ইসমাইল আলী: কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। যদিও এ সময় বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি হারে। এতে চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৮০ বিলিয়ন ডলার। অথচ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েক বছর ধরে হ্রাস পাচ্ছে। জুন শেষে তা ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচেই থাকবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ২৪ জুন বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেয় আইএমএফ। এর পরপরই বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। সে প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২ সালের জুন শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৬৫ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ছিল ২৮ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর জুন শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় নিট রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে সরকারের বিদেশি ঋণ বাড়ে আট দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার ও রিজার্ভ কমে আট দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ ও বিদেশি ঋণের বিপরীতমুখী চিত্র চলতি অর্থবছরও অব্যাহত ছিল। আইএমএফের হিসাবে, চলতি অর্থবছর জুন শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ বেড়ে দাঁড়াবে ৮০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। এ সময় নিট রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ১৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর সরকারের বিদেশি ঋণ বাড়বে ছয় দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার ও রিজার্ভ কমবে পাঁচ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। আর দুই বছরে সরকারের বিদেশি ঋণ বাড়ছে ১৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ও রিজার্ভ কমছে ১৩ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার গত কয়েক বছর অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ নিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। আবার পদ্মার রেলওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় কিছু প্রকল্প এখনই দরকার ছিল না। কোনো ধরনের স্টাডি ছাড়া হঠাৎ করেই এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে রিজার্ভ খরচে সরকার ছিল বেহিসাবি। এছাড়া পণ্য আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারও রিজার্ভ ক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
এদিকে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকায় ও রিজার্ভ ক্রমেই হ্রাস পাওয়ায় সরকারের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা কমছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গত মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ও রিজার্ভের অনুপাত ছিল ৫৬ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ ওই সময় বিদ্যমান রিজার্ভ দিয়ে বৈদেশিক ঋণের ৫৬ শতাংশের বেশি পরিশোধ করা যেত। পরের বছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে ২০২০ সালে বিদেশি ঋণ ও রিজার্ভের অনুপাত আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ। পরের তিন বছর ধরে এ অনুপাত কমছে। এর মধ্যে ২০২১ সাল শেষে বিদেশি ঋণ ও রিজার্ভের অনুপাত কমে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশ। আর গত বছর ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ বিদেশি ঋণ ও রিজার্ভের অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত ডিসেম্বরে রিজার্ভ দিয়ে বৈদেশিক ঋণের মাত্র ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব ছিল। তবে আইএমএফের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুন শেষে এ অনুপাত আরও কমে দাঁড়বে ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
আগামীতে বিদেশি ঋণ গ্রহণে সরকারকে আরও সতর্ক থাকা উচিত বলে মনে করেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেন বড় অপরিকল্পিত প্রকল্প না নেয়া হয়। যেকোনো বড় প্রকল্প নিলে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। সস্তায় যদি জাপানিরা কোনো প্রকল্প করে দেয়, তা নেয়া যায়। তবে চীনের ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা যদি সস্তায় ঋণ দেয়, তাহলে সেটা নেয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে, তা পরিশোধ করতে গিয়ে চাপে পড়বে দেশ। তাই আগামীতে কীভাবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি অর্থ পাচার রোধে সরকারকে কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।
প্রসঙ্গত, রিজার্ভ কমতে থাকায় দেশের আমদানি সক্ষমতাও কমছে বলে আইএমএফের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর শেষে নিট রিজার্ভ দিয়ে ১.৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হবে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। অথচ দুই বছর আগে ২০২২ সালের জুনে নিট রিজার্ভ দিয়ে ৪.২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। আর ২০২৩ সালের নিট রিজার্ভ দিয়ে ২.৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। অর্থাৎ বাংলাদেশের আমদানি সক্ষমতা ক্রমেই কমছে।
sharebiz