- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
প্রতিটি যুগের প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় থাকে, যা রহস্যময়। যাকে বলে ‘কোড অব টাইম’। প্রতিটি সমাজে যুগে যুগে এই প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রয়োজনটি উপলব্ধি করতে পারা জরুরি। প্রয়োজন উপলব্ধি করে সমাজের নেতারা যদি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন তাহলে সমাজের এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়। আর ব্যর্থ হলে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সত্তরের দশকে আমাদের প্রয়োজনটি কী ছিল? ১৯৭৫ সালের ৭ আগস্টের কয়েক দিন পর আমি মতিঝিলে গিয়ে দেখি ফুটপাথে একটি লাশ পড়ে আছে। ওই বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫তম জন্মদিন ছিল। আমি দেখি ওই লাশের পাশ দিয়ে ৫৫ পাউন্ড ওজনের একটি কেক নিয়ে সে সময়ের রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা সদলবলে বাকশালে যোগদান করতে যাচ্ছেন। তখন আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, যে বঙ্গবন্ধুকে আমি চিনি, যিনি এ দেশের মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, তিনি কি দেশের এই পরিস্থিতিতে এত বড় কেক নিয়ে উৎসব করতে পারেন? দেশে যখন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে তখন কি তিনি জন্মদিনের উৎসব করবেন?
এমন ঘটনা ঘটতে পারে সেটি আমার ধারণায় না থাকলেও পারিপার্শ্বিক গুমোট পরিস্থিতি ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। আমার ভাবনাটি ছিল একজন সমাজ বিজ্ঞানীহিসেবে সাধারণ পর্যবেক্ষণলব্ধ উপলব্ধি। আমি দেখছিলাম তিনি বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। হয়তোবা সাইকোফেনরা তাকে এমনভাবে ঘেরাও করে ফেলেছিল যে তিনি বাস্তবতা দেখতে পাননি। তাকে যেন দেবতার আসনে বসানো হয়েছিল। তিনি সব কিছু করতে পারেন, কেউ তার কিছু করতে পারবে না। তিনি যেন এই মর্ত্যরে বুকে অমর একজন কেউ। এ ঘটনার পর আমি পাপুয়া নিউগিনির প্রভাবশালী পত্রিকা পোস্ট-কুরিয়ারে একটি নিবন্ধ লিখি। এর শিরোনাম ছিল ‘ক্যারিশমা ইজ নট এনাফ’। বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে এটি লেখা হলেও তার নাম উল্লেখ করিনি। সেখানে আমি লিখেছিলাম ধ্বংস বা বিনাশ (destruction) ও বিনির্মাণ বা গঠন (construction) পুরোপুরি আলাদা বিষয়। তৎকালীন বিশ্বের অনেক ক্যারিশম্যাটিক নেতার প্রসঙ্গ টেনে আমি বলি, শুধু ক্যারিশমা থাকলেই জাতি বা দেশের বিনির্মাণ করা যায় না। পাপুয়া নিউ গিনির প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ইন্দোনেশিয়াকে স্বাধীন করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি সামাল দিতে পারেননি। সুহার্তো তাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। এমন আরো অনেকে জনপ্রিয় ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিতে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা ছিল, জনগণকে আকৃষ্ট করার যে বিশাল ক্ষমতা ছিল। তার মুখের কথায় সাত কোটি বাঙালি উঠত আর বসত। সেই লোকটিকে এভাবে হত্যা করা হলো, এটা তো অবিশ্বাস্য। তিনি হয়তো রাষ্ট্র বিনির্মাণের সময় পাননি।
একটি ঘর ভেঙে ফেলে সেটিকে নতুন করে গড়ে তোলা খুবই দুরূহ কাজ। কাউকে যদি একটি ঘর দেখিয়ে বলা হয় এটা ভেঙে ফেল। সে পারবে। যদি বলা হয় এবার আবার তৈরি করো। তার পক্ষে সেটি সম্ভব না-ও হতে পারে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দেশ স্বাধীন করার জন্য তরুণ প্রজন্মের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়। এটা দরকার ছিল সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু তাদের কি পরবর্তীতে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশ পক্ষত্যাগ করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। শপথ ভঙ্গকারী এসব সেনাই কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহিনীতে থেকে গেছে। একবার যারা শপথ ভেঙেছে তাদের ওপর আস্থা রাখা কি ঠিক হয়েছিল?
আমরা আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা জানি। যারা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি নামেও পরিচিত ছিল। এই বাহিনী ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে গঠিত। তাদের লক্ষ্য ছিল জাপানি বাহিনীর সহযোগিতায় ব্রিটিশ রাজ উচ্ছেদ করে ভারতকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করা। এই বাহিনী গঠিত হয় মূলত জাপানের হাতে আটক ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে। যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর এই বাহিনীর একটি বড় অংশ ভারতে ফিরে আসে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পেছনে এই বাহিনীর বিশাল অবদান ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্রবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হননি ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তার বক্তব্য ছিল, যারা একবার শপথ ভেঙেছে তারা আবার শপথ ভঙ্গ করবে না সেই নিশ্চয়তা কোথায়?
আমার বিবেচনায় এই একটি জায়গায় এসে আমরা ‘সিস্টেমেটিক ব্লান্ডার’ করেছিলাম। যারা আমাদের দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। তাদের আমরা সালাম জানাব। তাদের জন্য আমরা গর্ববোধ করি। আমরা তাদের গুণমুগ্ধ। কিন্তু তাদের সম্মান জানানো উচিত ছিল ভিন্নভাবে, সশস্ত্রবাহিনীতে রেখে দিয়ে নয়। এটা করা গেলে হয়তো আমাদের দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী অনেক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানো যেত।
এরই ধারাবাহিকতায় সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশকজুড়ে এদেশ সামারিক শাসন প্রত্যক্ষ করেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হলো। আমি এই সরকারকে সাধুবাদ জানাই। তবে তখনই আমার আশঙ্কা হচ্ছিল এমন একটি গোলযোগপূর্ণ দেশে এই সরকার টিকে থাকবে কি না। ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বারা নির্বাচন পরিচালনার ইতিহাস তো আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ অনেক দেশে রয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে ততটা পরিপক্ব হয়নি তার প্রমাণ পরবর্তীতে আমরা দিয়েছি। এরশাদের সময় ক্ষমতা যেমন ছিল প্রেসিডেন্টের হাতে অত্যন্ত ঘনীভূত, তেমনি এখন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সংবিধান সংশোধন করেই এই ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। সেখানে আমরা যে বাস্তবতার চেয়ে আবেগে বেশি চালিত হয়েছি তা আমি বুঝতে পেরেছি। নব্বইয়ের দশকে আমাদের জন্য যুগের প্রয়োজনটি ছিল সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ ও একে টেকসই করার চেষ্টা চালানো। মানুষ যেন শঙ্কাহীনচিত্তে কথা বলতে পারে সেই ব্যবস্থা করা।
তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। আমাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির দরকার ছিল। সহিষ্ণু আচরণের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল দরকার ছিল। এটা হয়েও ছিল তিন মেয়াদে। শেখ হাসিনাও ২০০১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিএনপি প্রথম মেয়াদের পর খুবই স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিল। গণতন্ত্র তখন শেকড় গাড়তে শুরু করে। এই দেশ যদি আরো কিছু দিন সময় পেতো তাহলে তৃণমূলে গণতান্ত্রিক চর্চাটা বিকশিত হতে পারত। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠত, সেগুলোর ভিত্তি মজবুত হতো। তবে তখন আমরা পশ্চিমা ধাঁচের পার্লামেন্টারি সিস্টেমের চর্চা শুরু করি তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হবে বলে আমার মনে হয়নি। এর কারণ ছিল আমরা শুধু অনুকরণ করতে শিখেছি, স্বীয়করণ বা আত্মীকরণ করতে শিখিনি। এটাই আমাদের বড় দুর্বলতা।
স্বাধীনতা ছিল আমাদের বিশাল অর্জন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমাদের নৈতিকতার যে অবক্ষয় হয় তা ছিল বিশাল বিসর্জন। আজকে সময়ের প্রয়োজনে যে উপলব্ধি তাতে দেখছি, এখানে লিডারশিপের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা বিপজ্জনক। এই শূন্যতা পূরণ ঐতিহাসিক প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা না হলে শূন্যতা থেকে সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে। নেতৃত্ব তৈরি না হলে দেশের মসৃণ এগিয়ে চলা ব্যাহত হবে। আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাই বলে আমি তাদের অবসরে যেতে বলছি না। কিন্তু বলছি নেতৃত্ব তৈরির কাজে মনোযোগী হতে। আবার কোনো যুগের প্রয়োজনেও নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে পারে। ইতিহাসে এমন নজির রয়েছে। পঞ্চাশের দশকে আমাদের অনেক জাতীয় নেতা দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেন। তখন তরুণ নেতা হিসেবে বেরিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন নবগঠিত আওয়ামী লীগের কয়েকজন যুগ্ম সম্পাদকের একজন। ষাটের দশকে এসে যুগের প্রয়োজন তাকে নেতৃত্বের আসনে আসীন করে দেয়। এর অনেকটা কৃতিত্ব আমি দেব ‘ছয় দফা’-কে। ওই প্রক্রিয়াটিই তাকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। এমনভাবে তিনি বেরিয়ে এলেন যে গোটা জাতি তার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল।
আজকেও তেমন একটি যুগের প্রয়োজন তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি। এটা একান্তই আমার উপলব্ধি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা অন্য যেকোনো দলই হোক না কেন সবার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির কাজে মনোযোগী হতে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক উত্তরাধিকার বা স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিলে হবে না। সেটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। জনগণের পারসেপশন বা উপলব্ধিরও পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্বায়নের কারণে এটা হয়েছে। আর করোনা মহামারী এই প্রয়োজনকে আরো তীব্র করে তুলেছে। করোনাকালে অনিশ্চয়তা আরো বেড়ে গেছে। ফলে সহিংস কিছু ঘটার আশঙ্কাও বেড়েছে। আমার এই আশঙ্কার পেছনে কারণ নৈতিক অবক্ষয়। আমাদের বডি পলিটিকে নৈতিক অবক্ষয় প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে। বিএনপির আমলেও এটা ছিল। তবে একটানা দীর্ঘ দিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে এটা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে আমার বঙ্গবন্ধুর একটি কথাই মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কম্বলটি কোথায়?’ এখন আমরা দেখছি ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচি পরিচালনার মতো বিষয়েও সরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করতে পারছে না, আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমাদের নেতৃত্বেও এভাবে আমলানির্ভর হয়ে পড়া শুভ লক্ষণ নয়। কারণ আমলারা কখনোই পরিবর্তন চায় না। তাই রাজনৈতিক নেতারা যত দ্রুত দেশ এগোবে বলে ভাবছেন তা হবে না। আমলারা কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করতে বেশি আগ্রহী।
নেতৃত্বকে হতে হবে ঈগল পাখির মতো। ঈগল যেমন ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝতে পারে, ফলে ঝড় আসার আগেই ঝড়ের উপরে উঠে যায়। তাই সে রক্ষা পায়। আর ছোট পাখিগুলো ঝড়ের কবলে পড়ে মারা যায়। আমাদের নেতৃত্ব ঈগল পাখির মতো দূরদর্শী হলে জাতিও রক্ষা পাবে। জাতির অগ্রগতির জন্য প্রসপেক্ট, পসিবিলিটি ও প্রসেস- এই তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর প্রসেসটি বুঝতে হবে। সময়ের রহস্য এটাই। আমাদের নেতৃত্বকে সময়ের রহস্য অনুধাবন করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে, জনগণের কল্যাণ করতে চাইলে, দরদি সমাজ গঠন করতে হবে। আর সে জন্য চাই দরদি গণতন্ত্র। স্বজনতন্ত্র পরিহার করা হলে বলতে পারব আমরা দরদি গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি, দরদি সমাজের দিকে যাচ্ছি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা