সমঝোতায় মিলিয়ে যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা

সমঝোতায় মিলিয়ে যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা.

বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো আসন সমঝোতার দিকে যাওয়ায় ৭ জানুয়ারি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের সম্ভাবনা মিলিয়ে যাচ্ছে। জয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের মিত্র ও শরিক দলগুলো নৌকার সঙ্গে লড়াই নয়, ফাঁকা মাঠ চায়। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও (জাপা) সরকারি দলের মুখোমুখি হতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও সরানোর শর্ত দিচ্ছে। আবার নৌকার প্রার্থীরাও আগাম জয় নিশ্চিত করতে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটে চান না।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ১৫৪ এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ঘোষণা, ছিল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। গত ৫ সেপ্টেম্বর বিবৃতিতে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। গত ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মতবিনিময় সভায় একই আভাস দেওয়া হয়।

এ কারণে নৌকা না পেয়ে বহু আসনে আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দলগুলো সাবেক বিএনপির এমপিসহ শতিনেক প্রার্থী দিয়েছে। সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছোট দলগুলোও সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ২২১ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এই দলগুলোও ভোটে লড়ে জেতার পরিবর্তে, আসনের জন্য আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছে ছাড় পাওয়ার আশায়। কিংস পার্টিও আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মুখাপেক্ষী। তবে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বাদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বাকিদের ভোটের মাঠে অবস্থান নেই।

তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল জাপা, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপি, তরীকতের মতো সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা দলগুলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী দেওয়ায়। কিন্তু জয় নিশ্চিত করতে দলগুলো আসন সমঝোতা চাওয়ায় এবং তাতে আওয়ামী লীগ সম্মতি দেওয়ায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষীণ সম্ভাবনাও উবে গেছে।
সমঝোতা হলে, ছেড়ে দেওয়া আসনে থাকবে না নৌকার প্রার্থী। নামসর্বস্ব দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোটে লড়বেন ক্ষমতাসীন দলের শরিক ও মিত্রদের প্রার্থীরা। বাকি আসনগুলোতে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোটের মাঠে থাকবেন দুর্বল প্রার্থীরা।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন সমকালকে বলেন, নির্বাচন মানে হচ্ছে ভোটাররা অনেক প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বেছে নেবেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলো যদি সমঝোতা করে ভোট করে, তাকে নির্বাচন নয়, তামাশা বলা যায়। জাতীয় পার্টি এতদিন বড় বড় কথা বলেছে, সরকার গঠনের কথা বলেছে। এখন বলছে, আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া জিততে পারবে না। এখন যা পরিস্থিতি, তা নির্বাচন নয়, ভাগবাটোয়ারা চলছে। ১৯৯১ সালের আগের যে নির্বাচনগুলোর সমালোচনা করা হয়, সেগুলোও এভাবেই হতো। ভাগবাটোয়ারার নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা জানি না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিনসিদ্দিকের মতামত ভিন্ন। তিনি সমকালকে বলেন, আসন সমঝোতা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায়।

জাপা আসন চাইলেও প্রকাশ্যে বলছে না

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা প্রকাশ্যেই আসন সমঝোতা দাবি তুললেও জাপা গোপন রাখছে। গত তিনবারের মতো আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় চায় দলটি। আবারও প্রধান বিরোধী দল হতে আগ্রহী জাপা চায়, তাদের পছন্দের আসনে নৌকার প্রার্থী থাকতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থাকতে পারবেন না, যাতে বিনা বাধায় জিততে পারে লাঙ্গল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন নির্বাচনে জাপার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৮৮ আসনের মধ্যে ৪২টিতে নৌকার প্রার্থী ছিল না। এর চারটি আসনে পরাজিত হয় ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপির বিরুদ্ধে। বাকি পাঁচটিতে হারে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। গত নির্বাচনে জাপার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ১৭২ আসনের ২৭টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল। ১৪৫ আসনে নৌকার বিরুদ্ধে জামানত হারায় লাঙ্গল।

এ অভিজ্ঞতার কারণে বছর দুয়েক ধরে সরকারের কড়া সমালোচনা করা জাপা ভোট মৌসুমে এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা চাইছে। গত বুধবার আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষা করে বৈঠক করেন দলটির নেতারা। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগকে ৬০-এর বেশি আসনের তালিকা দিয়েছে জাপা। দলটির আরেকটি সূত্রের দাবি, ৭৫টি আসনের তালিকা দেওয়া হয়েছে।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ থাকায় আওয়ামী লীগ চায় বিএনপিবিহীন ভোটযুদ্ধ যেন একতরফা না হয়। তাই দলটি চেয়েছিল নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হোক। জাপা সূত্র জানায়, কিছু আসনে ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ করে লাঙ্গলকে জেতানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের এই কৌশলে রাজি নয় জাপা। দলটি কোনো ঝুঁকি নিতেই রাজি নয়। বৃহত্তর রংপুরের ১০-১২ আসনসহ কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৩৮ আসনে ছাড় পাওয়ার প্রত্যাশা করছে দলটি।

তবে জাপা মহাসচিব আগের দিনগুলোর মতো গতকাল শুক্রবারও আসন সমঝোতার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘আসন সমঝোতা হবে না। জাতীয় পার্টি সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন করবে।’

জাপার একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, এগুলো কথার কথা। খেলাপি ঋণের জিম্মাদার হওয়ার অভিযোগে মুজিবুল হক চুন্নুর প্রার্থিতা বাতিলে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বেশি দরকষাকষি করলে রওশন এরশাদের মতো তিনিও নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়তে পারেন। আওয়ামী লীগ যত আসন ছাড়বে, তা মেনে নিয়ে জাপাকে নির্বাচনে যেতে হবে। অন্যথায় ভোট বর্জনের মতো চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া পথ থাকবে না। জাপার নির্বাচন বর্জন করার সামর্থ্য নেই।

বিজয় নিশ্চিত করতে চাইছে ১৪ দল শরিকরা

জাপার মতো রাখঢাক করছে না ১৪ দলের শরিকরা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা চাইছে। এ জন্য ছাড় পাওয়া আসনগুলো থেকে নৌকার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও সরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেছে। শরিকরা নিজ প্রতীক বাদ দিয়ে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করতে চায়। যদিও নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ‘বাধা না দেওয়ার’ নীতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমন মনোভাব সুস্পষ্টভাবে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে শরিক দলগুলোকে। এতে জয়ের বিষয়ে শঙ্কায় পড়েছে ১৪ দলের শরিকরা।

শরিক নেতারা আরও বলছেন, এমনিতেই আসন কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শরিক চার দলের বর্তমানে আটজন এমপি থাকলেও এবার মাত্র পাঁচটি আসন ছাড়তে রাজি হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এসব আসনের কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের বিপরীতে নৌকা নিয়েও জেতা সহজ হবে না।
এর আগের তিনটি নির্বাচনেই শরিকদের সঙ্গে আসন ফয়সালা করে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। গড়পড়তায় ১২-১৪টি আসন ফাঁকা রেখেছিল। ফলে ছাড় দেওয়া আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে সহজেই জয়ী হয়েছেন শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা। এবারই প্রথম মাত্র দুটি আসন ফাঁকা রেখে ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরই শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

বিএনপিবিহীন নির্বাচনে কেন শরিকরা নিজের প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটে যেতে ভয় পায়– এ প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন দলগুলোর নেতারা। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, কোনো আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলেই তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। কেউ বড় ব্যবধানেও জিততে পারে, আবার উনিশ-বিশও হতে পারে।
১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু গতকাল শুক্রবার সমকালকে বলেছেন, শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি রোববারের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। এর পর আর কারও কোনো সমস্যা থাকবে না।

একই দিন নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে যা হওয়ার ১৭ ডিসেম্বরের আগেই হবে।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ছেড়ে দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে তা শরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আওয়ামী লীগ বলছে,  তাদের দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকবেন। কিন্তু সেখানে তো একই দলের প্রার্থীরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছেন। যিনিই জিতবেন, তিনিই আওয়ামী লীগের। শরিক দলের বেলায় তো তা হচ্ছে না।

সমকাল