তো আমার ওপর নারাজ ছিল। কারণ তাদের কথামতো সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। তাদের কথা শুনছি না, আবার তারা আমার কাছেই পরামর্শের জন্য আসবে? একটা অভিযোগ প্রচার করে দিলেই সত্য হয় না। ভিত্তিহীন কথার তো কোনো জবাবও হয় না।

সমকাল: পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার ব্যাপারেও আপনাকে দায়ী করা হয়।

মুহাম্মদ ইউনূস: বিষয়টি হলো, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার আলোচনা চলছিল অনেক দিন ধরে। তখনকার পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছিল। তখনকার অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত তাদের আশ্বস্ত করছেন যে দুর্নীতি হবে না। বিশ্বব্যাংক একটি তালিকা দিয়ে বলেছিল, এই কয়জনকে বিদায় করে দিতে হবে। মুহিত সাহেব রাজিও হয়ে গিয়েছিলেন, কয়েকজনকে সরিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন যোগাযোগমন্ত্রীর প্রশ্ন এলো, তখন বিষয়টি আটকে গেল। এই তো ঘটনাচক্র! মাঝখানে কেউ একজন হিলারি ক্লিনটনকে ফোন করলেন, হিলারি বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে ফোন করলেন, টাকা বন্ধ হয়ে গেল! বিষয়টি এতটাই সহজ!

সমকাল: আপনার কি মনে হয়, অতীতের সুসম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এখনও বর্তমানে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব?

মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই সম্ভব। সরকারের সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ তো নেই!

সমকাল: দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য দেশের ভেতরে বা বাইরে থেকে কোনো উদ্যোগ কি কখনও নেওয়া হয়েছে?

মুহাম্মদ ইউনূস: যখন আমাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হয়, সে সময় অনেকে চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চপদস্থ অনেকে এসেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী বা বিশেষ দূতরা এসেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

সমকাল: এ সময়ে এসেও আপনার কন্যা মণিকা ইউনূস সিএনএনে বলেছেন যে, তিনি চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আপনি আবারও একসঙ্গে কাজ করুন।

মুহাম্মদ ইউনূস: সবাই মিলে দেশের জন্য কাজ করতে পারলে তো ভালো। দূরত্ব না থাকলেই হলো! যেহেতু তিনি প্রধানমন্ত্রী, একটা কথা বললে সারাদেশের মানুষ সেটা মান্য করেন। তিনি যখন কাউকে ‘চোর’ বলেন, তখন সারাদেশের মানুষ বিভ্রান্ত হয়।

সমকাল: অধ্যাপক রেহমান সোবহান এই জানুয়ারিতেও সংবাদপত্রে লিখেছেন, জাতির সম্পদ হিসেবে বৈশ্বিক পরিসরে আপনাকে কাজে লাগাতে পারে সরকার। যদি কখনও এমন আহ্বান আসে, আপনি সাড়া দেবেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই সাড়া দেব। দেশের জন্য কাজ করা তো বড় ব্যাপার। দেশের সবাই যাতে উপকৃত হয়, এটাই তো আমাদের কাজ! মানুষের উপকার করা ছাড়া সারাজীবন আর কিছুই তো করিনি।

সমকাল: নবম গ্লোবাল সোশ্যাল বিজনেস সামিটের একটি দৃশ্য চোখে ভাসে। আপনার ডাক পেয়ে দৌহিত্র সাইরাস দৌড়ে যাচ্ছে মঞ্চের দিকে। ৮৩ বছর বয়সে এসে এমন অখণ্ড পারিবারিক পরিসরের কথা কি ভাবেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: এ ধরনের পারিবারিক সময় নিশ্চয়ই আনন্দদায়ক। নাতি সাইরাসকে আমি অনন্ত বলে ডাকি। আমার মেয়েদের সঙ্গেও সময় কাটাতে ভালো লাগে। কিন্তু কাজে মগ্ন থাকাতেও আমার আনন্দ। কাজ আমাকে সতেজ করে।

samakal