সম্পত্তির লোভে আমার প্রতিবন্ধী ছেলে এরিখকে আটকে রাখা হয়েছে (ভিডিওসহ)
- নয়া দিগন্ত অনলাইন ১৭ আগস্ট ২০১৯, ১৪:২২
বিদিশা। যিনি বিদিশা এরশাদ নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা ও ফ্যাশন ডিজাইনারও। এই বিষয়ের ওপর সিঙ্গাপুরে পড়াশোনাও করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কবি আবুবকর সিদ্দিকের কিশোরী মেয়ে বিদিশা ব্রিটিশ নাগরিক শিক্ষক-গবেষক উইলিয়ামকে বিয়ে করে লন্ডনে স্থিত হন। এরপর বাংলাদেশে ঘুরতে এসে তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে পরিচয়, সখ্য ও প্রেমে জড়িয়ে পড়েন- একপর্যায়ে এরশাদকে বিয়ে করে বনে যান বিদিশা এরশাদ। তাদের প্রেম-প্রণয় ছিল অনেকটা কালবৈশাখীর মতো আবার বিচ্ছেদও ঘটে টর্নেডোর গতিতে।
এর আগে ২০০০ সালে স্ত্রীর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিদিশা জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পর্যায়ক্রমে হন মহিলা পার্টির সভানেত্রী ও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য। এসব পদধারী হয়ে তিনি জাতীয় পার্টির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। বিদিশার বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। দলের নেতাকর্মীরা তাকে পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেত্রী হিসেবে সমীহ করতে শুরু করেন। গণমাধ্যমে বিদিশার নিউজের চাহিদাও পারদের মতো তরতর করে উঠতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে তিনি গড়ে তোলেন ‘মানচিত্র’ নামে একটি গবেষণা সেল। কিন্তু হঠাৎ করে বিদিশার জীবনে ছন্দপতন ঘটে। ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এরশাদের রাজনীতির বলি হন তিনি। ভেঙে যায় এরশাদ-বিদিশার সংসার। জেলে যেতে হয় তাকে। এ সময় পুত্র এরিখকে নিজের কব্জায় নিয়ে যান এরশাদ। স্বামী-সংসার হারিয়ে একাকী ক্ষুব্ধ বিদিশা ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’ এবং ‘স্বৈরাচারের প্রেমপত্র’ নামে দুটি বই প্রকাশ করে আলোচনার ঝড় তোলেন। সাবেক স্বামী এরশাদের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা বহুল আলোচিত বিদিশা এখন অনেকটাই লোক চক্ষুর অন্তরালে। নিজস্ব ব্যবসা আর বিদিশা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়েই তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন। সাবেক স্বামী এরশাদের মৃত্যুর পর আবার তিনি রাজনীতির আলোয় চলে এসেছেন। জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হচ্ছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। যদিও গত বছর হঠাৎ বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ইফতার পার্টিতে বিদিশার উপস্থিতিতে এ গুঞ্জনের সূত্রপাত। এরই মধ্যে বিদিশা জাপায় সক্রিয় হতে দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে যোগাযোগও করেছেন। এমন সম্ভাবনার কথা বিদিশা নিজেও উড়িয়ে দেননি। তিনি এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির রাজনীতিই করবেন- এমন লক্ষ্য নিয়েই পার্টির নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করছেন বলেও জানিয়েছেন।
বিদিশা নিজের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভাবনা নিয়ে ‘নয়া দিগন্ত’র বিশেষ সংবাদদাতা আশরাফ আলীর সাথে তার গুলশানের বিদিশা ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে মরহুম এরশাদ, সন্তান এরিখ ও জাতীয় পার্টির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। এ সময় এ প্রতিনিধিকে সহযোগিতা করেন নয়া দিগন্তের অনলাইন রিপোর্টার ইকবাল মজুমদার তৌহিদ।
সাক্ষাৎকারে বিদিশা বলেছেন, এরিখ আমাদের প্রতিবন্ধী সন্তান। এরশাদ তার জীবদ্দশায় এরিখকে ভীষণ ভালো বাসতেন। এরশাদের মৃত্যুর পর বাপের জন্য এরিখের বুকফাটা কান্না দেশবাসীকেও কাঁদিয়েছে। তার কান্না দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। অথচ বাপ হারানো এই প্রতিবন্ধী সন্তানকে তার মায়ের কাছেও আসতে দেয়া হচ্ছে না। শুধু কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির লোভে আমার এই প্রতিবন্ধী সন্তানকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এরিখকে নিয়ে এই নোংরা খেলা যারা খেলছে- তাদেরও সন্তান আছে। তাদের বিচারটা কিন্তু ভয়াবহ হবে। নির্যাতিত নারীদের বদদোয়া কিন্তু আল্লাহ সবার আগে কবুল করেন। যারা আমার ঘর ভেঙেছে- তাদের ঘর চলে গেছে, যারা আমার সন্তান নিয়ে খেলেছে- তাদের সন্তান নেই, আমাকে যারা বিদেশ পাঠাতে চেয়েছে- আজকে তারাই বিদেশে পড়ে আছে। যারা আমাকে জেলে পাঠিয়েছিল- তারাই আজ জেলে পড়ে আছে। তিনি বলেন, যারা এরিখকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছেন- এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। বিদিশা বলেন, আমার প্রতিবন্ধী ছেলেকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবো। সাংবাদিক সম্মেলন করব, প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন করব। প্রয়োজনে আমি আইনের আশ্রয় নেবো।
নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশটুকু তুলে ধরা হলো :
নয়া দিগন্ত : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে আপনার পরিচয় প্রেম, প্রণয়, বিচ্ছেদ এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াÑ এসব বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বিদিশা : আসলে এরশাদের সাথে আমার সব কিছু প্রেম থেকেই শুরু, অর্থাৎ পজেটিভ দিয়ে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে নেগেটিভের দিকে গেছে। আবার নেগেটিভ থেকেও শেষের দিকে পজিটিভ হয়েছে। হ্যাঁ, শুরুতে তো আমি ওনার প্রেমে পড়েছিলাম, আমাকে ওইভাবে কনভিন্স করতে পেরেছিলেন। তখন আমি বিবাহিতা, এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের স্ত্রী। সেখানে আমার দুই সন্তানও আছে। আমি ইংল্যান্ড থেকে তখন দেশে এসেছিলাম। এরশাদ সাহেব মানুষকে দ্রুত কনভিন্স করতে পারতেন। আমি উনার প্রেমে পড়লাম, তারপর আমাকে বিয়েও করলেন। আসলে প্রেমের সময়টা বেশি দিন ছিল না, উনি আগেই ডিসিশন নিয়েই নিয়েছিলেন আমাকে বিয়ে করার। বিয়ে হলো, এরিখকে ঘিরে ভালোভাবে সংসারও ছিল। তারপরে রাজনীতিতে আমাকে উনিই এনেছেন। এরশাদ সাহেব নিজেই আমাকে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছেন। আমি রাজনীতি করার কথা কখনো ভাবিনি। এ দেশের রাজনীতির প্রতি আমার কোনো ধারণাও ছিল না, রাজনীতি বুঝতামও না। উনি আমাকে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করে দিয়েছেন। আর এটা করতে গিয়ে অটোমেটিকলি আমাকে পার্টিতে পদ দেয়া হয়। আমাকে মহিলা পার্টির সভাপতি, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা এবং পরে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যও করা হয়। যেহেতু আমার বাইরে পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, লন্ডনে ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছি। ভালো ইংরেজি জানি। মানুষের সাথে ওঠা বসা করতে পারতাম। এরশাদই আমাকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমি পার্টির ফরেন সাইটগুলো দেখাশোনা করতাম। বহির্বিশ্বে জাতীয় পার্টিকে ইন্ট্রোডিউস বা রিপ্রেজেন্ট করার কাজগুলো আমি খুব ভালোভাবে করেছি। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বাসায় আসতেন, সবার সাথে আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল এটা ওনার কারণেই হয়েছে। এভাবেই আমার রাজনীতিতে উত্থান।
নয়া দিগন্ত : আপনার ডিভোর্স পরবর্তী গ্রেফতার, জেল-জুলুম, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
বিদিশা : ওই ঘটনা ছিল আমার জীবনের একটা ব্ল্যাক চ্যাপ্টার-কালো অধ্যায়। আসলে ওই বিষয়টি কেন জানি আমি আর মনে করতে চাই না। তবে এ থেকে আমি প্রচুর শিক্ষা নিয়েছি। ওই সময় আমার নখগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছিল, আমাকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছিল, আমার গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ২৭ দিন আমাকে টর্চার সেলে রাখা হয়েছিল। তখনকার ক্ষমতা ব্যবহার করে এই কাজটা যারা করেছে তারা আজকে অনেকেই মারা গেছেন। তখন তারা সাকসেসফুল হয়েছিল। কিন্তু আমি তো ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এত কিছু করেও আমাকে শেষ করতে পারেনি। আপনার একটা কথা মনে আছে কি না? আপনাদের পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয়েছিল ‘বিদিশা চ্যাপ্টার ইজ ক্লোজ’। আমি বলেছিÑ বিদিশা চ্যাপ্টার কোনো দিন ক্লোজ হবে না। বিদিশা বাংলাদেশে ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে। এটার পেছনে তো জনগণের দোয়া আছে। এখন আর আমার নামের আগে ও পরে কারো নাম যোগ করতে হয় না। এখন দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ আমাকে বিদিশা নামেই চেনেন।
নয়া দিগন্ত : তার মানে সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল!! তারপর বিপর্যয়টা নেমে এলো কিভাবে?
বিদিশা : এই বিপর্যয়ের পেছনে তখনকার যারা সরকার ছিলেন তাদের সাথে জাতীয় পার্টির একটা শক্তিশালী গ্রুপ কাজ করেছে। ওই গ্রুপে পার্টির অনেক সিনিয়র নেতা ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকে মারাও গেছেন। তাদের নাম বলতে চাই না। আমার লেখা বইতেই আমি তা স্পষ্ট করে লিখেছি।
নয়া দিগন্ত : সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্ত্রী হিসেবে আপনার কতদিন কেটেছে?
বিদিশা : বেশি দিন না, সেটা ধরেন-প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে-সংসার সব মিলিয়ে ছয় বছরের মতো হবে।
নয়া দিগন্ত : আমরা যতটুকু জানি এরশাদ সাহেব আপনাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তাহলে বিচ্ছেদের মতো এমন নিষ্ঠুর ডিসিশন তিনি কেন নিলেন-এর পেছনে কারা জড়িত ছিলেন?
বিদিশা : ওনার সাথে আমার একটা আত্মার সম্পর্ক ছিল। উনি মারা যাওয়ার আগেও সেটা রক্ষা করে গেছেন। তবে তিনি মানুষের কানকথা শুনতেন। অন্যের দ্বারা দ্রুতই প্রভাবিত হতেন, অন্যের পরামর্শে চলতেন। ফলে যেকোনো সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারতেন না। যে কারণে সকালে এক রকম কথা বলতেন আবার বিকেলে আরেক রকম। জাপায় কিছু খুব খারাপ লোক ছিল। তারা আমাদের সংসার ভেঙেছে-ক্ষতি করেছে। এই মানুষগুলোর কেউ কেউ এখনো আছে- যারা আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, আমার দোষের কোনো শেষ নেই, কারণ আমি সেই সময় খুব বোকা সোকা টাইপের ছিলাম। আমি মনে করতাম, আমি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। আমার মাথার ওপর ছাদটাই তো উনি, উনি তো আছেন। অথচ তিনিই আমাকে সকালে আম খাইয়ে দুপুরেই পুলিশের কাছে দিয়ে দেবেন, এটা ভাবতেও পারিনি।
নয়া দিগন্ত : আসলেই কি আপনি নিজেকে বোকা মনে করেন, নাকি রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কথা বলছেন?
বিদিশা : আমি বলছি না আমি ইন্টেলিজেন্ট। হ্যাঁ এখন আমি গত কয়েক বছর ধরে লেখাপড়া করেছি প্রচুর। বলব না রাজনীতিবিদ হয়ে গেছি, কিন্তু এটা বুঝি যে- একটা মানুষ আমার কাছে কি কারণে আসছেন। যেটা আগে আমি বুঝতাম না। আগে আমি অনেক অস্থির ছিলাম। সেটা আমার বয়সের দোষ হতে পারে।
নয়া দিগন্ত : আপনার ডিভোর্স ও গ্রেফতার হওয়ার পর আপনার গড়া পার্টির গবেষণা সেল ‘মানচিত্র’ বন্ধ হয়ে যায়। আপনি কি সেই মানচিত্র আদলে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন?
বিদিশা : পার্টির গবেষণা সেল মানচিত্রের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ আমার কাছে আসত। দেশের ৩০০ আসনেই তিনটা স্টেটমেন্ট করে লিডারশিপ তৈরি করেছিলাম। এখন মানচিত্র না থাকলেও মানুষ আমার কাছে আসছে। সারা দেশে আমার একটা পপুলারিটি বা পরিচিতি আছে। এখনো আমার কোনো নিউজ অনলাইনে বা সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুকে ব্রডকাস্ট হলে হাজার হাজার মানুষ তাতে কমেন্ট করেন। এর মধ্যে নিশ্চয়ই পজিটিভ দিক আছে। আমি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলাম, আমি মনে করি- এখনো আছি। কারণ আমাকে কিন্তু বহিষ্কার করা হয়নি, আমার ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়েছিল মাত্র। তবে আমি এখন আর জাতীয় পার্টিতে অ্যাক্টিভ নই। তাতে কিন্তু আমার কর্মকাণ্ড থেমে নেই। তা ছাড়া আমি তো আর অন্য কোনো পার্টি করিনি, করবও না। আমি জাতীয় পার্টির কর্মীদের মনে করি আমার সন্তান এরিখের মতো। আমার কাছে যারা আসেন, যোগাযোগ করেন- নেতা বলেন আর কর্মী বলেন- তাদের সাথে আমার একটি প্রাণের সম্পর্ক আছে। সেই জায়গা থেকে তারা আসেন। তারা আমাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে বলছেন কিন্তু সিনিয়র কয়েকজন নেতা তাতে বাধা দিচ্ছেন। তারা আমাকে ভয় পান। তাদের আশঙ্কা জনগণ আমাকে পার্টির চেয়ারম্যান বানিয়ে ফেলবেন।
নয়া দিগন্ত : তার মানে কোনো পদ-পদবি না থাকলেও আপনি এখনো জাতীয় পার্টিতেই আছেনÑ তো খুব শিগগিরই পার্টিতে ফেরার বা সক্রিয় হওয়ার কোনো আকাক্সক্ষা বা ইচ্ছা আছে কি?
বিদিশা : আকাক্সক্ষা তো থাকবেই, কেন থাকবে না? এটা আমার সাবেক স্বামীর পার্টি। এখানে তো সবার আগে আমার সন্তান এরিখের অধিকার বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভাই তো কখনো উত্তরাধিকার হতে পারে না। উত্তরাধিকার হলে ওয়াইফ ও সন্তান হবে। দলের গঠনতন্ত্রের প্রথম পাতায় লেখা আছে- এরশাদের পরে ম্যাডাম রওশন এরশাদের নাম। অটোমেটিকলি সিরিয়ালি রওশন এরশাদ আসবেন, তারপরে সন্তান হিসেবে আমার সন্তান এরিখ আছে। হ্যাঁ এরিকের হয়তো একটু শারীরিকভাবে সমস্যা আছে কিন্তু মেন্টালি তো নয়। আর আমি তো এরিখের মা, সেখানে তো মানুষ আমাকে চায়। রংপুরের মানুষ এরশাদ সাহেবকে কী পরিমাণ ভালোবাসেন- তা তার দাফনের সময় বোঝা গেছে। তার জনপ্রিয়তা দেখে সারা দেশের মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেছেন। রংপুরের মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত তার কবর জিয়ারত করতে বলছেন কিন্তু ওরা তো আমাকে লাশই দেখতে দেয়নি। আমি যখন এরশাদ সাহেবের ভাইকে মেসেজ পাঠিয়ে যোগাযোগ করেছিÑ তিনি সেই মেসেজের কোনো উত্তর দেননি। ওনার উপদেষ্টাদের সাথে যোগাযোগ করেছি- তারা বলেছেন, উনি চাননা আপনি আসেন। সো ওনার এই যে ইউ টার্ন সারা দিন আমার সাথে কথা বলছেন, আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন, হাজার হাজার মেসেজ দিয়েছেন। আমার সাথে কত কিছু আলাপ আলোচনা করেছেন, কিন্তু হঠাৎ করে তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন। স্যারকে কবরে নামানোর সময় নিজেকে চেয়ারম্যান দাবি করলেন। মানুষ এটা ভালোভাবে নেয়নি। একজন মানুষ মারা গেছেন। উনি পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কয়েকটা দিন পরে করতেন, সবকিছুর মধ্যে একটা সৌন্দর্য আছে। আপনিই তো হবেন, আপনাকে তো ওনার বর্তমান বউ কিংবা সাবেক বউ কেউ বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু এত তাড়াহুড়া কেন? এটা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
নয়া দিগন্ত : এরশাদ সাহেব নিজেকে যতটা না ভালোবাসতেন তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন এরিখকে। সে এরিখ তার বাবাকে হারিয়েছে। সেই প্রতিবন্ধী সন্তানের সাথে আপনাকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আপনি কি করতে চান বা আপনার পরবর্তী পদক্ষেপই বা কী?
বিদিশা : এরিখ সাধারণ আর দশটা সন্তানের মতো ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ওর হাত-পা একটু বাঁকা ছিল, মুখ থেকে লালা পড়ত, চার বছর পর্যন্ত হাঁটতে পারত না। অপারেশন করার পরে হাঁটতে শুরু করল। এরিখ শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। সুতরাং আমাদের পুরো মনোযোগ ছিল এরিখের প্রতি। ওর সামান্য একটু উহ-আহ শব্দ আমরা সহ্য করতে পারতাম না। এরিখের জন্মের পর আমরা তাকে কখনো ব্যথাও পেতে দেইনি। এরশাদ সাহেবের সাথে আমার আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আমি যখন আলাদা বাসায় চলে আসি তখনো কিন্তু এরিখকে তিনি আটকাননি। বাবা মারা যাওয়ার সময় সেই এরিখের কান্না দেশের সব মানুষকে কাঁদিয়েছে। সব প্রতিবন্ধীর মাকে কাঁদিয়েছে। আমাকে তারা যেতে দিচ্ছে না, আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। এরিখকে নিয়ে এখন নোংরা খেলা হচ্ছে। মা হিসেবে আমাকে ধৈর্য ধরতে হচ্ছে, আমি ধৈর্য ধরে দেখছি। এরশাদের গাড়ি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, কাপড়, জুতা নিয়ে যাচ্ছে। নিক, সব নিয়ে যাক। তারা তো শুধু এরিকের ট্রাস্টের ইনকামটা চায়। ট্রাস্ট তো তারা নিতে পারবে না। কারণ ট্রাস্ট এমনভাবে এরিখের বাবা করে গিয়েছেন যেখানে কাউকে রাখেননি। এরশাদ সাহেবের দয়া দাক্ষিণ্যে তাদের এক একজনের সংসার চলেছে। সো, আজকে এগুলো যারা করছে তাদের রেজাল্ট কিন্তু খুব ভয়াবহ হবে। আমার আফসোস লাগে- এরিখ শুধু প্রতিবন্ধী নয় রাষ্ট্রও প্রতিবন্ধী। আমার মনে হয়, তারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, বাকপ্রতিবন্ধী। তা না হলে এরিখের মতো একজন প্রতিবন্ধী শিশুকে আটকে রাখায় রাষ্ট্রের কি কিছু যায় আসে না? তারা সেটি দেখবে না?
নয়া দিগন্ত : তার মানে এর পেছনে রয়েছে এরশাদ সাহেবের রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদ?
বিদিশা : অবশ্যই, আর কিছু নয়। এটা ক্লিয়ার এবং তারা বাজারে প্রচার করার চেষ্টা করছে বিদিশা এগুলো চায়। বিদিশার যদি সম্পদই দরকার হতো তাহলে গত ১৪ বছর কিভাবে কাটল? ১৪ বছরে এরশাদ সাহেবের ১৪ পয়সাও তো বিদিশার লাগেনি। আল্লাহর রহমতে বিদিশার আজকে নিজের একটা ফাউন্ডেশন আছে, বিদিশা ক্যাটারিং আছে, রেস্টুরেন্ট আছে, বায়িং হাউজ আছে, গার্মেন্ট আছে- এনাফ। আমি আরো ১০টা সন্তানকে খাওয়াতে পারি। তাদের জন্য আমার ক্যাটারিং থেকে প্রতিদিন ২৭০ প্যাকেট খাবার যায়।
নয়া দিগন্ত : এই যে আপনার সন্তানের সাথে আপনাকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না- এটা অব্যাহত থাকলে আপনি কি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেবেন?
বিদিশা : না, এটা অব্যাহত থাকবে না। আমি সব ব্যবস্থা নেবো। আমি তো বলেছি- আমি রাজপথে যাবো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গিয়ে বসে থাকব, সেখানে অনুষ্ঠান করব, আমি প্রেস ক্লাবে গিয়ে প্রেস কনফারেন্স করব। এ ব্যাপারে যা যা করণীয় আমি সমস্ত কিছু করব। সন্তানের জন্য মা কি তা করবে না? নিশ্চয়ই করবে, কারণ তারা আমার এরিখকে নিয়ে অনেক কিছু করতে পারে। এমনকি দুই দিন পর এরিখকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা স্টেটমেন্ট দেয়াবে। অনেক কিছু করতে পারে, অনেক নোংরা খেলায় নামতে পারে তারা। বেসিক্যালি তারা যে নোংরা লোক- এটা দেশ ও জাতি জেনে গেছে।
নয়া দিগন্ত : এখন ব্যস্ততা কী নিয়ে?
বিদিশা : এখন আমি আমার নিজের ব্যবসা এবং ‘বিদিশা ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে ‘নারী মুক্তি দেশের শক্তি’ স্লোগান নিয়ে কাজ করছি। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডও করছি। ফেসবুকে আমার অসংখ্য ফলোয়ার। আমি ডিজাইনিংয়ের কাজও করছি। সবমিলিয়ে আমার সময় এখন বেশ ব্যস্ততায় যাচ্ছে। বলতে গেলে ফাউন্ডেশন নিয়েই ব্যস্ত আছি।
নয়া দিগন্ত : জাতীয় পার্টি ও এরশাদ ভক্তদের উদ্দেশে আপনার বক্তব্য কি?
বিদিশা : পার্টির সিনিয়র নেতারা তো তাদের পদ-পদবি আর টাকা-পয়সা নিয়েই ব্যস্ত আছেন। পার্টির জুনিয়রদের দিকেও নজর দিতে হবে, তাদের জন্য একটা ফান্ড ক্রিয়েট করতে হবে। অনেক নেতাকর্মী এরশাদের জাতীয় পার্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। রাজপথে তারা মার খেয়েছেন। আজকে তারা নিঃস্ব, তাদের কিন্তু কিছুই নেই। তারা চোখের পানি ফেলছেন। তাদের জন্য জাতীয় পার্টির একটা ফান্ড গড়ে তোলা দরকার। তাদের বিপদের সময় যেন পাশে দাঁড়ানো যায়। মনে রাখতে হবে, জাতীয় পার্টির প্রাণ শক্তিই হচ্ছে তৃণমূল কর্মীরা। আমি কর্মীদের উদ্দেশে বলতে চাই- যারা আমাকে ভালোবাসেন আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনারা এরিখের জন্য দোয়া করবেন, স্যারের জন্য দোয়া করবেন। আমি জাতীয় পার্টিতে থাকি বা না থাকি, আমি আপনাদের জন্য আছি। সারাজীবন আপনাদের পাশে থাকব। রংপুরবাসী এরিখের বাবার জন্য যে সম্মানটা দেখিয়েছেন, তার জন্য আমি রংপুরবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ। এটা আমরা কোনো দিন ভুলব না। আমি এবং এরিখ আপনাদের এলাকার কোনো দিন প্রতিনিধিত্ব করতে না পারলেও যেভাবেই পারি সব সময় রংপুরবাসীর পাশে থাকব।
নয়া দিগন্ত : শত ব্যস্ততায় এ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
বিদিশা : আপনাকেও এবং আপনার মাধ্যমে নয়া দিগন্তের পাঠকদেরও ধন্যবাদ।