নজিদ অর্ণব | ১৯:১৯:০০ মিনিট, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৬
গল্পটা এক বিবেকহীন দুর্বৃত্তের, সতেরো শতকের শুরুর দিকে তিনি বাংলায় বাস করতেন। একসময় ছিলেন লবণ ব্যবসায়ী, পরবর্তীতে স্বঘোষিত হার্মাদ রাজা, তিনি সেবাস্তিয়াও গনজালেস তিবাউ। তিবাউয়ের গল্প শুধু তার একার নয়, বরং একদল অদ্ভুত অভিবাসীর, যারা কালের পরিক্রমায় দেশী হয়ে যেতে চেয়েছিল। যদিও তারা ফিরিঙ্গি নামেই পরিচিত। এ অভিযোজন ছিল বাংলার বৃষ্টি আর মৌসুমি জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া।
এখনকার চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ে একটি জায়গার নাম পাথরঘাটা। পাথরঘাটা গরিব এলাকা হতে পারে কিন্তু পাশের এলাকাটা সাজানো-গোছানো, অন্তত ফিরিঙ্গি বাজারের আগ পর্যন্ত। এ বাজারের কাছে আসতেই নাকে আসবে চিংড়ির ঘ্রাণ। নাম থেকেই বোঝা যায় যে, ফিরিঙ্গি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিদেশী অভিবাসীদের জন্য। এই বিদেশীদের বংশধররা ভাষা, সংস্কৃতি আর চেহারা-সুরতে বাঙালি হয়ে গেছে। কিন্তু এই শারীরিক ও সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের পরেও তারা বিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত বিদেশী বা ফিরিঙ্গি নামে অভিহিত হতো। ১৯৪৭ সালের পর চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি সমাজের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। এর পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই হ্রাস প্রক্রিয়া আরো বৃদ্ধি পায়। তাদের অনেকেই অস্ট্রেলিয়া কিংবা কানাডায় চলে গেছেন। আর অনেকে স্থানীয় বাঙালি মুসলিম নারীদের বিয়ে করেছেন, ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন নাম নিয়েছেন।
বাংলায় ফিরিঙ্গিদের ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরনো। বাংলার জলবায়ু ও জলপ্রবাহের সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ার প্রাথমিক সময়কালের এক চরিত্রের নাম সেবাস্তিয়াও গনজালেস তিবাউ। তিনি অবশ্য এ অঞ্চলের প্রথম ফিরিঙ্গি নন। তার জীবনকে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক পর্তুগিজদের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। তার চেয়ে বরং এটা ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে ফিরিঙ্গি দস্যুদের স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার এক গল্প। তিবাউয়ের সংক্ষিপ্ত কিন্তু ঘটনাবহুল জীবন বাংলার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের রূপান্তরে ভূমিকা রেখেছিল, সেটা ছিল বাঙালি, বর্মি, মোগল ও পর্তুগিজদের এক মিথস্ক্রিয়া।
তিবাউয়ের জন্ম লিসবনের কাছে ছোট এক গাঁয়ে, ১৫৮০-এর দশকে। সতেরো শতকের পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ মানুয়েল দে ফারিয়া এ সোসা গ্রামের নামটি উল্লেখ করেছেন— সান্টো অ্যান্টোনিও দেল টোরজাল। এছাড়া সেই গ্রামের কোনো উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। এমনও হতে পারে যে, এটা ছিল সান্টো অ্যান্টোনিও দা চারনেকা নামের গ্রাম। এটা ছিল জেলেদের গ্রাম। পর্তুগালে তিবাউয়ের জীবন সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না। যেহেতু তিনি সান্টো অ্যান্টোনিও দা চারনেকায় বেড়ে উঠেছেন, তাই হয়তো তার পরিবারটি ছিল জলদাস। তাই খুব ছোট বয়স থেকেই তিনি নৌকা চালনা শিখে থাকবেন। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে একটি পর্তুগিজ যুদ্ধজাহাজে উঠে পড়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। আমরা নিশ্চিত নই তিবাউ স্বেচ্ছায় এই যাত্রা করেছিলেন, নাকি বাধ্য হয়ে। পর্তুগিজ নৌবাহিনীর সাধারণ নাবিকরা ছিলেন সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষ। হয়তো তিবাউ তেমনি একজন ছিলেন এবং ভাগ্য বদলাতে ভারতে যাত্রা করেন।
প্রায় নিশ্চিতভাবেই তিবাউ ভারতে প্রথম পা রেখেছিলেন গোয়া বন্দরে। তবে তিনি গোয়া কিংবা ভারতের পশ্চিম তীরে অন্য কোনো সমৃদ্ধ পর্তুগিজ কলোনিতে আশ্রয় নেননি। বরং তিনি যাত্রা করলেন বঙ্গোপসাগরের উত্তর তীরের দিকে। ভারতের পশ্চিম উপকূলে সমৃদ্ধ গোয়া, দিউ বা কোচিন শহরের পরিবর্তে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাস করতে চাওয়াটা ভিন্ন মানসিকতার এক মানুষের পরিচয় দেয়।
লবণ বাণিজ্যের অভিযাত্রায় তিবাউ এরই মধ্যে সন্দ্বীপের সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। বঙ্গোপসাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও লবণ ব্যবসার জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি সন্দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট ছিল। ষোড়শ শতকের শেষভাগ ও সপ্তদশ শতকের শুরুতে সন্দ্বীপের দখল নেয়ার প্রাতিযোগিতার কাহিনী পড়লে মনে হবে যেন গেম অব থ্রনের বিভিন্ন পর্ব। তত্কালীন ভারতবর্ষে সন্দ্বীপের মতো আরেকটি স্থান খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে, যেখানকার শাসনক্ষমতা বিভিন্ন জাতির শাসকদের মধ্যে এত ঘন ঘন বদল হয়েছে।
১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভেনেসিয়ান পর্যটক সেসারে ফেদেরিকি ৪০ দিন সন্দ্বীপে অবস্থান করেন। সে সময় সেখানকার শাসক ছিলেন একজন মুসলিম গভর্নর, যিনি খুব সম্ভবত ত্রিপুরার শাসকদের অধীন ছিলেন। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে রালফ ফিঞ্চ বার্মার পেগু (বর্তমানে মিয়ানমারের বাগো শহর) যাওয়ার পথে সন্দ্বীপ হয়ে যান। তত দিনে সন্দ্বীপ মোগলদের অধীনে চলে গেছে, ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মোগলরা বাংলা দখল করে। মোগলরা সন্দ্বীপে একটি দুর্গ নির্মাণ করে। কিন্তু বাংলার ক্ষুদ্র একটি এলাকা শ্রীপুরের কেদার রায় ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে সন্দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এমন সময় পর্তুগিজরা আরাকানদের হাত থেকে চট্টগ্রামের দুর্গের দখল ছিনিয়ে নেয়। এবং সন্দ্বীপের দখল দাবি করে। কিন্তু কেদার রায় এক দলছুট পর্তুগিজ যোদ্ধা ডোমিঙ্গো কারভালহোর সহায়তায় সন্দ্বীপের দখল বজায় রাখেন। ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে কারভালহো মোগলদের সঙ্গে লড়াই করে সন্দ্বীপের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেন। তবে তার শাসন দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। স্থানীয়রা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, কারভালহো পর্তুগিজ নাবিকদের কাছে সাহায্য চাইতে বাধ্য হন। দিয়াঙ্গার পর্তুগিজ এনক্লেভ থেকে ৪০০ জন যোদ্ধাকে নিয়ে কারভালহোর সহায়তায় এগিয়ে আসেন ম্যানোয়েল দে মাত্তোস। এর পর তারা দুজন সন্দ্বীপকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। কারভালহো একসময় কেদার রায়ের অধীনে কাজ করতেন। এবার কেদার রায় সন্দ্বীপ থেকে তার এই সাবেক কর্মচারীকে বিতাড়িত করতে আরাকানের রাজা মিন রাজাগির সহায়তা চান। কিন্তু কেদার রায় ও আরাকান বাহিনী কারভালহোর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কারভালহোকে সন্দ্বীপ থেকে হটাতে ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরা আরেকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। পরিস্থিতি প্রতিকূল, এটা বুঝতে পেরে কারভালহো গোয়ার ভাইসরয়কে অনুরোধ করেন যেন সন্দ্বীপকে এস্তাদো দা ইন্ডিয়ার অধীন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পর্তুগালের রাজা কারভালহো ও মাত্তোসকে ফিদালগজ দে কাসা রিয়াল বা অভিজাত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু রাজার এই ঘোষণা সন্দ্বীপে এসে পৌঁছানোর আগেই যশোরের হিন্দু রাজা প্রতাপাদিত্য কারভালহোর ঘাঁটিতে হামলা করেন এবং তাকে হত্যা করেন। মাত্তোস দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে সন্দ্বীপ ত্যাগ করেন এবং দ্বীপের দায়িত্ব লেফটেন্যান্ট পেত্রো গোমেজের হাতে ছেড়ে দেন। এর পর আফগান কর্মকর্তা ফাতেহ খানের হাতে শাসনভার ছেড়ে গোমেজও পালিয়ে যান। ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে দিয়াঙ্গায় আরাকানদের আক্রমণে মাত্তোস নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে ফাতেহ খান নিজেকে ‘সন্দ্বীপের রাজা, খ্রিস্টানদের রক্ত ঝরানো এবং পর্তুগিজ রাষ্ট্রের বিনাশকারী’ হিসেবে ঘোষণা করেন। দুই বছরের মাথায় ফাতেহ খান তিবাউয়ের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন। তিবাউ এর পর আট বছর সন্দ্বীপ শাসন করেছেন, তার পূর্বসূরিদের তুলনায় তিবাউ অনেকটা বেশি সময় সন্দ্বীপ শাসন করতে পেরেছেন।
সন্দ্বীপ বাংলার যেকোনো বদ্বীপের প্রতিরূপ। মাঝে মাঝে সাগরের জলে ডুবে এবং রোদে শুকিয়ে প্রতি বছর সন্দ্বীপে বিপুল লবণাক্ত পলি জমে। শুষ্ক মৌসুমে খুব সহজেই এই লবণযুক্ত পলি দ্বীপের তীর থেকে সংগ্রহ করা যায়। তিবাউয়ের সময়কালে সন্দ্বীপ থেকে বছরে তিনশ জাহাজ লবণ বোঝাই হয়ে যেত। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে সন্দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার আগেও তিবাউ সেখানে পা রেখেছিলেন।
লবণ বঙ্গোপসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। সন্দ্বীপের দখল নিয়ে যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখা গেছে, তার একটি অন্যতম কারণ এই লবণ। লবণ এ অঞ্চলে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ— সবার কাছেই মাঙ্গলিক। বিয়ে থেকে বিভিন্ন আচারে লবণ অপরিহার্য। ভারতীয় উপমহাদেশে লবণের অনেক প্রতীকী মূল্যও আছে। উপনিষদে উদ্যালাকা অরুণি তার পুত্র শভেতাকেতুকে কিছু লবণ নিয়ে পানিতে মেশানোর নির্দেশ দেন। পরের দিন তিনি পুত্রকে সেই পানি নিয়ে আসতে বলেন। ততক্ষণে লবণ পানিতে মিশে গেছে এবং লবণের কোনো চিহ্ন পানিতে দেখা যাচ্ছে না। তখন তিনি পুত্রকে সেই পানি পান করতে দিলেন এবং পানির স্বাদ অবশ্যই লবণাক্ত হয়ে গিয়েছিল। এটা ছিল দেহে আত্মার উপস্থিতি সম্পর্কিত একটি রূপক। অর্থাত্ আত্মা দেখা না গেলেও এর অস্তিত্ব আছে। সামাজিক বন্ধনের উপাদান হিসেবে লবণের তাত্পর্য আছে। অ্যারিস্টটল বলেছেন, অন্যকে জানা সম্ভব নয় যতক্ষণ না তার সঙ্গে লবণ খাওয়া হচ্ছে। এর কাছাকাছি একটি প্রবাদ মোগল যুগের হিন্দুস্তানেও প্রচলিত ছিল। দারাশুকো তার বিদেশী ভৃত্যদের বলেছিলেন, ধর্ম ও ভাষায় তারা ভিন্নতর হলেও ‘লবণ খাওয়ার’ মাধ্যমে তারা সবাই একে অন্যের সঙ্গে বন্ধনযুক্ত। কিন্তু লবণ কেবল প্রতীক কিংবা আচার-অনুষ্ঠানের দরকারি উপাদান নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গরমে শরীর থেকে ঘামের সঙ্গে লবণ বেরিয়ে যায়, এ অভাব পূরণে দরকার হয় লবণ। মাংস সংরক্ষণেও লবণ দরকার হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সত্যাগ্রহের সময় গান্ধী বলেছিলেন, ‘বাতাস এবং পানির পর জীবনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হচ্ছে লবণ।’ আর সন্দ্বীপে ছিল লবণের প্রাচুর্য।
সন্দ্বীপে কেবল লবণের প্রাচুর্য ছিল না, এটা বাংলার অন্যতম উর্বর ভূখণ্ড। এজন্য অবশ্য নিয়মিত বৃষ্টিপাতকে ধন্যবাদ দিতে হয়। বঙ্গোপসাগরের বৃষ্টির তীব্রতা ইউরোপীয় পথিকদের চমকে দিয়েছিল। ভেনেসিয়ান পর্যটক সেসারে ফেদেরিকি ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গোপসাগরে জাহাজ চালিয়েছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, একটা ‘তুফান বা ভয়ানক ঝড়’ তিনদিন ও তিন রাত্রি ধরে চলেছিল। জাহাজের ৬০ জন মানুষের এ পুরোটা সময় একমাত্র কাজ ছিল সাগরের পানি সেচা।
সন্দ্বীপে তিবাউয়ের প্রধান শত্রু ছিল এই বিধ্বংসী বৃষ্টিপাত। সন্দ্বীপে বাস করার জন্য ফেদেরিকির মতো তিবাউকেও বৃষ্টির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। ‘সন্দ্বীপের রাজা, খ্রিস্টানদের রক্ত ঝরানো এবং পর্তুগিজ রাষ্ট্রের বিনাশকারী’ ফাতেহ খানের মোকাবেলা করার চেয়ে এই ঝড়বৃষ্টি ছিল তিবাউয়ের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ। কাঠ এমনকি ইটের ঘরও এমন আবহাওয়ায় খুব বেশিদিন টেকে না। আর টিকলেও সেগুলো নিয়মিত সংস্কার করতে হয়।
কেমন ছিল তিবাউয়ের জলে ভেজা স্বর্গ?
যে বছর শেক্সপিয়ার দ্য টেম্পেস্ট লিখছিলেন, সে বছর তিবাউ সন্দ্বীপে বাস করছেন। টেম্পেস্টে ঝড়ে জাহাজডুবির পর অনেক ইউরোপীয় অজানা এক দ্বীপে আশ্রয় নেন। দুজন ইউরোপীয়র মধ্যে সেই দ্বীপের গুণাগুণ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। তারা ইতালীয় হলেও তাদের নাম ছিল পর্তুগিজ ঘরানার— সেবাস্তিয়ান এবং গনজালো। সেবাস্তিয়ান ছিল বেপরোয়া বদমাশ, যে বিশ্বাসঘাতকতা করে, এমনকি নিজের ভাইকেও হত্যা করতে প্রস্তুত। সেবাস্তিয়ানের দৃষ্টিতে এই দ্বীপ বিরান, এখানে বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন নেই। অন্যদিকে গনজালো ছিল একজন ইউটোপীয় স্বপ্নবান, সে স্বপ্ন দেখত একদিন এই দ্বীপ উর্বর হয়ে নতুন এক দুনিয়ার জন্ম দেবে। গনজালো প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার এক সামাজিক প্রকল্পের প্রস্তাব করে, যার মাধ্যমে সভ্যতার স্বর্ণযুগ ফিরে আসবে বলে বিশ্বাস করত সে। দ্বীপের প্রতি দুজনের এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অ-ইউরোপীয়দের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও ভিন্নতা এনে দেয়। এক ইউরোপীয় শাহজাদি আফ্রিকার কোনো এক অধিবাসীকে বিয়ে করবে— এটা শুনে সেবাস্তিয়ান রেগে যায়; অন্যদিকে গনজালো দ্বীপের স্থানীয় অধিবাসীদের ব্যাপারে মুগ্ধ ছিল এবং তাদের তার ইউটোপীয় সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করে।
দ্য টেম্পেস্টের লোকেশন কল্পনার সময় শেক্সপিয়ার নিশ্চয়ই সন্দ্বীপ নিয়ে লেখেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দুটি দ্বীপের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। শেক্সপিয়ারের সেই কাল্পনিক দ্বীপ নিয়ে সেবাস্তিয়ান ও গনজালোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য যেন সন্দ্বীপের নামকরণ নিয়ে চলে আসার ঐতিহাসিক বিবরণীর পার্থক্যকে প্রতিফলিত করে। নিহিলিস্ট সেবাস্তিয়ান দ্বীপটিকে দেখেছে বিরান ভূমি হিসেবে। তার এ মতের সঙ্গে মিলে যায় সন্দ্বীপের ইংরেজি নাম ‘স্যান্ডহিপ’ বা বালির স্তূপ। অন্যদিকে ইউটোপীয় গনজালো দ্বীপটিকে তার কল্পিত স্বর্ণযুগের উর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচনা করেছে। তার এ ধারণার সঙ্গে মিলে যায় ‘সোনা দ্বীপ’ থেকে সন্দ্বীপের নামকরণের ইতিহাস। শেক্সপিয়ারের সেবাস্তিয়ান ও গনজালোর চরিত্র আশ্চর্যভাবে মিশে গেছে সেবাস্তিয়াও গনজালেস তিবাউয়ের মধ্যে। তিবাউ একই সঙ্গে ছিলেন সহিংস যোদ্ধা ও কল্পনাবিলাসী ইউটোপীয়।
তিবাউয়ের সহিংস আগ্রাসী মনোভাবের যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। শেক্সপিয়ারের সেবাস্তিয়ানের মতো তিবাউ তাকে বিশ্বাস করে এমন রাজার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। তিবাউয়ের ডাকাতির মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল বঙ্গোপসাগরের আরাকান বাণিজ্য জাহাজ। আর লুটের মালপত্র তিনি বিক্রি করতেন বাংলার যশোরের হিন্দু রাজার রাজত্বের অধীনে থাকা বিভিন্ন বন্দরে। যশোরের রাজা ছিলেন প্রতাপাদিত্য, তার সঙ্গে তিবাউ একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুসারে তিবাউ তার লুটের পণ্য যশোরের বিভিন্ন বন্দরে বিক্রি করার অনুমতি পান এবং বিনিময়ে তিনি প্রতাপাদিত্যকে তার রাজস্বের অর্ধেকটা প্রদান করতেন। শিগগিরই তিবাউ চুক্তি ভঙ্গ করে প্রতাপাদিত্যকে আক্রমণ করে ভোলা দখল করে নিলেন। ভোলা এই বদ্বীপ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দ্বীপ এবং সন্দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। এ দুই দ্বীপের দখল করায়ত্ত করার মাধ্যমে তিবাউ বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলার উজানে বাণিজ্য করতে আসা জাহাজগুলোর ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেলেন। প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে তিবাউয়ের বিশ্বাসঘাতকতা এ অঞ্চলের রাজনীতির সমীকরণকে বেশ জটিল করে দিয়েছিল। এস্তাদো দা ইন্ডিয়ার সঙ্গে যশোরের একটি চুক্তি ছিল। এ চুক্তি অনুযায়ী যশোরের বন্দরগুলো পর্তুগিজরা ব্যবহার করতে পারত এবং বিনিময়ে যশোরের জাহাজ গোয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারত। একই সঙ্গে পর্তুগিজদের আরাকানের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করার শর্তও ছিল। প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে তিবাউ পর্তুগিজ প্রশাসনের কাছে তার সন্দ্বীপের জন্য সহায়তা চান। কিন্তু তিবাউরের মতো দুর্বৃত্তকে সাহায্য করতে এস্তাদো দা ইন্ডিয়া অস্বীকৃতি জানায়।
সেবাস্তিয়ানের মতো তিবাউও এক স্থানীয় শাহজাদাকে খুন করে, যার প্রতি তারা অনুগত ছিল। আরাকানের রাজা মিন রাজাগির ভাই মগ শাহজাদা আনাপোরামের সঙ্গে তিবাউয়ের বন্ধুত্ব ছিল এমনই এক ঘটনা। আরাকান উপকূলে দস্যুতা করলেও তিবাউ আরাকানের কিছু ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে মৈত্রী বজায় রেখেছিলেন। আনাপোরাম ছিলেন চট্টগ্রামের গভর্নর, ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে তিবাউয়ের সহায়তা চান। তিবাউ তার সন্দ্বীপে আনাপোরাম এবং তার কন্যাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান। এর পর আনাপোরাম তিবাউকে সঙ্গে নিয়ে তার পারিবারিক সম্পদ দখলে নিতে আরাকান উপকূলে অভিযান চালান। সফল অভিযান শেষে সন্দ্বীপে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে হঠাত্ করে আনাপোরাম মারা যান। কথিত আছে, তিবাউ বিষ প্রয়োগে আনাপোরামকে হত্যা করেছিল। ফলে আরাকানের সেই সম্পদ তিবাউয়ের পকেটে ঢুকেছিল।
বিদ্রোহী আনাপোরামকে আশ্রয় দেয়া এবং পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা সত্ত্বেও তার ভাই মিন রাজাগির তিবাউয়ের সঙ্গে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে মৈত্রী গড়ে তোলেন। কারণটা ছিল মোগলদের আরাকান বন্দর শহর দখলের হুমকি। মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সন্দ্বীপের হার্মাদিদের সহায়তা করতে মিন রাজাগির তার নৌবাহিনীকে প্রেরণ করেন। কিন্তু চতুর তিবাউ আবারো চুক্তি ভাঙেন এবং রাজাগিরের জাহাজগুলো দখল করে নেন। এর পর এ জাহাজগুলো নিয়ে তিবাউ আরাকান শহর মারুক উ এবং চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আরাকান উপকূলকে অবরুদ্ধ করে বঙ্গোপসাগরের সব বাণিজ্য জাহাজকে শুধু সন্দ্বীপের সঙ্গে বাণিজ্য করতে বাধ্য করা। স্বাভাবিকভাবেই আরাকান তিবাউয়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে তিবাউকে সন্দ্বীপ থেকে উত্খাত করতে আরাকান ও ওলন্দাজরা মিলিতভাবে অভিযান চালায় কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।
তিবাউয়ের মতো এহেন নীতিহীন, দু’মুখো মানুষও যে গনজালোর মতো ইউটোপীয় হতে পারেন, সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু সত্যি সত্যিই তিবাউ সন্দ্বীপে একটি সামাজিক পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। এ পরীক্ষা হয়তো দ্য টেম্পেস্টে গনজালোর প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার স্বর্ণযুগের স্বপ্ন থেকে অনেক ভিন্নতর। তবে তার পরও তিবাউয়ের উদ্যোগকে এক নতুন দুনিয়া গঠনের স্বপ্ন হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়। তিবাউ তার আট বছরের সন্দ্বীপ শাসনে ভারতবর্ষের পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেননি। এবং এই রাষ্ট্রহীন দ্বীপে তিনি অন্তত দুটি প্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন রকমের একটি সমাজ ব্যবস্থা তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন।
প্রথমত. তিবাউয়ের সন্দ্বীপের সমাজ ছিল একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরীক্ষা। তিনি ছিলেন দস্যুদলের নেতা এবং তিনি প্রায় তিন হাজার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেকে ধারণা করেন, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যখন এই তিন হাজার মানুষ তিবাউয়ের প্রতি অনুগত ছিল, তখন বুঝতে হবে সেখানে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু ছিল। কোনো দালিলিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও (হয়তো কোনো দলিল লেখাই হয়নি) ধারণা করা যায় যে, খুব সম্ভবত লুটের মালপত্র দলের সবার মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হতো। এভাবেই বিপজ্জনক এ জীবনে তাদের মধ্যে একটি সমবেত সমাজের চেতনা গড়ে উঠেছিল।
দ্বিতীয়ত. তিবাউয়ের সন্দ্বীপ ছিল বহুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ সংস্কৃতি ও মৌসুমি আবহাওয়াই পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের বাঙালি ফিরিঙ্গিতে পরিণত করেছিল। দিয়াঙ্গা থেকে যে ৪০০ পর্তুগিজ তিবাউয়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, তাদের বেশির ভাগ ছিল নাবিক, ব্যবসায়ী ও দস্যু। কিন্তু মনে রাখা দরকার তিবাউ যখন সন্দ্বীপে এসেছিলেন, তখন তার সঙ্গে ছিল এক হাজার পর্তুগিজ এবং দুই হাজার বাঙালি ও বর্মি। নিছক রাষ্ট্রহীন দস্যু হয়ে না থেকে সন্তান উত্পাদন করে সমাজ গঠনে দরকার ছিল স্ত্রীর। বেশির ভাগ পর্তুগিজের সন্তান হয়েছিল অ-পর্তুগিজ নারীদের গর্ভে। সন্দ্বীপের স্থানীয় বাঙালি নারী ছাড়াও চট্টগ্রাম, দিয়াঙ্গা ও আরাকানের নারীরা পর্তুগিজদের স্ত্রী হয়েছিলেন। এই নারীরা পর্তুগিজ দস্যুদের জলমগ্ন দ্বীপের পরিবেশে মনিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন। তাদের সন্তানরা স্থানীয় ভাষা— বাংলা, চাঁটগাইয়া বুলি ও আরাকানিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
সন্দ্বীপে এই বহুত্ববাদী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে তিবাউ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি আনাপোরামের কন্যাকে বিয়ে করেন। এটা অবশ্যই প্রেমের বিয়ে নয়, বরং রাজনৈতিক সমঝোতা। এবং এটাও সম্ভব যে, তার ভাইকে হত্যা করার পর তিবাউ তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। আমরা জানি না যে, তিনিই কি তিবাউয়ের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন কিনা আর কত দিন তিনি সন্দ্বীপে বেঁচে ছিলেন। তবে এটা জানা যায় যে, এ দম্পতির একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আমরা বঙ্গোপসাগরে সেবাস্তিয়ান মানরিকের কথা শুনতে পাই, তাকে অনেকে তিবাউয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলে অভিহিত করেন। এখানে একটা কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। সমকালীন পর্যটকরা সেবাস্তিয়ান মানরিককে পর্তুগিজ বলে সম্বোধন না করে করেছেন ‘আরাকানের’ বলে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, নামটি পর্তুগিজ হলেও সেবাস্তিয়ান মানরিকের শারীরিক গঠন ও চেহারা তার মা আনাপোরামের বোনের সঙ্গেই বেশি সাদৃশ্য ছিল। তিবাউয়ের আগেও অনেক পর্তুগিজ স্থানীয় নারীদের বিয়ে করেছিলেন কিন্তু তিবাউ স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যেতেই বিয়ে করেছিলেন।
সন্দ্বীপে তিবাউয়ের শাসনের অবসান ঘটে ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে। আরাকানের রাজা মিন রাজাগিরের উত্তরসূরি মিন খামায়ুঙ সন্দ্বীপ দখল করেন। ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর থেকেই তিবাউয়ের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছিল। ৫০টি জাহাজের একটি বাহিনী থাকার পরও এ মাসে তিবাউ আরাকান ও ওলন্দাজদের মিলিত বাহিনীর কাছে নদীতে যুদ্ধে হেরে যান। তিবাউ সন্দ্বীপে পিছু হটে যান এবং আরাকানদের হাতে পরাজয়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিবাউয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা আমরা জানি না। হয়তো আরাকান রাজপরিবারের কন্যাকে বিয়ে করায় তিবাউকে প্রাণে মারা হয়নি। তবে তার সন্তান মানরিক বেঁচে গিয়েছিলেন এটা নিশ্চিত। অনেকে বলেন, তিবাউকে সন্দ্বীপ ছাড়তে হয়েছিল। ঠিক এ সময় হতে ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে তিবাউ হারিয়ে যান। পরিণতি যা-ই হোক না কেন, এভাবে হঠাত্ই এক ফিরিঙ্গি রাজার রাজত্বের অবসান ঘটল; যিনি অত্যন্ত সাধারণ পরিচয় থেকে উঠে এসে প্রায় এক দশক সময়কাল বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
তার রাজনৈতিক পরিচয়কে সরিয়ে দিলেও দেখা যাবে সাংস্কৃতিকভাবে তিবাউ এ অঞ্চলের ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছেন। তিবাউয়ের সাঙ্গোপাঙ্গরা তাদের পুরনো শত্রু আরাকানদের এলাকায় পুনর্বাসিত হয় এবং আরাকান রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। আরাকান শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় তারা দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যায়। বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে তারা জাহাজে আক্রমণ করত। সন্দ্বীপ হয়ে ওঠে আরাকান দাস ব্যবসার কেন্দ্র, যা গোয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি আফ্রিকা ও আমেরিকার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছিল। আরাকানের শাসকরা পর্তুগিজ দস্যুদের ওপর বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন। পর্তুগিজরা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আরাকানের বাইরে কোথাও নিতে পারতেন না। এভাবে পর্তুগিজ দস্যুরা ‘আরাকানি’ নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠে। নামে তারা পর্তুগিজ, সম্প্রদায়ের পরিচয় আরাকানি আর ভাষা হলো বাংলা।
মোগলরা বাংলায় আরাকানি দস্যুদের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করলেন। মোগল সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে এ অঞ্চলে পর্তুগিজ অধ্যুষিত এলাকায় হামলা হলো। অনেক পর্তুগিজ নিহত, গ্রেফতার ও নির্বাসিত হলো। এর পর পর্তুগিজরা মোগলদের পক্ষে লড়াইয়ে নামে। আরাকানদের হাত থেকে চট্টগ্রামের দখল নিতে তারা মোগল সুবেদার শায়েস্তা খানের পক্ষে যোগ দেয়। শায়েস্তা খানও বুঝতে পারেন এ অঞ্চল থেকে পর্তুগিজ দস্যুদের হঠাতে তাদের সঙ্গে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ সময় শায়েস্তা খানকে সহায়তা করেছিলেন তৃতীয় সেবাস্তিয়াও গনজালেস তিবাউ। ধারণা করা হয়, তিনি সেই প্রথম তিবাউয়ের বংশধর। শায়েস্তা খানের সঙ্গে তৃতীয় তিবাউয়ের মৈত্রী পর্তুগিজ দস্যুদের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। সন্দ্বীপ থেকে তারা চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়। তাদের সম্মানার্থে নতুন আবাসস্থল পরিচিত হয় ফিরিঙ্গি বাজার নামে। এখানে বসবাস করা পরবর্তী প্রজন্মের পর্তুগিজরা ছিল তিবাউয়ের সন্দ্বীপের রাজত্বের বংশধর।
জোনাথন গিল হ্যারিসের “দ্য ফার্স্ট ফিরিঙ্গিজ” গ্রন্থ অবলম্বনে