সংকট উত্তরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিকল্প নেই

দেশের চলমান সংকট উত্তরণের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই মুহূর্তে দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন এখন করে লাভ নেই। এই মুহূর্তে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে এই দেশে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। বর্তমানে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে কেবলমাত্র নির্বাচনকেন্দ্রিক সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন। শনিবার রাজধানীর গুলশানে দ্য ওয়েস্টিন হোটেলে নাগরিক ঐক্যের উদ্যোগে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে- এই সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের সাংবিধানিকতা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। কেবলমাত্র একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতেই সরকার সকল আয়োজন করেছে। আমরা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কাউকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে কথা বলছি না।

আমরা বলছি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কথা। আমরা সুজনের পক্ষ থেকে বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সংলাপ প্রয়োজনীয়তার কথা বলছি এবং সেই আলোকে কাজ করছি। আমি মনে করি, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধিনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।

 

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, এই সরকার একদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, অন্যদিকে মানবাধিকার হরণ করেছে। গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আজকের সেমিনারে নাগরিক ঐক্য যে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছে, সেখানে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে মানবিক, গণতান্ত্রিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, কিছু কর্মসূচি বা পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো নিয়ে আরও ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করা প্রয়োজন। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা যে নামেই হোক না কেন, তার অধীনেই নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এই সরকার যে উন্নয়নের কথা বলে সেই উন্নয়ন হয়েছে তাদের সহযোগী লুটপাটকারীদের। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এটা তো এক দলের সরকার না। এটা এক ব্যক্তির সরকার। উনি (প্রধানমন্ত্রী) যা বলেন, সব মন্ত্রণালয় এমনকি বিচার বিভাগ ঠিক তাই করে। মধ্যযুগীয় রাজাদের মতো ক্ষমতা যার হাতে তার অধীনে আর যাই হোক, কোন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না।

সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, আপনারা যদি জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করেন, জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, তাহলে তো বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপ করবেই। আপনারাই তো বিদেশি শক্তিকে সেই সুযোগ দিয়েছেন। নাগরিক ঐক্য যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছে, আমি মনে করি এরকম একটা সরকার সংকট উত্তরণের জন্য এই মুহূর্তে দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন এখন করে লাভ নেই। এই মুহূর্তে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোন বিকল্প নেই।

সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৭ ও ১৯৪৬ এবং পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচন নিয়েও এত প্রশ্ন ছিল না, যতটা প্রশ্ন করা যায় ২০১৪ এবং ২০১৮ এর নির্বাচন নিয়ে। দলীয় সরকারের অধীনে এই দেশে কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। বর্তমানে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে কেবলমাত্র নির্বাচনকেন্দ্রিক সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন।

সভাপতির বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকার দেশকে চরম অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। একইসঙ্গে অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে আবারও একটি একতরফা প্রহসনের নির্বাচন আয়োজনের পাঁয়তারা করছে। আমরা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন তথা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা বলছি। রাষ্ট্রের এমন একটি সংস্কার যাতে সত্যিকার অর্থেই জনগণ রাষ্ট্রের মালিক হয়ে ওঠে এবং নতুন করে কোন স্বৈরাচারের জন্ম হতে না পারে। আমরা একটা সম্ভাবনার সূর্য দেখছি এবং আমাদের বিশ্বাস, ‘আমরা পারব’। আর এই পরিবর্তনের, এই সংস্কারের সূচনা করতে হবে এখনই, ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে দেশ যে চরম রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে, সেই সংকট উত্তরণের জন্য এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা প্রয়োজন যে সরকার ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত করে একটি সত্যিকারের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে। এজন্য ৩ মাস, ৩ দিন বা ৩ বছর – কতদিন লাগবে তা বলছি না। তবে শাসন কাঠামোর সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বিগত ১৫ বছরের জঞ্জাল সরিয়ে সত্যিকার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করেই নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন আব্দুল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার, ডা. জাহেদ উর রহমান। সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার।