দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো ও ভেঙে পড়া সুশাসন ফেরাতে ১৭ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেয়ার মতো পরিকল্পনাও রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গতকালের সভায় ‘রোডম্যাপ’ নামের প্রস্তাবটি পাস হয়। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের সেগুলো তুলে ধরেন। কর্মপরিকল্পনার ১১টি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত এবং বাকি ছয়টি মূলত ব্যাংকে সুশাসন ফেরানোর রূপরেখা।
আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, ‘খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেটি অনুমোদন হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একে একে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত রোডম্যাপের প্রধান লক্ষ্য হলো ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ১০ ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে সীমার বাইরে দেয়া ঋণ, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ এবং জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে দেয়া ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য বাস্তবায়নে ঘোষিত কর্মপরিকল্পনার মধ্যে খেলাপি ঋণ অবলোপন, অবলোপনকৃত ঋণ আদায় জোরদার, বেসরকারি খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন, ঋণখেলাপিদের আর ছাড় না দেয়ার পরিকল্পনা, খেলাপির মেয়াদ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চর্চাসহ বেশকিছু পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। আর করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা নির্ধারণ, যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ প্রক্রিয়া কঠোর করা, সীমার বেশি ঋণ না দেয়া, দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা রূপরেখায় স্থান পেয়েছে।
দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেয়া হয়। ওই ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়টি উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারীকৃত পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ২০২৫ সালের মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এজন্য সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে পিসিএ বাস্তবায়ন কমিটি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ, তারল্য, মূলধন ও সুশাসন—এ চার মানদণ্ডের ভিত্তিতে আগামী বছর র্যাংকিং হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের আর্থিক প্রতিবেদন মূল্যায়ন করা হবে। কোনো ব্যাংক পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কে উল্লেখিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে ব্যর্থ হলে সেগুলো অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেয়া হতে পারে। ব্যাংকগুলো চাইলে নিজেরাও একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিতে পারবে। একীভূত হওয়ার পরবর্তী তিন বছর কোনো কর্মচারী চাকরিচ্যুত হবে না। এ বিষয়ে ঘোষিত রোডম্যাপে বলা হয়েছে, একাধিক ব্যাংক একীভূত হলে পরিচালনা পর্ষদ শক্তিশালী হবে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দূর হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যয় কমে আসবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বলেন, ‘আমরা একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে চাই।’ তখন একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানতে চান, ‘একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি কি পর্ষদের সঙ্গে পর্ষদ হবে, নাকি ব্যালান্সশিটের সঙ্গে ব্যালান্সশিট?’ জবাবে গভর্নর বলেন, ‘ব্যালান্সশিটের সঙ্গে ব্যালান্সশিট একীভূত হবে। কোনো দুটি ব্যাংক নিজে থেকে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিলে সেটিও বিবেচনায় নেয়া হতে পারে।’ এ সময় গভর্নর ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনার মনোভাব প্রকাশ করেন।
ব্যাংক উদ্যোক্তাদের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের তথ্যমতে, দেশের কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে দেশে শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ সংখ্যা ৫-৬টিতে নেমে আসতে পারে। দেশের প্রথম প্রজন্মের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা চলছে। আবার চতুর্থ প্রজন্মের একাধিক ব্যাংকও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। সেটি হলে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের সংখ্যাও কমে আসবে।
করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকের শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন করা হবে বলে কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, যোগ্য পরিচালক নির্বাচিত হলে ব্যাংকের করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত হবে, যা ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করবে।
রোডম্যাপে বলা হয়, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, তাদের সম্মানী নির্ধারণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিযুক্ত হলে আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ ও পুনঃনিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আগামীতে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। এমডিদের কর্ম মূল্যায়নে পারফরম্যান্স নির্দেশক যুক্ত হবে। এটি হলে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পাবেন।
গত কয়েক বছর ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে সুশাসন ফেরাতে এখন থেকে সেই সীমা কোনোক্রমেই অতিক্রম না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়ার কথা বলা হয় কর্মপরিকল্পনায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, একক গ্রাহক ঋণসীমা মেনে চললে করপোরেট সুশাসনের মান উন্নত হবে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমে আসবে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে মৌলিক প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকিং প্রফেশনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাধ্যতামূলক করার বিষয়টিও রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে ব্যাংকের বিতরণকৃত কোনো ঋণ তিন বছরের বেশি মন্দ মানের খেলাপি থাকলে সেটির বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে অবলোপন করা যায়। খেলাপি ঋণ কমাতে এ নীতিতে পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত রোডম্যাপে বলা হয়েছে, কোনো ঋণ দুই বছরের বেশি মন্দ মানের খেলাপি থাকলে সেটি অবলোপন করা যাবে। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ হ্রাস পাবে। তবে শতভাগ সঞ্চিতি রাখায় এক্ষেত্রে ব্যাংকের কোনো ঝুঁকি থাকবে না।
অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে ব্যাংকের এমডির সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামের একটি পৃথক ইউনিট গঠন করা হবে। এ প্রসঙ্গে আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, ‘ব্যাংকের কোনো ঋণ অবলোপন করা মানে এটি নয় যে ঋণটি মাফ করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের ঋণ অবশ্যই আদায় করতে হবে। ব্যাংকের অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের বিষয়টি এমডির পারফরম্যান্সের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।’
ঘোষিত রোডম্যাপে খেলাপি ঋণ অধিগ্রহণের জন্য বেসরকারি খাতে ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠার কথা এসেছে। এতে বলা হয়, এ ধরনের কোম্পানি গঠনের জন্য একটি খসড়া আইন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটি পাস হলে মন্দ বা অবলোপনকৃত ঋণ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে বিক্রি করা যাবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যালান্সশিট পরিষ্কার হবে। আর প্রাপ্ত অর্থও ব্যাংকের আয় খাতে যুক্ত হবে।
বিদ্যমান নীতি অনুযায়ী, কোনো ঋণ খেলাপি হলে তার বিপরীতে কোনো সুদ আয়ের খাতে স্থানান্তর করা যায় না। নতুন কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এখন থেকে ‘স্ট্রেসড অ্যাসেট’ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের বিপরীতেও আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ব্যতিরেকে আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। স্ট্রেসড অ্যাসেট আদায় বা নিয়মিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যালান্সশিটে আলাদাভাবে প্রদর্শন করতে হবে। তখন কেবল প্রকৃত আদায়ের ভিত্তিতে সুদ বা মুনাফা আয় খাতে স্থানান্তর হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ঋণকে স্ট্রেসড অ্যাসেটে পরিণত হতে দেবে না। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণকে ‘স্ট্রেসড অ্যাসেট’ হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা।
ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে এর আগে যেসব ছাড় দেয়া হয়েছিল, সেটি আর দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত রোডম্যাপে এ বিষয়ে বলা হয়, নীতি ছাড় দেয়া না হলে ব্যাংক খাতে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি পুনঃস্থাপিত হবে। ব্যাংকের তারল্য সংকট কমে আসবে। ব্যাংকগুলোর ক্যাশ ফ্লো বা নগদ প্রবাহ বাড়বে। পুরনো ঋণ আদায়ের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে নতুন ঋণের প্রবাহ বাড়বে।
২০২০ সালের মার্চে মেয়াদি ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের পাশাপাশি খেলাপি গণনার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সংজ্ঞা ও এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন সংশোধন বা হালনাগাদ করা হবে।
দেশের অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলায় আটকে থাকা ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন রোডম্যাপে বলেছে, খেলাপি ঋণের আদায় বাড়াতে ব্যাংকগুলোর লিগ্যাল টিমকে শক্তিশালী করা হবে। আবার বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধিত) আইনে সংজ্ঞায়িত ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করার বিষয়টিও রোডম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ বিষয়ে আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, ‘জামানত মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানের তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঘোষণা করা হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান ভুয়া কিংবা অতিমূল্যায়ন দেখালে সেটির দায়দায়িত্বও সে প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে।’
Bonik Barta