ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনার তদন্তে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। দু’বার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয় দফায় কলকাতায় আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করে খুনিরা। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জেও তাঁকে হত্যার ছক করা ছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলে নিজ জন্মভূমিতেই মেরে ফেলার সব আয়োজন করা হয়। তবে নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় সেই ছক থেকে সরে আসে পরিকল্পনাকারীরা। তারা বুঝতে পেরেছিল, সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় কালীগঞ্জে আজীমকে হত্যা করা হলে এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এ ছাড়া কালীগঞ্জে তাঁর আশপাশে সব সময় দু-চারজন থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে হত্যা মিশন শেষে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে এসব তথ্য জানান।
তদন্তে যুক্ত একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আজীমকে হত্যার মূল কারণগুলো বের করার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। স্বর্ণ চোরাচালানকেন্দ্রিক বিরোধ, নাকি রাজনৈতিক কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে– তা সন্দেহাতীতভাবে বের করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া চরমপন্থিদের সঙ্গে অতীত কোনো বিরোধের জেরে আজীমকে টার্গেট করা হয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এমনকি আজীমের শত্রুদের কেউ পেছন থেকে একত্রিত করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিনা, সেটিরও চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত ঠিক কত টাকা এ হত্যাকাণ্ডে লেনদেন হয়েছে, তা বের করতে পারেননি গোয়েন্দারা। তবে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্স থেকে হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ আগে ৫ অথবা ৬ মে আক্তারুজ্জামান শাহীন ও তাঁর বেয়াই শিমুল ভূঁইয়া ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে ফোন দেন। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, ওই কথোপকথনে টাকার অঙ্ক নিয়ে আলাপ হয়। মিন্টু টাকার বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। পরবর্তী সময়ে তারা ঢাকায় ফিরে বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও টাকা দিতে গড়িমসি করেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের মধ্যে টাকার দেনদরবার নিয়ে কী ধরনের কথাবার্তা হয়েছে, সেটি তারা বের করবেন। তবে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে মিন্টু এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।
তদন্তে যুক্ত আরেক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত দুই আসামি ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে মিন্টুর নাম বলেছেন। তারা হলেন শিমুল ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা বাবু। আসামিদের জবানবন্দি ছাড়াও প্রযুক্তিগত তদন্তে এ বিষয়গুলোর বিশদ তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে। এমনকি হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকায় দুটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে কারা ছিল, তাও তদন্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক শাহীনকে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আপাতত মনে হলেও তাঁর পেছনেও কেউ রয়েছে কিনা, সেদিকে নজর গোয়েন্দাদের। কারণ, টাকার বিনিময়ে বড় ধরনের অনৈতিক কাজে জড়ানোর নজির শাহীনের ক্ষেত্রে রয়েছে।
এদিকে গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, আজীম হত্যার ঘটনায় মামলার তদন্তকাজ স্বাধীনভাবে এগিয়ে নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে কারও হস্তক্ষেপ বা কোনো চাপ নেই। হত্যা মামলার তদন্ত যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, সে জন্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
‘মিন্টুই মূল পরিকল্পনাকারী’
কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি জানান, সংসদ সদস্য হত্যার প্রতিবাদে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে খুনিদের ফাঁসির দাবিতে শনিবার বিকেলে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শহরে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে স্থানীয় ইদগাহ মাঠে এসে মিছিল শেষ হয়। এতে সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সভায় কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম আশরাফ বলেন, মিন্টুই এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। তাঁর প্রতিনিধি কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবু ডিবির হাতে আটকের পর ওই হত্যাকাণ্ডে মিন্টুর সংশ্লিষ্টতার অনেক তথ্যই ফাঁস হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী মিন্টুর সঙ্গে কালীগঞ্জে তাঁর অনুসারীদের বেশ কয়েকজন নেতাও জড়িত থাকতে পারেন। প্রশাসন দ্রুত তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনবে, এটা বিশ্বাস করি। মিন্টুসহ সব যড়যন্ত্রকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও তাঁর করা পকেট কমিটির বিলুপ্তি চাই।’
বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও যুবলীগের সভাপতি শিবলী নোমানী, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মন্টু, কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন সোহেলসহ নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া একই দাবিতে বিকেলে শহরের প্রধান বাসস্ট্যান্ডে মানববন্ধন করেছে কালীগঞ্জ উপজেলা মোটর মালিক সমিতি।
samakal