- মইনুল হোসেন
- ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২
আমি যা কিছু দেখেছি ও বুঝতে পেরেছি সেসব সত্য ঘটনা লিপিবদ্ধ করাকে অন্তরের উপলব্ধি এবং জাতির প্রতি গভীর দায়িত্ববোধের বিষয় বলে অনুভব করি, যাতে অন্যরা ঘটনার গভীরে গিয়ে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারে, নিরাপদ ও যুক্তিগ্রাহ্যভাবে স্বাধীনতা লাভের আস্বাদ পেতে পারে। বিগত বছরগুলোতে কিভাবে ও কেমন করে আমাদের দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামগুলো বিপর্যস্ত হয়ে গেছে তার একটা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। অতীতে মহান নেতারা আমাদের ভাবাবেগের আধিক্যমুক্ত, গণতান্ত্রিক রাজনীতির বহুল অনুশীলন ও অবিরাম পথচলাকে দেখিয়ে গেছেন। তাদের সমস্ত প্রজ্ঞা ও সতর্কবার্তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে, যখন আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের চরম সঙ্কটজনক মুহূর্তে সেসবের গুরুত্ব ছিল অত্যধিক। সুতরাং আমাদের অবশ্যই সেগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধের এবং অন্যদের ‘বুদ্ধি’তে এমন আনাড়ি ব্যর্থতা পরিহারের জন্য শিক্ষা নিতে হবে।
দুঃখজনক হলো, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও গণতান্ত্রিক আদর্শাবলির স্থপতি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়। ১৯৬৩-এর ৫ ডিসেম্বর লেবাননে তার মৃত্যু হলো। তার মৃত্যুতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিচক্ষণ ও দূরদর্শী এক মহান নেতার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তার মতো নেতার মৃত্যুজনিত ক্ষতির ফলে দেশের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। গণতন্ত্রের চর্চা অস্বীকার করায় গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
পাকিস্তানের এক বড় সঙ্কটজনক সময়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু ঘটে। যখন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের দুই অংশে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠছিল।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর, আওয়ামী লীগের বিশাল কর্তৃত্বের অধিকারী নেতা হিসেবে তখনকার শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান ঘটে। দলের অন্য প্রবীণ নেতারা তার বিপুল জনপ্রিয়তার জন্য সহজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকে মেনে নেন। বঙ্গবন্ধু মুজিব তার ছয়-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যান।
জনাব সোহরাওয়ার্দীর কাছে ছাত্ররা ছিল ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা গড়ে তোলার পথে রাজনৈতিক সহযোগী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের ওপর নির্ভর করেছিলেন ভীতি প্রদর্শনের পেশিশক্তি হিসেবে। এভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একটা তাৎক্ষণিক রূপান্তর ঘটে যায়।
পাকিস্তানের দু’টি অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে বিরোধ এবং দেশ শাসনে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করতে দিতে অস্বীকৃতি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলছিল এবং বহু বছর ধরে ওই অবস্থা অব্যাহত ছিল। দেশে বারবার সামরিক আইনের শাসন জারি হয় এবং সঙ্কট উত্তরণে অতি প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংলাপ ও গণতান্ত্রিক বিতর্ক অনুষ্ঠানে অন্তরায় সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য ক্ষমতার ভাগাভাগিকে মেনে নেয়া হয়নি।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রায়ই পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্বকে এ কথা বলে সতর্ক করে দিতেন যে, তিনি এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধ। প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সেতুবন্ধ তৈরি করা। কিন্তু তার বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল রাজনীতিকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ আইয়ুব খানের সামরিক সরকার গুরুত্বের সাথে নেয়নি, যদিও তাকে তার কর্মদক্ষতা ও জনপ্রিয়তার জন্য ভয়ের চোখে দেখা হতো। সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন রাজনীতি দেশের ঐক্যের জন্য জনগণের অংশীদারিত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি।
সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতির ব্যাপারে তার হতাশা থাকলেও সোহরাওয়ার্দী কখনো জনগণের জীবনকে বিপন্ন করে রাজনৈতিক হঠকারিতার পথ অবলম্বন করেননি।
পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল অন্য একটি দেশের দ্বারা বিভক্ত তার দু’টি অংশ নিয়ে। মুসলিম ভ্রাতৃত্বের রাজনীতি ও এর অখণ্ডতা বজায় রাখাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় ছিল।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান তার সামরিক শক্তিকে এবং দমন-নিপীড়নকে পাকিস্তানের দুই অংশকে সংযুক্ত রাখার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে সম-অংশীদাররূপে দেখতে পারেনি।
দীর্ঘকালের আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশে বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বাগ্মিতার শক্তি দিয়ে অন্যসব নেতাকে ছাপিয়ে গেলেন আর জাতির ভাগ্য নির্ধারণে নিজের হাতে নেতৃত্বের ভার তুলে নিলেন। প্রবীণ নেতারা আড়ালে থাকতে বাধ্য হলেন। কারণ স্বায়ত্তশাসন তাদেরও লক্ষ্য ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনাকে তো মেনে নিতেই হবে। বঙ্গবন্ধু সঙ্ঘাতের রাজনীতি এবং আন্দোলনের শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি রাজনৈতিক শক্তি সংগঠিত করতে ছাত্র নেতৃবৃন্দের সক্ষমতার ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছেন। তার নিজের রাজনৈতিক রণকৌশল ছিল কারাবন্দী জীবন বরণ করা এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, তার কারা ভোগকালে আন্দোলনে গতিসঞ্চার হবে এবং নেতৃত্ব প্রদানের কৃতিত্ব তাকেই দেয়া হবে।
একটা বিরাট চমকের সৃষ্টি হয় যখন বঙ্গবন্ধু তার নিজ দলের অপরাপর নেতাদের সাথে পরামর্শ না করেই লাহোর গিয়ে তার ছয়-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এমনকি তার মানিক ভাই (আমার আব্বা), যার রাজনৈতিক উপদেশ ও সমর্থনের ওপর তিনি অনেকটা নির্ভর করতেন, তিনিও কোনো আভাস পাননি যে, একটা অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক অভিঘাত আসছে। একটা পৃথক পতাকা ও পৃথক মুদ্রা ব্যবহার করার দাবিসংবলিত ছয়-দফা কর্মসূচি স্বায়ত্তশাসনের কোনো কর্মসূচি হতে পারে না। মানিক মিয়া (আমার আব্বা) উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হবে এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন।
মানিক মিয়া এবং আবুল মনসুর আহমদ, যিনি ছিলেন একজন প্রবীণ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের একজন নেতা ও সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সাবেক সদস্য। বয়সের কারণে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তারা দু’জনে বসে ছয়-দফার ধারালো অংশকে কিছুটা ভোঁতা তথা নমনীয় করতে চাইলেন, যাতে তাকে রাজনৈতিক দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে (নধৎমধরহরহম পড়ঁহঃবৎ) ব্যবহার করা যায়।
শুরুতে স্বায়ত্তশাসন দাবির এ ধরনের চরম রূপ বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে, এ কথা বিবেচনায় এনে মানিক মিয়া ইত্তেফাকে ছয়-দফা দাবি প্রচার করতে অসম্মতি জানান। পরে এতে কিছুটা রদবদল করা হলে মানিক মিয়া ছয়-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন জানান। দলের দাবি হিসেবে ছয়-দফা গৃহীত হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু দলের কার্যনির্বাহী কমিটির অনেকের কাছ থেকে যথেষ্ট বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, নির্বাচন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে একত্রে আলোচনায় বসে দায়িত্বশীলভাবে একটি নিষ্পত্তিতে পৌঁছানোর আবশ্যকতা সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়ার আরো ভালো সুযোগ এনে দেবে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের সাথে বোঝাপড়াটা অক্ষুণ্ণ থাকা দেখতে আব্বা এত উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তার অসুস্থতা ও দীর্ঘ কারাভোগ সত্ত্বেও তিনি পিন্ডিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এটা দেখতে যে, সেখানে মানসিকতার কোনো পরিবর্তন ঘটে কি না। দীর্ঘকাল পরে দৈনিক ইত্তেফাক এক মাস বা কিছু সময় আগে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সরকারের বাজেয়াপ্তকরণ থেকে মুক্ত হয়েছে। ইত্তেফাককে নতুন করে সংগঠিত করতে আব্বার আরো সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি নির্বাচনসংক্রান্ত রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী খবরাখবর পাচ্ছিলেন। নির্বাচন যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটি বুঝতে পেরে তিনি এ ব্যাপারে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে পারছিলেন না।
ইয়াহিয়া খান ইতঃপূর্বে ১৯৫৬ সালের গণসংবিধানের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ওই সংবিধান বাতিল করে ১৯৬২-এর সংবিধান প্রতিস্থাপন করেন, যা তিনি ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার উপযোগী করে প্রণয়ন করেছিলেন। যে উপায়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন সেভাবেই তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন।
নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হলো এই পূর্বশর্তে যে, ১৯৫৬-এর সংবিধান সংশোধনের জন্য সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে। এ ব্যবস্থা বুঝিয়ে সামরিক শাসকদের রাজি করানোর ব্যাপারে মানিক মিয়া ও তার দৈনিক ইত্তেফাকের কণ্ঠস্বর ছিল শক্তিশালী। তবে তা পশ্চিম পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ সংসদে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের হাতে একতরফাভাবে সংবিধান পরিবর্তনের বিপদ আঁচ করছিলেন। অবশেষে তারা একটা ঝুঁকি নিলেন এবং তাতে সম্মত হলেন এ কথা মনে করে যে, রাজনীতি আপস-মীমাংসার একটি প্রক্রিয়া। তাই কিছুটা আপস করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধুর ওপর মানিক মিয়ার প্রভাবের ওপর তাদের বিশ্বাস ছিল।
কিন্তু পিন্ডিতে অবস্থানকালে ১৯৬৯-এর ১ জুন আব্বা আকস্মিকভাবে এবং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে মৃত্যুবরণ করেন। অত্যন্ত শোকাহত হয়ে বঙ্গবন্ধু গভীর রাতে আমাদের কাকরাইলের বাড়িতে ছুটে এসে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন ‘হিরু…হিরু’। আমার স্ত্রী শুনতে পেয়ে আমাকে জাগিয়ে দিলেন। আমি নিচে নেমে এলাম। বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘মানিক ভাই আর নেই।’ আমি তাকে শক্ত করে আঁকড়ে তার পায়ের ওপর পড়ে গেলাম। আব্বার মৃত্যু আমার চিন্তার সম্পূর্ণ বাইরে ছিল। তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত ও লড়াকু চেতনার একজন মানুষ।
আম্মা পিন্ডির আরেকটি হোটেলে আব্বার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিলেন, যেখানে তার আর ফেরা হয়নি। আম্মা ছিলেন একা। তাকে একাই মর্মান্তিক শোকের আঘাত সহ্য করে নিতে হয়। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছে দোষী বিবেকে তিনি প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন সেটি হলো, ‘আমি তোমাদের আব্বাকে জীবিত ফেরত আনতে পারলাম না।’ তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেলেও ভেঙে পড়েননি।
বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার প্রিয় মানিক ভাইয়ের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, তাকে হত্যা করা হয়েছিল। আমি জানতে পেরেছি আব্বার সাথে ছিলেন সদরে ইস্পাহানি, দৈনিক সংবাদ-এর মালিক আহমেদুল কবির ও আরো কয়েকজন। তাদের সবাই পূর্ব পাকিস্তান থেকে গিয়েছিলেন। তারা সবাই নিশ্চিত করেন যে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই তার মৃত্যু হয়েছে। আব্বার আগে থেকে হৃদরোগের সমস্যা ছিল, তবে সেটি তাদের জানা ছিল না।
বঙ্গবন্ধু এই বিয়োগব্যথায় হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। আমি জানতাম, আমার আব্বা ও বঙ্গবন্ধু কত গভীরভাবে পরস্পরের প্রতি সহানুভ‚তিশীল ছিলেন। আমার মনে পড়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময় আব্বা বিচারের মুখোমুখি হতে বঙ্গবন্ধুকে সাহস জোগাতে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য অস্থির থাকতেন। ইতঃপূর্বে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দৈনিক ইত্তেফাক বাজেয়াপ্ত করেছিলেন এবং আমরা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে ছিলাম। পেট্রলের খরচ বাঁচাতে তিনি কুর্মিটোলা যেতে অন্যের মুখাপেক্ষী হতেন।
অসময়ে আব্বার মৃত্যু ছিল আমাদের জনগণের গণতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতি। জনাব সোহরাওয়ার্দীর চলে যাওয়ার পর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি হিসেবে বেঁচে ছিলেন মানিক মিয়া। এখন নেতৃত্বের সব ভার শেখ মুজিবুর রহমানকে বহন করতে হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার চার পাশে শূন্যতা দেখতে পাচ্ছিলাম। আব্বা ছিলেন একজন আত্মবিশ্বাসী বিশাল ব্যক্তিত্ব। আকস্মিকভাবে আমাদের সুখী পরিবারের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আব্বার কোনো কিছু হয়ে গেলে সিরাজউদ্দিন হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বললেন, আমারই সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়া উচিত। আমি সাংবাদিক হতে গেলে যে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, সেটি ছাড়া এক নম্বর দৈনিক পত্রিকাটির সম্পাদক হওয়া হাস্যকর ও লজ্জাজনক হবে বলে মনে করলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, আমার নিজস্ব আইন পেশা থেকে বিচ্যুত না হওয়া।
দৈনিক ইত্তেফাকের বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে আদালতে এ কে ব্রোহীর সাথে কষ্টসাধ্য আইনি লড়াইয়ে অংশগ্রহণের জন্য ড. কামাল হোসেন ইত্তেফাকের সাংবাদিক পরিবারে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতেন। তা ছাড়া আমি সে সময় তার ল ফার্মে একজন জুনিয়র হিসেবে কাজ করছিলাম। সুতরাং আমার অজান্তে তারা এ ব্যাপারে ড. কামালের সাহায্য চাইলেন। ওই মুহূর্তের জরুরি বিষয় ছিল সংবাদপত্রটির সম্পাদক হিসেবে একজন মৃত মানুষের নাম ছাপা হতে পারে না। ড. কামাল অনুগ্রহ করে এসে আমাকে বললেন, সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্বটি গ্রহণ করতে। অনেক বিষয় সংগঠিত করার প্রয়োজন ছিল। এভাবে আমাদের রাজনীতির ওই সঙ্কটজনক সময়ে রাজনৈতিকভাবে সর্বাধিক প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক হতে রাজি হলাম। সে সময়ের বিশৃঙ্খল রাজনীতি ছয়-দফা কর্মসূচিকে নিয়ে আবর্তিত হচ্ছিল। সিরাজউদ্দিন হোসেনের এ কথা বোঝার দূরদর্শিতা ছিল যে, ইত্তেফাক একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং মানিক মিয়ার পুত্র হিসেবে পুরোভাগে আমার উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার অন্তরঙ্গতার কারণেও আমি সঙ্কটের ধারাবাহিকতাকে কাছ থেকে খতিয়ে দেখার বিশেষ সুবিধা পেয়েছি, যা চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে, তবে যে উপায়ে তা এসেছে সেটি আমাদের কাম্য ছিল না।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে যার খ্যাতি ছিল, তার তৈরি সেই দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান (আমি তাকে কাকা বলে ডাকতাম) পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অপ্রতিদ্ব›দ্বী নেতারূপে আবিভর্‚ত হন। স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের জন্য ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে তিনি ম্যান্ডেট-প্রাপ্ত হন।
বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও প্রবঞ্চনার মধ্যে শান্তিপ্রিয় জনগণকে ক্রমেই নিরস্ত্র ও নেতাবিহীন অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস সামরিক অভিযানের মুখোমুখি হতে ঠেলে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সত্যি ঘটনা হলো, তিনি ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিজ্ঞতাকে অভিজ্ঞ এবং অধিকতর নির্ভরযোগ্য সম্মানিত ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন, যার বেদনাদায়ক পরিণতি হলো তরুণদের কথা শুনে এবং প্রবীণদের নির্দেশনা না নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজের ও দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনেন। আমরা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হলাম। ছয়-দফা প্রশ্নে মীমাংসায় আসাকে যদি ব্যর্থ করে না দেয়া হতো তবে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রকৃত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল।
ঘটনার অগ্রগতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। গ্রহণযোগ্য ছয়-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন কার বা কাদের পরামর্শে অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেল? হ
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী,
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট