- তৈমূর আলম খন্দকার
- ২৪ জুন ২০২২
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রজেক্ট সফল করার জন্য মোটা অঙ্কের বিনিময়ে পরামর্শক নিয়োগ হয়ে আসছে। উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকেও পরামর্শক আমদানি করা হয়। এ জন্য বাজেটে পরামর্শকদের থাকা-খাওয়া ও বেতন বাবদ একটি সুনির্দিষ্ট অঙ্ক বরাদ্দ রাখার বিধান রয়েছে। প্রজেক্টের প্রাক্কলন তৈরির সময়ই পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে এবং যখন প্রজেক্ট কার্যক্রমের গোড়াপত্তন করা হলো তখন থেকেই বিষয়ভিত্তিক পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। প্রজেক্ট সফলভাবে সমাপ্ত করতে পরামর্শকের কাজটি হলো গবেষণালব্ধ পরামর্শ দেয়া, যাতে অনুমোদিত প্রাক্কলন মোতাবেক প্রকল্পটি যথাসময়ে ক্রটিবিহীনভাবে সমাপ্ত হয়। উন্নত বিশ্বেও পরামর্শক সেবা রয়েছে, যা ‘কাউন্সেলিং সার্ভিস’ নামে পরিচিত, কোথাও স্বেচ্ছাশ্রমে গঠিত সামাজিক সংগঠন বা কোথাও পেশাভিত্তিক। তবে এ ধরনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হলে বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য বেশি ফলপ্রসূ হবে।
মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। প্রাণীদের মধ্যে মানুষের সমস্যাই প্রকট ও জটিল। মানুষ তাদের নিজ কৃতকর্মে সমস্যার সৃষ্টি করে এবং সমস্যাটি যদি প্রাথমিকভাবে সমাধান করা না হয় তবে জ্যামিতিক হারে একটা থেকে আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এতে খুন খারাবিসহ অনেক বিপর্যয় ঘটতে থাকে, যা তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে না। নিয়ন্ত্রণহীন সমস্যা মানুষের ব্যক্তি জীবন ও পরিবার এমন ওলট-পালট করে দেয় যা কল্পনা করার কল্পনাও থাকে না। তখন থেকেই শুরু হয় হতাশা, ব্যর্থতা এবং অপরাধপ্রবণতার বীজ বপন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ১৬ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভোগে। সামাজিক অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, পরিবারের স্বজনদের আত্মহত্যা, ইভটিজিং, আগ্রাসন, পারিবারিক কলহ, অত্যাচার ও নির্যাতন, পিতা-মাতার মধ্যে বিচ্ছেদ, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, পারিবারিক সমন্বয়ের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র, প্রভৃতি কারণ থেকে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অযত্ন অবহেলার কারণে মানসিক রোগীর রোগসংক্রান্ত জটিলতা অনেক বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমতাবস্থায় তার প্রয়োজন উপযুক্ত গাইডেন্স, উৎসাহ, প্রেরণাসহ সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধাবিত করা। এ জন্য দরকার সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলে নিজেকে তার আস্থায় নিয়ে আসা। এসব কাজ যেখানে পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয়দের করার কথা সেখানে পরিবারের লোকজন এবং নিকটাত্মীয়রাই ফ্যামিলি পলিটিক্সের কারণে অনেক সময় বিপরীতধর্মী ভূমিকা পালন করে।
‘সমাজ’ নিজেও মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য একটি ‘সামাজিক প্রকল্প’। সমাজে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি ভাঙা-গড়া আছে; রয়েছে অবক্ষয়, অসম্মান, অবহেলা, বঞ্চনা, এমনকি ন্যায্য পাওনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে হাহাকারসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই অশান্তি বিরাজমান। বিরাজমান অবস্থা থেকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় সমাজে আনার জন্য ‘পরামর্শক’ পেশাগত গোষ্ঠী বা ‘পরামর্শ প্রদানমূলক পেশাগত একটি সার্ভিস সেন্টার’ চালু হওয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি, যা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হলে আরো ভালো হয়।
পরামর্শ হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব হবে সমস্যাভুক্ত ব্যক্তির জীবন ইতিহাস সংগ্রহ করে তার মানসিক অবস্থা পরিমাপ, যথাযথভাবে নির্ধারণ করে সমস্যাভুক্ত ব্যক্তিকে সাপোর্ট দেয়া, গাইড করা ও সমস্যা উত্তরণের জন্য দিক নির্দেশনামূলক বিজ্ঞানভিত্তিক পরামর্শ দেয়া। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ Care Rogers বলেছেন, “Counselling is a series of direct contacts with the individual which aims to offer him assistance in changing his attitude and behaviors.”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এ ধরনের পরামর্শকে পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময় বলে মন্তব্য করে সমস্যা জর্জরিত ব্যক্তির জন্য নিম্নবর্ণিত দায়িত্ব পালনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।
ক. সুবিধা প্রদান; খ. সমস্যার সমাধান; গ. প্রেরণা প্রদান ও ঘ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বিশেষজ্ঞদের মতে নি¤œবর্ণিত পদ্ধতি পরামর্শককে গ্রহণ করতে হবে-
ক. পরামর্শ হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক; খ. সমস্যা সমাধানের জন্য পরামর্শ হতে হবে পেশাভিত্তিক; গ. পরামর্শকের কাজ হবে সমস্যাভুক্ত ব্যক্তিকে সমর্থন, পরামর্শ ও পথচলার দিকনির্দেশনা প্রদান; ঘ. পরামর্শককে অবশ্যই বর্ণিত বিষয়ে প্রশিক্ষিত হতে হবে; ঙ. এটি হতে হবে সমস্যা সমাধানের একটি কৌশল; চ. এ পদ্ধতিতে একটি সমস্যায় জড়িত ব্যক্তি সহজেই সমস্যামুক্ত হতে পারে।
পরামর্শ প্রদানের নীতিমালা
১. পরামর্শ হতে হবে গ্রহণযোগ্য; ২. সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ সম্পন্ন; ৩. অংশগ্রহণমূলক; ৪. দৃঢ়তাসম্পন্ন; ৫. আত্মবিশ্বাসমূলক ও ৬. স্ব-সচেতনতামূলক।
একজন ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিক, সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত গবেষণালব্ধ পরামর্শ একটি পন্থা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। অভাব অনটন থেকে উদ্ভূত পারিবারিক সমস্যা, মাদকাসক্তি, বেকারত্ব, পারিবারিক বিচ্ছেদ প্রভৃতি সব ক্ষেত্রে সমাধানের জন্য একটি সঠিক পরামর্শ তার উত্তরণের যাত্রাপথের পাথেয় হতে পারে। কারণ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি সমস্যা সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে এমন অনেক ভুল করে থাকে যা নতুন করে আরো জটিলতার সৃষ্টি করে। মানুষ যখন সমস্যায় পড়ে তখন অনেক সময় সে তার করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মনস্তাত্ত্বিক কারণে নিজেই খেই হারিয়ে একটার পর একটা ভুল করতে থাকে, ফলে সৃষ্টি হয় জটিলতা। আত্মবিশ্বাস যতই থাকুক না কেন, বর্তমান বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় গবেষণালব্ধ পরামর্শের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো বলেছেন, ‘জ্ঞান এমনই একটি বিষয় যে, গবেষণাবিহীন সাধারণ চিন্তা বা মতামত কোনো জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য নির্ভরযোগ্য নয়।’ বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রশ্নে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। গবেষণাভিত্তিক চিকিৎসা বর্তমান বিশ্বে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বিধায়ই দিনে দিনে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসছে। ফলে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন কি পারিবারিক ক্ষেত্রের গবেষণালব্ধ সুচিন্তিত মতামত এখন সময়ের দাবি।
সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে পরামর্শ দেয়ার আগে পরামর্শককে অবশ্যই নি¤œবর্ণিত বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে-
১. সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির পূর্ব ইতিহাস; ২. সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্যাপাসিটি; ৩. জীবন নির্বাহের উৎস; ৪. সমস্যা সমাধানে তার সক্ষমতা কতটুকু। এ ছাড়াও সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক, জীবনযাত্রার উৎস পর্যালোচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরামর্শ সেবা বা কাউন্সেলিং সার্ভিস কতটুকু সফল হতে পারে তা-ও পর্যালোচনার বিষয়। কাউন্সেলিং বা সুচিন্তিত পরামর্শ একটি স্বাভাবিক, সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে পারিপার্শ্বিক ও পরিবেশগত কারণে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনযাত্রায় সমস্যা অনেক প্রকট। একজন আরেকজনকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে আনন্দ ভোগ করার মানুষের অভাব নেই। অন্যদিকে সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা এতই প্রকট যা কঠিন আইন পাস করেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজা হচ্ছে কিন্তু হত্যা কমছে না। নারীদের সুরক্ষার জন্য অনেক আইন করেও তাদের সুরক্ষা দেয়া যাচ্ছে না। পুরুষরাও নারীদের হাতে ব্যাপকভাবে নির্যাতিত। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ পুরুষ পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর হাতে ব্যাপকভাবে নির্যাতিত। পুরুষদের সুরক্ষার জন্য এখনো কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি, তবে এ মর্মে দাবি জোরালো হওয়ার সময় এসেছে। পুরুষরা যেমন নারীদের ট্র্যাপ করে, অন্যদিকে নারীদের মধ্যেও অনেক রয়েছে যারা পুরুষদের ট্র্যাপ করে সর্বস্বান্ত করে দেয়। মাদকের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকাটা প্রসার লাভ করেছে। এমতাবস্থায়, সমাজ ও পরিবার যে জটিল সমস্যায় রয়েছে তা নিরসন করা বা নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়া কেবল আইন দিয়ে সম্ভবপর নয়। বাংলাদেশে আইনের শাসন থাকলেও সুশাসন নেই। কারণ আইন প্রয়োগকারীরা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে মোটিভেটেভ। এ অভিযোগ এমনকি, বিচার বিভাগের সম্পর্কেও বিচারপ্রার্থীরা করে আসছে। অন্যদিকে, মিথ্যা কথা বলা যেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিণত হয়েছে। সত্য কথা বলা যেন সমাজ থেকে উঠে গেছে; তবে এর ব্যতিক্রম চোখে পড়ার মতো নয়। প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও নাজেহাল করা যেখানে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সেখানে মানুষের স্বভাবে পরিবর্তন আনাও জরুরি এবং এ জন্য পরামর্শ সেবা বা কাউন্সেলিং সার্ভিস সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]