সমাজে বিকৃতির বিস্তার ঘটছে

ইংরেজি একটি বাক্য ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’। অর্থাৎ যন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটি। এটি শুধু একটি বাক্য নয়। এর দোতনা অনেক ব্যাপক, সেই সাথে ‘ইলামট্রিসিটি’ও বিস্তর। এই বাক্যকে টেনে অনেক দূর পর্যন্ত নেয়া যায়। তার ব্যাখ্যাও নানা ধরনের হতে পারে। তবে তার অর্থ ব্যাখ্যা অবশ্যই ইতিবাচক হওয়া বাঞ্ছনীয়, নেতিবাচক নয়। একে যদি নেতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, সেটি হবে বিকৃতি, অনাকাঙ্ক্ষিত।

যাই হোক, যন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটির গুরুত্ব ও মূল্য অনেক ক্ষেত্রেই যন্ত্রের চেয়ে কম নয়; বরং বেশি। সেই মানুষটির ভূমিকার ওপরই যন্ত্রের সচল থাকা কারিগরি সক্ষমতা প্রদর্শন অনেকখানি নির্ভর করে। আর যদি একে সমাজের মধ্যে নিয়ে উপস্থাপন ও বিস্তরণ ঘটানো হয়। তার ব্যাখ্যা হতে পারে সমাজের শৃঙ্খলা বিধান, মূল্যবোধের বিকাশ, সুষ্ঠু সচল সবল এবং গতিশীল করা। সমাজের সেসব প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের প্রধান নির্বাহী ও তার সহযোগিতাই মূলত সমাজযন্ত্রের পেছনে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি। সে জন্য ওই সব ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমাজকে বিন্যস্ত করে যে প্রতিষ্ঠান যত চমৎকারভাবে চলতে ফিরতে পারে। তার দায়িত্বগুলো সুষ্ঠুভাবে আদায় করতে সক্ষম। তার অর্থ সমাজযন্ত্রের পেছনে থাকা ব্যক্তিদের দক্ষতা সক্ষমতাকে বোঝায় আজ কি কেউ বলতে পারবেন, সমাজযন্ত্রগুলো বিরামহীনভাবে নির্ভুলভাবে কাজ করছে। সব কিছু চকচকে ঝকঝকে মনে করার কোনো অবকাশ এখন বিদ্যমান। অনেকেই সে কথা বলতে পারবেন না। কারণ সর্বত্রই সমাজযন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষগুলো তাদের সক্ষমতা দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অবশ্যই তাদের যথেষ্ট দুর্বলতাই দায়ী। সেটুকু তারা করছেন না বা করতে পারছেন না। সে কারণে কোনো সফলতার দেখা মিলছে না। সেসব নির্বাহী যতই মন্দ করুন, তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই; অর্থাৎ কেউই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। সরল কথা হচ্ছে, সমাজ থেকে এখন জবাবদিহির সংস্কৃতির ইতি ঘটেছে বলা চলে। এটি শুধু কোনো এক স্থানে স্থির হয়ে আছে, তা শুধু নয়। সর্বত্রই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবখানেই এর বিস্তার ঘটেছে। এর ফলে যা অনিবার্য, সেটি অব্যবস্থা, অনিয়ম, আত্মসাৎ আরো হরেক রকমের মুসিবত। ফলে মানুষ তার চাওয়া-পাওয়ার সাথে বাধ্য হয়ে আপস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে কেউ চরম নিরুৎসাহীও হয়ে পড়ছে। এমন মনোভাব তৈরি হয়েছে, আমরা আর কিছু বলব না দিনের শেষে সব মানিয়ে নেবো। এর ফলে একটি অপবিত্র বিনিময়কে এখন আর গর্হিত কাজ বলে মনে করছেন না কেউ। এতে সমাজ গোল্লায় যাক, মানুষ দুর্ভোগ দুর্বিপাকে পড়–ক দুর্জনদের দৌরাত্ম্য সীমাহীন হোক। সে জন্য কারো ভ্রূকুঞ্চন নেই। এমন পরিস্থিতি আসলে একটি সমাজের ভেঙে পড়ার পূর্বক্ষণ বলে মনে করা হয়।

যে কথা স্মরণ না করলেই নয়। যন্ত্রের পেছনের মানুষটিকে যদি বাছাই করার ক্ষেত্রে যথাযথ ও প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে যন্ত্রটি কেবল বিকলই হবে না, সেখানে বিকৃতিও ঘটবে অনিয়ম অব্যবস্থাই আসবে। সব সমাজেই ভুলের চেয়ে বিকৃতিকে ভয়ঙ্কর বিপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভুলত্রুটিকে শোধরে নেয়ার অবকাশ থাকে। কিন্তু বিকৃতিকে দমিত করা সহজ নয়। বিকৃতি অনেক নেশার মতো আসক্তি তৈরি করে। তা থেকে সরে আসার জন্য যে বোধ বিবেচনার আশ্রয় নিতে হয়। বিকৃতি সেসব বোধ বিবেচনার পথটিই রুদ্ধ করে দাঁড়ায়। বিকৃতি সব ক্ষেত্রেই সমাজকে অবিরত অন্ধকারে নিতে নিরন্তর চেষ্টা করে। কোথাও এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে সেখানে দলে বলে সবাই দিশাহীনভাবে ছুটতে থাকে। সে সময় আর কেউ পাশে থাকে না পতনযাত্রাকে রুখে দিতে। বিকৃত সমাজযন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটিসহ আরো অনেক বিপর্যস্ত করে। ফেলে সবাই তখন আত্মসমর্পিত হতে বাধ্য। অহরহ এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। তার কোনো প্রতিকার প্রতিরোধ নেই। বহু ঘটনা থেকে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটিমাত্র বিকৃতির ছবি তুলে ধরা যেতে পারে।

সে ঘটনা ঘটেছে শেরপুর জেলা সদরে। বিধিবদ্ধ অধিকারের দাবি নিয়ে এক সংবাদপত্রসেবী নিয়ম-সম্মতভাবে কিছু তথ্যের জন্য জেলার যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে তার অধিকারকে শুধুই অস্বীকৃতিই জানানো হয়নি। সেই উপলক্ষে তার বিরুদ্ধে ত্বরিত মামলা রুজু করে তৎক্ষণাৎ কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখানেই প্রশাসন যন্ত্রের পেছনে থাকা লোকটির বিকৃতিই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এ তো মাত্র ছোট্ট একটি নজির। লালমনিরহাটেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সর্বত্র এমন বিকৃতি নিয়তই ঘটছে। এক ব্যক্তির বিকৃতি সমাজের বহু মানুষকে সঙ্কটের ভেতর ফেলে দিচ্ছে। শেরপুর ও লালমনিরহাটে যে দুই সাংবাদিক হেনস্তা হয়েছেন তাদের গোটা পরিবারকেই শুধু মনোকষ্টেই নয়, তাদের আর্থিক দুর্গতিতেও ফেলছে। এভাবে দেশের কত পরিবার যে এমন বিষময় যন্ত্রণা আর আর্থিক ভোগান্তিতে রয়েছে। এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মূল্যবান গবেষণার একটি অভিসন্দর্ভ রচিত হতে পারে, যা একালের নানা বিকৃতির একটি মূল্যবান দলিল হয়ে দাঁড়াতে পারে। আজকের দিনের সমাজ চিত্রটি খুঁজে পেতে পারেন ভবিষ্যতের সত্য অনুসন্ধানী ইতিহাসবিদদের। তবে এমন একটি গবেষণাকর্মকে এগিয়ে নেয়া আজকের সমাজ বাস্তবতায় খুব সহজ হয়তো নয়। কাল বহমান, তা রুধিবার শক্তি কারো নেই। সবাই জানেন কখনো কোথাও ঝড় উঠলে, তখন অনেকেই শুধু শরীরের একটি অংশকে কেবল নিরাপদ করতে চাইলেই ঝড় থেকে গোটা শরীরকে রক্ষার উপায় থাকে না।

সবাই এটি লক্ষ করছেন। আজকে বহু প্রতিশ্রুতি শুধু দেয়ার জন্য দেয়া হচ্ছে। সেটি অঙ্গীকার পূরণের জন্য নয়। এটিকেও ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’-এর একটি বিকৃতি হিসেবেই ধরে নিতে হবে। অথচ এমন বিকৃতি কখনো বিলাস হয়ে পড়ে। তা আবার সবার জন্য বিলাস নয়। বহু ক্ষেত্রে বহুজনের জন্য তা শুধু বিষময় নয়। হৃদয় ভাঙার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমন ভগ্ন হৃদয়ের জনগোষ্ঠী নিয়ে কখনো কোনো জনপদের মানুষকে কোনো কর্মেই উদ্যম উদ্যোগী করা সম্ভব নয়। কোনো জনপদের মানুষ এমন পরিস্থিতিতে সব কিছু থেকে দূরে সরে যেতে দেখা যাবে। যার পরিণতি সমাজের কোনো একজন মানুষকেও আর দৃঢ় ও প্রত্যয়ী করা সম্ভব নয়। জনপদের সর্বস্তরের জনগোষ্ঠী প্রত্যয়ী ও অবিভাজ্য না হলে কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসা সম্ভব হয় না। যে জনপদের মানুষ যতটা তৃপ্ত সেখানে ঠিক ততটাই সব দিক থেকে তাদের আরো অগ্রসর করা সহজ। যেকোনো অতৃপ্ত বঞ্চিত মানুষ শুধু পিছু হাঁটতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সম্মুখের সব পথ তার জন্য অচেনা আর বিপদসঙ্কুল ভেবে হতাশায় ডুবতে। সব কিছুই তাকে শুধু ক্লান্ত শ্রান্ত নয়, আত্মবিশ্বাসহারা এক দুর্বলচিত্তের প্রাণীতে পরিণত করবে। এমন হীনম্মন্যতা যখন তার চার পাশে এসে জড়ো হবে। তখন সেই জনপদকে অধিগ্রহণ করা অধপতিত ও আশ্রিত করা মুহূর্তের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সেই সুযোগ নেয়ার জন্য আশপাশ থেকে অনেকেই অতন্দ্র হয়ে থাকবে। তবে যেকোনো মূল্যেই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ রচনা করে এ মুহূর্ত থেকে ছয় পদে অগ্রসর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, লাখো শহীদ আসমান থেকে তাকিয়ে আছেন। জাতির কাছে রেখে যাওয়া আমানতকে কি রক্ষা করা হচ্ছে।

nayadiganta