- মো: মাঈন উদ্দীন
- ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:৪৭
বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া ও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের পথ চলার কথা ছিল। সে লক্ষ্যে কি অর্থনীতি চালিত হচ্ছে? আমাদের সামনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অনেক সমস্যা। রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ। আছে সম্ভাবনাও। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা উচিত। মূল চ্যালেঞ্জ হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেয়া। উল্লেখযোগ্য সমস্যার মধ্যে আছে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ কমে যাওয়া, ব্যাংকিং খাতে নানা সঙ্কট, হুন্ডি ও মুদ্রাপাচার, দুর্নীতি, দিনদিন আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে যাওয়া এবং কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা। পাশাপাশি রয়েছে নীতির দুর্বলতা ও অথনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক প্রভাব।
এসব সমস্যা আমরা অনায়াসে সমাধান করতে পারতাম। শুধু বাহ্যিক সমস্যা যেমন কোভিড-১৯ এর প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কারণে তা ব্যাহত হয়েছে। এর জন্য অব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলার অভাব, সিদ্ধান্তহীনতাও অনেকাংশে দায়ী।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ২০২১ অর্থবছরে আমদানি কমে গেলেও পরের বছর প্রায় দ্বিগুণ পণ্য আমদানি হয়। কিন্তু সে সময় তা নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়, যা পরে আরো দীর্ঘ হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অনেক দেশ ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেও বাংলাদেশ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ঋণের সুদ হারও বাজারের ওপরে ছেড়ে দেয়নি। বিশ্ববাজারে চড়া দামে পণ্য আমদানির সময় যেমন নিয়ন্ত্রণ হয় তেমনি বিশ^বাজারে দাম কমার পর স্থানীয় বাজারে তা সমন্বয় করা হয়নি।
ডলার সঙ্কটের কারণে একদিকে যেমন রিজার্ভ কমতে শুরু করে পাশাপাশি কড়াকড়ির কারণে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে রফতানি খাতে। আমাদের যে পরিমাণ রফতানি হয় সে অনুযায়ী ডলার দেশে না এসে পাচার হয়ে যায়। সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, রাজস্ব আদায়ে নিম্নহার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাতের আয় বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থাসহ সব সূচকেই তা নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির পাশাপাশি বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি রয়েছে। সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মনে করি অর্থনীতি ভুল পথে চলছে। তবে পথ যতখানি ভুল হয়েছে সেটার চেয়ে বড় কথা হলো- সেই পথ কখন ও কোথায় বাঁক নিতে হবে, কোথায় নামতে হবে সেটাকে আমরা সংস্কার বলি, সেখানে নীতি প্রণয়নে আর বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ফলে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ প্রতি মাসেই কমছে। আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ বর্তমানে ১ হাজার ৭০০ কোটি (১৭ বিলিয়ন) ডলার।
তবে সরকার আইএমএফকে যে হিসাব দেয় সে অনুযায়ী দেশের রিজার্ভ ২ হাজার ৯০ কোটি (২০.৯০ বিলিয়ন) ডলার। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে গত দুই বছরে প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। ২০২২ সাল থেকে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০২২ সালে যেখানে মাসে প্রায় ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসত, সেখানে ২০২৩ সালে প্রথম তিন প্রান্তিকে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০-১৬০ কোটি ডলার এসেছে। বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে। এই চার খাতেই আয়ের ধারা নিম্নমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের বহুমুখী সিদ্ধান্তেও সুফল আসছে না। এতে টাকার মান আরো কমে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়ছে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হলে রফতানি আয় বাড়াতে হবে। সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বৈশ্বিক মন্দায় রফতানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি জুলাই-আগস্ট (২০২৩) কমেছে ২৮ শতাংশ ও এলসি খোলা কমেছে ১৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়েছিল ৩৪.৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ। ১ বছরের ব্যবধানে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। রেমিট্যান্সের দিকে দেখলে তা দেখা যায় এ বছর জুনে রেমিট্যান্স এসেছে ২২০ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা কমে ১৬৭ কোটি ডলার, আগস্টে তা আরো কমে ১৬০ কোটি ডলার এসেছে। তিন মাসের হিসাবে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫.১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এসেছিল ১২.২৭ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের একই সময়ে বাড়ার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩.৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদানের গতিও নিম্নমুখী।
২০২১-২২ অর্থবছরে অনুদান বেড়েছিল ৫১.৭৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাইয়ে বেড়েছিল ৮৪.৩৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) একই সময়ে কমেছে ৩.১৩ শতাংশ। বৈদেশিক বিনিয়োগ ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ১৮৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এসেছে ১৬১ কোটি ডলার। গত বছরে জুলাইয়ে এসেছে ১৭ কোটি ও চলতি বছরের একই সময়ে এসেছে ১৮ কোটি ডলার। এর বিপরীতে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশী বিনিয়োগ তুলে নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সময়ে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহও কমে গেছে। এ কারণে ডলারের প্রবাহ বাড়ছে না। আগে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার ছিল কম। এখন বেড়ে যাওয়া চড়া সুদে কেউ ঋণ নিতে চাচ্ছে না। যার ফলে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশের রিজার্ভ কমেছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামছুল আলম একটি দৈনিক সাক্ষাৎকারে বলেন, বৈদেশিক সহায়তায় আপ অ্যান্ড ডাউন থাকবেই। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা এখনো প্রচুর বৈদেশিক ঋণ নিতে পারি।
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা কখনো কিস্তি পরিশোধে খেলাপি হইনি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের মতো ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছে। ২০২৬ সালের পর এটি বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার। কিন্তু সে তুলনায় যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয় না বাড়ে তাহলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টেও চাপ আসার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে চলেছে। বিশ^ব্যাংক পূর্বাভাস করেছে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আগের অবস্থায় ফেরার আগে ২০২৪ অর্থবছরে কমে ৫.৬ শতাংশে দাঁড়াবে।
রফতানি আয়ের গুরুত্বও সবচেয়ে বেশি অংশীদার গার্মেন্ট ও গত ৭ মাসে রফতানি কমেছে ২৯ শতাংশ, যা মোট রফতানির এক-তৃতীয়াংশ, ইউরোপের বাজারেও কমেছে ১৪.৫০ শতাংশ। পাশাপাশি জ¦ালানির দাম বৃদ্ধিও দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় এ খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটিও অত্যন্ত চাপে পড়েছে। অর্থনীতির এমন মন্দার মধ্যে দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরসের পর আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিচ রেটিংসও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসকে স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক দিকে ধাবিত হওয়ার খবর দিয়েছে।
অর্থনীতি যে ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে আছে তার আর একটি নমুনা আমাদের ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের ছাড় দেয়ার পরও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ হিসাবও বলছে, জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়ে গেছে। এপ্রিল-জুন/২০২৩ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। জানুয়ারি-জুন/২০২৩ ছয় মাসে বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেশি, সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খেলাপি গ্রাহকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞগণ ঋণ খেলাপি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করার কথা বলেছেন। উন্নত দেশগুলোর মতো খেলাপি গ্রাহকদের মাল ক্রোক করাসহ তাদের জেলে পাঠাতে হবে। বিচারে কোনো আপিলের সুযোগ রাখা যাবে না। অর্থঋণ আদালতের কাজ দ্রুত ও যুগোপযোগী করতে হবে। খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। ব্যাংকগুলোর উচ্চ পর্যায়ে থাকা লোকদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেও খেলাপি বেড়েছে। ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা, তদারকি ঘাটতি, অনিয়ম জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও রয়েছে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে কঠোরভাবে এসব অনিয়ম দূর করতে হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সুপারিশে বা যোগশাজসে বিতরণকৃত ঋণই খেলাপি হয়ে থাকে। খেলাপি ঋণের কারণে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোই যে সমস্যা পড়ছে তা নয়। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো কঠোর হওয়া উচিত। অনিয়ম বন্ধ হলে, ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে খেলাপি ঋণ কমে আসতে বাধ্য। বর্তমান ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি সম্পদের অপচয় রোধ করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতা, মানবিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করতে হবে। অসৎ ব্যবসায়ীরা যেন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয় না পায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
অর্থনীতি মজবুত করতে হলে, ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের দেশে সম্পদ অনেক, আমাদের জনসংখ্যাও সবচেয়ে বড় সম্পদ। সব সম্পদের হেফাজত ও সঠিক ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেল : [email protected]