এক বছর আগে ঘোষিত দরের চেয়ে ১-২ টাকা বেশি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কেনায় ছয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। একই অভিযোগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এসে আরো ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে জরিমানা করা হয়েছিল। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই ব্যাংকগুলো এখন ঘোষিত দরের চেয়ে ১২-১৪ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে ডলার কিনছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠার কারণেই ব্যাংকগুলো মুদ্রাটি সংগ্রহে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বণিক বার্তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে গতকাল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জগুলো প্রতি ডলার ১২২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৩ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ লেনদেনই হয়েছে ১২৩ টাকার বেশি দরে। আন্তর্জাতিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘ট্রান্সফাস্টের’ কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১২৪ টাকা দরেও রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে দেশের অনেক ব্যাংক। আর যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘ট্যাপট্যাপ’ থেকে সংগ্রহ করা ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘জিসিসি এক্সচেঞ্জ’ থেকেও একই দরে রেমিট্যান্স কিনেছে দেশের ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকগুলো যে দামে ডলার কিনছে, তার চেয়ে ১-২ টাকা বেশি দামে আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময় হার গ্রাহকভেদে ১২৫ টাকায় গিয়েও ঠেকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) থেকে এখন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। সংগঠন দুটির বেঁধে দেয়া দর অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় রফতানি ও রেমিট্যান্সের ডলার কেনার কথা। আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির কথা সর্বোচ্চ ১১১ টাকায়। যদিও ঘোষিত এ দরের কোনো প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের ঘোষিত দরের সঙ্গে বাজার পরিস্থিতির কোনো সামঞ্জস্য নেই। এ কারণে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) পরিশোধের জন্য অনেক বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। বিদেশী মানি এক্সচেঞ্জগুলো ডলারের যে দর প্রস্তাব করছে, সেটি ঘোষিত দরের চেয়ে ১২-১৪ টাকা বেশি। ব্যাংকগুলো যদি ওই দামে ডলার না কেনে, তাহলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ হুন্ডিতে চলে যাবে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় বিপর্যয়ে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও যেকোনো মূল্যে রেমিট্যান্স আনার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় অর্ধেকই আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির মাধ্যমে। গতকাল এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে ব্যাংকটি ডলারপ্রতি ১২৩-১২৪ টাকায় রেমিট্যান্স কিনেছে। চলতি নভেম্বরের প্রথম পাঁচদিনে ব্যাংকটি রেমিট্যান্স কিনেছে প্রায় ৫ কোটি ডলার। এ রেমিট্যান্সের পুরোটাই ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দরে কেনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘বড় ব্যাংক হওয়ায় আমাদের ডলারের চাহিদা বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদার আলোকে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে বলেছে। বিদেশী মানি এক্সচেঞ্জগুলো এখন ডলারপ্রতি ১২৩-১২৪ টাকা পর্যন্ত প্রস্তাব করছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছি।’
দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার শুরু গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দর বেঁধে দেয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশি দামে ডলার বেচাকেনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশী-বিদেশী ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব তৎপরতার মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক ধাক্কায় রেমিট্যান্স ৫০ কোটি ডলার কমে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এলেও সেপ্টেম্বরে তা ১৫৩ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। এরপর থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখনই ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কঠোর হয়েছে, তখনই বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় দেখা গেছে।
চলতি বছরের আগস্টেও বেশি দামে ডলার বেচাকেনা ঠেকাতে দেশের ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে জরিমানা করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অভিযানের মধ্যেই রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে যেকোনো মূল্যে রেমিট্যান্স আনার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এতে গত মাসে (অক্টোবর) দেশের রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে। মূলত ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি পরিশোধের কারণেই গত মাসে রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি নভেম্বরের প্রথম পাঁচদিনে সবচেয়ে বেশি ৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ২ কোটি ৬৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আনার মাধ্যমে এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো যমুনা ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক।
এতদিন দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের পরই অবস্থান ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেশি দামে রেমিট্যান্স আনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে পড়েছে। রেমিট্যান্স সংগ্রহে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায়ও এখন রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকের নাম নেই।
একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এলসি দায় পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা পাচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার কোনো মানসিকতাই নেই। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
এদিকে প্রত্যাশিত মাত্রায় রেমিট্যান্স না আসায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় বেড়েই চলছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) গতকাল দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সে হিসাবে গত দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভের পরিমাণ নেমেছে অর্ধেকেরও অনেক নিচে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোর আমদানি দায় পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে রিজার্ভ থেকে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েও রিজার্ভের ক্ষয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যেকোনো উপায়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে কোনো উপায় নেই।
ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি শুরু থেকেই ভুল ছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বহু আগে থেকেই আমরা ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো কিছুই আমলে নেয়নি। রিজার্ভ শক্তিশালী অবস্থানে থাকা অবস্থায় ডলার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ত। এতে রিজার্ভের ক্ষয় না হয়ে বরং সমৃদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শুরুতে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে দর সংশোধন হয়ে বাজার স্থিতিশীল হতে পারত। কিন্তু বিনিময় হার বেঁধে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ অর্ধেকের বেশি শেষ করে ফেলেছে। এখনই যদি ডলারের দাম ১২৩-১২৪ টাকায় উঠে যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো বেশি খারাপ হবে।’
যদিও ডলার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ভুল ছিল না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতির বিচারে ওই সময়ের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ‘ইনিশিয়াল পাগলামি’ হতো। এক ধাক্কায় ডলারের দর অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণেই সেটি হয়নি।’
১২৩-১২৪ টাকায় ডলার কেনার বিষয়টিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে দেখছে জানতে চাইলে মেজবাউল হক বলেন, ‘বাফেদার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ক্রস কারেন্সি হিসাবে ২ শতাংশ এবং অতিরিক্ত আরো আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব হিসাব বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলো এর চেয়েও বেশি দরে রেমিট্যান্স কিনছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।’
বনিক বার্তা