- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:১৭
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার নির্বাচিত হয় জনগণের ভোটে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের সমর্থন নিয়ে কেউ সরকার গঠন করে, কেউ বিরোধী দলের আসনে বসে। আবার অনেক প্রার্থী প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট না পেয়ে নির্বাচনী জামানত হারান। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জনগণের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রয়েছে। তারা যাকে ইচ্ছা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারে। শুধু স্বৈরশাসকরা জনগণের ভোটের তোয়াক্কা না করে আইওয়াশ নির্বাচন দিয়ে জোর করে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে। প্রতিটি স্বৈরশাসক তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো না কোনো বিদেশী রাষ্ট্রকে প্রভু মেনে তাদের সমর্থন নিয়ে থাকে। জনগণের প্রতি তাদের আস্থা থাকে না; তাদের আস্থা প্রভুরাষ্ট্রের প্রতি। কারণ তাদের সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির ওপর এদের ক্ষমতায় টিকে থাকা বা না থাকা নির্ভর করে। বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দু’টি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে না পারলেও ওই দুই নির্বাচনে দুই প্রভুরাষ্ট্র ভারত ও চীন নির্লজ্জ বেহায়ার মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগণের মতামতের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বিনাভোট ও ভোটডাকাতিকে সমর্থন দিয়ে পছন্দের দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে রেখে নিজেদের ফায়দা হাসিল করে নিচ্ছে।
মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জনসমর্থনের দিক দিয়ে অনেকটাই দেউলিয়া বনে গেছে। তা না হলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের জনগণের কাছে না গিয়ে বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে ধরনা দেবে কেন? বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন অনুরোধ করতে হবে? বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি নির্বাচনমুখী দল নয়? তারা কি জনগণের ভোটে বিশ্বাস করে না? মূল ব্যাপারটি তো সেখানে নয়; বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। তারা নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় যেতে চায়। বিগত দিনে তারা নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু সরকার জনগণের ভোট হরণ করার এমন নীতি চালু করেছে যার কারণে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল তো দূরে থাক, সাধারণ মানুষও আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে- এ কথা বিশ্বাস করে না। সেখানে বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল কোন বিশ্বাসে ওদের অধীনে নির্বাচনে যাবে? আওয়ামী লীগ বুঝে গেছে, যদি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে তাদের শোচনীয় পরাজয় নিশ্চিত। আর এ কারণেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তাদেরকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের ভারতের কাছে তিনি নিবেদন করেছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর গোয়েবলসীয় ভূত ভর করেছে, যার কারণে তারা দৃশ্যমান সত্যটাকেও ভুলে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের কেউ কোনো অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হলেই তারা সেই নেতা বা কর্মীর মধ্যে জামায়াত-বিএনপির গন্ধ খুঁজে পান। গোয়েবলসের সত্যের মতোই মুহূর্তের মধ্যে তারা তাদের দলের কেউ না বলে স্বীকৃতি দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সত্য কথা প্রকাশ করে দেয়ায় আওয়ামী লীগ এখন বলছে- আবদুল মোমেন তাদের দলের কেউ না। অথচ তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও এক নম্বর সদস্য। আবার তিনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগেরও পদধারী নেতা। কিন্তু কী নির্লজ্জের মতো বলে ফেলল- তিনি নাকি দলের কেউ নন। যে ব্যক্তিকে তারা মন্ত্রী বানিয়েছে, দলে পদ দিয়েছে তাকে তারা অস্বীকার করে কীভাবে? অস্বীকার করাটা একটি অসুখে পরিণত হয়েছে। অস্বীকার করলেই তো আর দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগণের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে যে কারো বিদেশী প্রভুর কাছে যাওয়ার অর্থ হলো, নাগরিকের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। অবশ্যই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বেরও কিছু একটা জলাঞ্জলিও নিশ্চয়ই দিতে হবে। নতুবা তারা কোন স্বার্থে জনগণের সমর্থনবিহীন একটি সরকারকে টিকিয়ে রাখবে?
এই সরকারের আমলা, মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় ক্যাডারদের গোয়েবলসীয় নীতি আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। তারা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা অথবা গুম করে ফেলছে। নিখোঁজ ব্যক্তির থানায় বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সন্ধান চাইতে গেলে তারা তা নিয়ে নিছক তামাশা করে থাকে। এমনকি সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও এটিকে পরিহাস করে বলেন- তারা বউয়ের সাথে ঝগড়া করে অথবা দেনার দায়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট সরকারের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ যথা- আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলাদা আলাদাভাবে দেখা করে গুম, খুন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জেরে সাংবাদিক হয়রানি নিয়ে তার উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে একই কথা বলেন। মিশেল ব্যাচেলেটের উদ্বেগ থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য এমন যে- এই দেশে গুম, খুন একেবারেই হয় না। আইনমন্ত্রীর ভাষায়- ‘মানুষজন নানা সমস্যা থেকে বাঁচতে নিজেরাই গা ঢাকা দিয়েছে এবং তাদের পরিবার গুমের অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে (নয়া দিগন্ত, ২২ আগস্ট ২০২২)।’ আইনমন্ত্রী কি তাহলে বলবেন, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, এম ইলিয়াস আলী একই কারণে নিখোঁজ রয়েছেন? মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ সরকারের আমলে ৬১৯ জন নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে আটকের পর লাপাত্তা হয়ে গেছেন। কমপক্ষে দুই হাজার ৬৫৮ জন মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে? এর সবই কি মিথ্যা? যদি মিথ্যা হয় তাহলে তদন্ত করে তাদের খুঁজে বের করা হচ্ছে না কেন? জাতিসঙ্ঘের এই সংস্থাও তো চায়, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। নিরপেক্ষ তদন্ত করা হচ্ছে না কেন?
অবশ্য এ ব্যাপারে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া কার্যক্রমের প্রধান মীনাক্ষি গাঙ্গুলী বলেন, মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশে সরকারের যে আচার-আচরণ তার নজির তারা অন্য কোথাও দেখেননি। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যে ৯০টি দেশ নিয়ে কাজ করি তার মধ্যে বাংলাদেশের সমস্যা একেবারেই আলাদা।’ গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তারপরও অপরাধীদের আড়াল করতে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার প্রধানের সামনে অসত্য কথা বলা হচ্ছে। তিনি এমনও বলেছেন, ‘মানবাধিকারের এই উদ্বেগ অবজ্ঞা করলে বাংলাদেশের জন্য তার পরিণতি ভালো হবে না। বাংলাদেশ সত্যিই একটি বাজে অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ শান্তিরক্ষীবাহিনীতে কাজ করে। তা বন্ধ হয়ে যাবে। যেভাবে মিথ্যা বলে অপরাধীদের আড়াল করা হচ্ছে তাতে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মর্যদা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে (নয়া দিগন্ত, ২২ আগস্ট ২০২২)।’ জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার প্রধানও বলেছেন, ‘সরকারের উচিত মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে সত্যকে প্রকাশ করা।’
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন হিটলারের নাৎসি সরকারের প্রপাগান্ডা বা তথ্যমন্ত্রী। একজন উন্মাদ একনায়কের বিশ্বস্ত সহচরও নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচারে চ্যাম্পিয়ন। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, মিথ্যাকে বারবার প্রচার করলে সত্যে পরিণত হয়। মিথ্যা প্রচারণায় তিনি জার্মানিতে হিটলার ও নাৎসিবাদকে তুমুল জনপ্রিয় করেছিলেন। ইতিহাস হিটলারকে নিষ্ঠুর খুনি ও গোয়েবলসকে মিথ্যাচারের প্রতিকৃতি হিসেবে নিন্দিত করেছে। মিথ্যার ভার তার ওপর এতটাই বোঝা হয়ে গিয়েছিল যে, ১৯৪৫ সালের ১ মে বার্লিনে সস্ত্রীক আত্মহত্যার আগে তারা তাদের ছয় সন্তানকে হত্যা করেন। তাদের পাপ ও অপরাধের বোঝা এতটাই ছিল যে, এর বিকল্প তাদের সামনে ছিল না। এই সরকারের সব মন্ত্রীই হিটলারের প্রপাগান্ডা মন্ত্রীর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তাদের সব অপরাধকে ঢাকার চেষ্টা করছেন কিন্তু শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হচ্ছে না। শ্রীলঙ্কার জনগণ যেমন এমপি-মন্ত্রীদের জামা-প্যান্ট খুলে বেদম পিটিয়েছে অন্য দেশের বেলায় তেমনটি না হোক সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্য আমাদের দেশের প্রপাগান্ডাবিদদের সত্যের আশ্রয় নেয়া উচিত।
জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর ইতিহাসের জঘন্য কায়দায় নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। গুম, খুনের মঞ্চায়ন প্রতিনিয়তই চলছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুর্নীতি, লুটপাটের প্রতিযোগিতা চলছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন ত্রাহি অবস্থা। অথচ মন্ত্রীরা গোয়েবলসীয় কায়দায় বলছেন, দেশের মানুষ বেহেশতে আছে। এমন রসিকতায় হীরকের রানী খুশি হলেও জনগণের রক্ত কিন্তু উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। রাজপথে নেমে পড়লে শ্রীলঙ্কার এমপি-মন্ত্রীদের ভাগ্য হয়তো বরণ করতে হতে পারে। এত কিছু হওয়ার আগেই আমরা চাই, সাধু সাবধান হোন।