প্রতিদিন অসংখ্য অভিযোগ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ডাকে, সরাসরি দুদক কার্যালয়ে কিংবা হটলাইন-১০৬ এর মাধ্যমে সংস্থাটি ভুক্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণ করে। সব অভিযোগই প্রথমে দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে পাঠানো হয়। কমিটি সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়, কোন কোন অভিযোগ দুদক অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেবে। তবে কমিটির কাছেই অভিযোগগুলো পড়ে থাকে মাসের পর মাস।
অভিযোগ যাচাইয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকে কমিটি:
অভিযোগটি কমিশনের তফসিলভূক্ত অপরাধ কিনা; সুনির্দিষ্ট ও তথ্যভিত্তিক কিনা; অপরাধ সংঘটনের সময়কাল উল্লেখ করা হয়েছে কিনা; অভিযুক্ত ব্যক্তির অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও অভিযুক্তদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা আছে কিনা; অভিযোগের গুরুত্ব ও মাত্রা এবং আর্থিক সংশ্লেষের পরিমাণ; অভিযোগকারীর নাম ও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা উল্লেখ আছে কিনা; অভিযোগটি আদালতে প্রমাণযোগ্য কিনা সেই বিষয়ে আইন পর্যালোচনা করে দেখা হয়।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, প্রাপ্ত অভিযোগের ১০ শতাংশও দুদকের অনুসন্ধানে আসে না। বাকি ৯০ ভাগ অভিযোগই দুদক আমলে নেয় না। এতে বেশিরভাগ দুর্নীতিবাজই ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যায়। দুদকের জনবল সংকটও এর অন্যতম কারণ। এছাড়া যারা অভিযোগ করেন তারাও সঠিকভাবে অভিযোগ দিতে পারেন না। ফলে দুদক এসব অভিযোগ আমলে নিতে পারে না।
দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল:
এ সেলটি দুদকের এনফোর্সমেন্ট শাখারই অংশ। এ শাখা থেকেই সাধারণত অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে চিঠি পাঠানো হয় সরকারি দফতরগুলোতে। দু-একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান দুদকের চিঠির গুরুত্ব দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিতে চায় না বলে অভিযোগ খোদ দুদক কর্মকর্তাদের। তবে এ ক্ষেত্রে প্রায়ই সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন দুদক কর্মকর্তারা।
তবে সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রায়ই সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে তাগাদা দেওয়া হয় দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর দুদক থেকে পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হয়।
দেড় বছরে যত চিঠি দিয়েছে দুদক:
এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে দুদকের দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল থেকে বিভিন্ন সরকারি দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে ১৮৫টি। ২০২২ সালে বিভিন্ন সরকারি দফতরে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি পাঠায় ৯১৩টি। তবে এসব চিঠির হালনাগাদ (আপডেট) কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি দুদকের কাছ থেকে।
তবে দুদক সূত্র জানায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে দুদক অভিযোগ কেন্দ্র ১০৬ ও অন্যান্য উৎস থেকে ৫০৪টি অভিযোগ বাছাই করে। এর মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দফতরে ১৪৪টি চিঠি পাঠানো হয়।
দুদক আইনের তফসিল বহির্ভূত হওয়ায় পরিসমাপ্ত বা সংযুক্তকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৩৮টি। আর অভিযোগের ভিত্তিতে ১৯৯টি অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটি। অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে মাত্র ১৩টি।
পরবর্তী তিন মাসে ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ২২৫টি অভিযোগের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করে দুদক। এরমধ্যে বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠানো হয় ৪১টি। পরিসমাপ্ত বা সংযুক্তকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৭৪টি। অভিযান চালানো হয় ৮৭টি। অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় মাত্র ১৫টি।
একটি কেস স্টাডি:
স্থানীয় সরকার ও নাগরিক সেবা, ভূমি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, বন ও পরিবেশ, সমবায়, সমাজসেবা, পরিষেবা, প্রকৌশল, কৃষি, অর্থসহ প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই দুদক অভিযান চালায় ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়ে থাকে। একটি অভিযোগ তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রতিবেদন দিতে দুদক থেকে একটি চিঠি (স্মারক নং-৪৪০৫) দেওয়া হয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি। সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক বরাবর চিঠিটি দেওয়া হয় দুদকের দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল থেকে। এ চিঠিটি সমবায় কর্তৃপক্ষ পাওয়ার পর ঢাকা জেলা অডিটরকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু চিঠি পাওয়ার সাত মাস চললেও তার তদন্ত শেষ করেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। সেই চিঠির প্রতিবেদনও এখন পর্যন্ত পাঠানো হয়নি দুদকে। দুদক থেকেও এ বিষয়ে আর কোনও তাগাদা দেওয়া হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে।
দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম:
দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম আছে ২৫টি। সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর ও অধিদফতরগুলোতে দুর্নীতি দূর করতে দুদকের এসব প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। এসব টিমের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণে দিক নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি রোধ ও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কাজের গতিশীলতা আনতেও একটি কমিটি রয়েছে দুদকের।
কমিটিগুলোর কর্মপরিধির মধ্যে রয়েছে অনুসন্ধান ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাজে দীর্ঘসূত্রতার কারণ চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের সুপারিশ, অনুসন্ধান ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, ভাবমূর্তি ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্র পর্যালোচনা করে সুপারিশ বা মতামত দেওয়া।
দুদকের বক্তব্য:
দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম আছে ২৫টি। যেসব দফতরে সেবার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বিভিন্ন কথাবার্তা শোনা যায়, যেমন- পাসপোর্ট অফিস, গ্যাস, বিদ্যুত, রাজউক- এসব বিষয়ে দুদকের যেসব প্রাতিষ্ঠানিক কমিটি কাজ করছে। তাদের পর্যবেক্ষণ বা সুপারিশ চুড়ান্ত হলে তখন দুদকের কমিশনার পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে অবহিত করা হয়। তখন সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করছে কিনা সেজন্য মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। বৈঠক করার পর সেটা যাতে বাস্তবায়ন হয় সে লক্ষ্যে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই।
টিআইবির গবেষণা:
দুদক নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর একটি গবেষণায় বলা হয়, দুর্নীতির অভিযোগে সাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে দুদকের অনেক ঘাটতি আছে। তাছাড়া অভিযোগ দায়েরের পরিমাণের তুলনায় অনুসন্ধান ও মামলা দায়েরের হার কম। নারী ও দরিদ্রসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ চাহিদা মেটানোরও কোনও কাঠামো দুদকের নাই। সার্বিকভাবে দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।