সরকারের বাজেট-হিসাবরক্ষণ সফটওয়্যারে প্রতারকের নাম

সরকারের বাজেট-হিসাবরক্ষণ সফটওয়্যারে প্রতারকের নাম

সরকারের অতি গোপনীয় ও সুরক্ষিত সমন্বিত বাজেট ও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির (আইবাস) সফটওয়্যারে প্রবেশ করে কৌশলে ভুয়া বিল পাস করিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের একটি প্রকল্পের বৈধ বিলের সঙ্গে ভুয়া বিল হিসাবরক্ষক জেনারেলের (এজি) অফিসে জমা দিয়ে সেগুলো কৌশলে পাস করিয়ে চেক গ্রহণ করা হয়। পরে চেকগুলো জালিয়াত চক্রের ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

সূত্র জানায়, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ১৫টি ভুয়া বিলের মাধ্যমে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে চারটি ভুয়া বিলে ২৮ লাখ ২৬ হাজার ৪৫৪ টাকা ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১টি বিলের মাধ্যমে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৬ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে নজিরবিহীন দুর্নীতির এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সুরক্ষিত আইবাসে প্রবেশ 
কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিতে নূর আহম্মেদের বাবা এম রহমান ভূঞার নাম কৌশলে আইবাস সিস্টেমের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিলগুলো পাস করানোর সময় এজি অফিসের কর্মকর্তারা আইবাসে বিলের মালিকের নাম আছে কিনা, সেটা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। তারা বিলগুলো (ভুয়া) পরীক্ষা করে ওইসব  বিলের মালিক এম রহমান ভূঞার নাম আইবাসের তালিকায় দেখতে পান। আইবাসে ওই নাম অন্তর্ভুক্ত থাকায় এম রহমান ভূঞার নামে দাখিল করা বিলগুলো বৈধ উল্লেখ করে পাস করিয়ে দেন কর্মকর্তারা। দুই অর্থবছরে ওই ১৫টি ভুয়া চেকের মালিক এম রহমান।

অগ্রণী ব্যাংকের জাতীয় প্রেস ক্লাব শাখা থেকে অর্থ উত্তোলন
সচিবালয়ের পাশেই অগ্রণী ব্যাংকের জাতীয় প্রেস ক্লাব শাখায় নূর আহম্মেদ ও তার বাবা এম রহমান ভূঞার নামে যৌথ হিসাব খোলা হয়। ওই হিসাবের চেকে বাবা ও ছেলের মধ্যে যে কেউ স্বাক্ষর করে অর্থ উত্তোলন করতে পারতেন। চেকগুলোয় নূর আহম্মেদ স্বাক্ষর করে অর্থ উত্তোলন করেছেন।

তদন্তে জানা গেছে, অফিস সহায়ক রবিউল ইসলাম জালিয়াতি করে এজি অফিস থেকে ভুয়া বিলগুলো পাস করিয়েছেন। বিলগুলো ইস্যু করা হয়েছিল নূর আহম্মেদের বাবা এম রহমানের নামে। পরে নূর আহম্মেদ বিলগুলো তাঁর ও তাঁর বাবার যৌথ ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। এম রহমান মারা গেছেন দুদকের তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই।

তদন্তে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের হেলথ ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিং (এইচইএফ) অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) প্রকল্পের অধীনে বীমা (চিকিৎসা ক্লেম) খাতের তিনটি ও গবেষণা খাতের একটি বিল এজি অফিসে জমা দেওয়া হয়েছিল। চারটি বিলের বিপরীতে ২৮ লাখ ২৬ হাজার ৪৫৪ টাকার খরচ উল্লেখ করা হয়। বিলগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুদক জানতে পারে, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের প্রকল্পের লাইন ডিরেক্টরের দপ্তর থেকে ওই চারটি বিল দাখিল করা হয়নি। লাইন ডিরেক্টরের অফিসের জারি রেজিস্টারে মঞ্জুরি আদেশ জারির কোনো রেকর্ড নেই। বরখাস্ত হওয়া রবিউল ইসলাম স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটে অফিস সহায়ক হিসেবে ১২-১৩ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এজি অফিসে বিল জমা দেওয়া ও বিলের বিপরীতে চেক গ্রহণের কাজ তিনিই করছিলেন। তিনি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের হিসাব শাখা থেকে বিলগুলো গ্রহণ করে সেগুলো সিএএফও এজি অফিসে জমা করতেন। বিলগুলো পাস হলে নিয়ম অনুযায়ী চেকগুলো রিসিভ করে তাঁর অফিসের হিসাব শাখায় জমা দিতেন। বিল নিয়ে যাওয়ার সময় ক’টি বিল নিয়ে যাচ্ছেন, তা রেজিস্টারের মাধ্যমে রিসিভ করে নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। চেক আনার সময় তিনি চেকের তালিকায় স্বাক্ষর দিয়ে ও ফোন নম্বর লিখে গ্রহণ করতেন। রবিউল নিজেই বিলগুলো অফিসারদের কক্ষে নিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে পাস করাতেন। এই কায়দায় রবিউল ২০২১-২২ অর্থবছরে  ১ কোটি ৮১ লাখ ৭৬ হাজার ২৩০ টাকার ১১টি ভুয়া বিল পাস করিয়ে নেন।

কে কী বলেন 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ‘অতি গোপনীয়, সুরক্ষিত আইবাসে প্রবেশ করে ভুয়া বিল জমা দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করার ঘটনাটি সরকারের ওপর একটি থ্রেট বলেই মনে হচ্ছে। সরকারের বাজেট প্রণয়ন, বাজেটের অর্থ ছাড়, বিভিন্ন খাতের বিল-ভাউচারের বিপরীতে অর্থ প্রদানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আইবাস চালু করা হয়েছে। সরকারি কাজের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নন, এমন ব্যক্তির নাম কীভাবে এর তালিকায় যুক্ত হতে পারে– এটি বোধগম্য নয়। দুদকের তদন্তে তালিকায় অপ্রাসঙ্গিক এম রহমান ভূঞার নাম পাওয়া গেছে। এই ধরনের আর কারও নাম আছে কিনা, বিষয়টি আইবাস কর্তৃপক্ষকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে।’

রবিউল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘আমি খুব বিপদে আছি। এটা নিয়ে অনেক তদন্ত চলছে, অনেক ঝামেলা হচ্ছে। ঘটনা সঠিক নয়। আমার ওপর দোষ চাপিয়ে অনেকে চলে গেছে। আমি আছি বিপদে। আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে ওরা ফায়ার করেছে। আমি ছিলাম হুকুমের গোলাম।’ নূর আহম্মেদ বলেন, ‘এখানে আসলে অনেক কিছু আছে। এই ঘটনায় আমি ফেঁসে গেছি। আমার বাবার নামে যে চেক হয়েছে, সেই চেক আমি অগ্রণী ব্যাংকের প্রেস ক্লাব শাখায় জমা দিয়েছি। পরে চেকের বিপরীতে টাকা তুলে বাবাকে দিয়েছি। কোথা থেকে চেক এসেছে, কে দিয়েছে– এটা আমি জানি না।’ তবে ব্যাংক হিসাবটি যৌথ বলে স্বীকার করেন তিনি। প্রতিটি চেকে তিনি স্বাক্ষর করে টাকা তুলেছেন– সমকালের কাছে এটিও স্বীকার করেছেন।

samakal