শেয়ার মার্কেটে অস্থিরতা

শেয়ার মার্কেটে অস্থিরতা

দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর এখন যেন রাজরাক্ষসদের কবলে পড়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা ক্রমে স্থায়ী রূপ পেতে শুরু করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর হলমার্ক, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একের পর এক নানা কেলেঙ্কারি ঘটে গেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাও কারো অজানা নয়। এমনকি শেয়ার মার্কেট থেকেও লাখো-কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে এ সরকারের আমলেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, কোনো ক্ষেত্রে এসব রাজরাক্ষস বিচার বা শাস্তির মুখোমুখি হয়নি। সঙ্গত কারণেই এসব অপতৎপরতা এখনো ক্রমবর্ধমান। জাতীয় অর্থনীতির জন্য এগুলো কোনো শুভ লক্ষণ নয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেয়ার মার্কেট অস্থির ও অশান্ত থেকেছে। ঘটেছে পুকুরচুরি থেকে সাগরচুরির ঘটনাও। বিদায়ী বছরও তা থেকে আলাদা ছিল না। সে ধারাবাহিকতায় গত বছর পুঁজিবাজারে দরপতন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। জানা যায়, গত বছরের শেষ সাত মাসেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।

শেয়ার মার্কেটে দরপতন শুরু হয় ২০১০ সাল থেকেই। বিদায়ী বছরে সে অবস্থার বড় ধরনের অবনতি ঘটে। নতুন করে বিনিয়োগ তো আসেইনি, উল্টো অনেকেই বড় লোকসান দিয়ে সমুদয় শেয়ার বিক্রি করে ফেলেছেন। অব্যাহত পতনে পর্যুদস্ত বাজারে মূলধন হারিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। লাগাতার দরপতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, বিভিন্ন প্রভাবশালী সংস্থা, ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংককে চাপ দিয়ে শেয়ার বিক্রি বন্ধে বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতেও কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি।

গত বছরের শুরুতে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ফেরাতে তাদের শেয়ারবাজার এক্সপোজার সীমা সংশোধন করে সুযোগ দেয়া হলেও তারা বিনিয়োগে ফেরেনি। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে দেয়া সরকারের ৯০০ কোটি টাকা কমিশনের অব্যবস্থাপনার কারণে কোনো কাজে আসেনি। সম্প্রতি ওই তহবিলের প্রায় ৭৬১ কোটি টাকা আইসিবিকে দেয়া হলেও বাজারে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই।

গত বছরের ২৭ জানুয়ারি বাজার সূচকটি ৫৯৯২ পয়েন্টে ওঠার পর যে পতন শুরু হয়েছে, সে অবস্থার এখনো উন্নতি হয়নি। সেই সূচকই বছরের শেষ প্রান্তে নেমে এসেছে চার হাজার ৪৩৪ পয়েন্টে। ডিএসই প্রধান সূচক প্রায় ৯ মাসে কমেছে ১২০০ পয়েন্ট। একই সময়ের ব্যবধানে বাজার মূলধন বা শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। ৯ মাসে সূচক কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর বাজার মূলধন কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১৯ কোম্পানির মধ্যে ৪৬টি বা প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। কারণ, বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই।

ফলে ডিএসই ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মুনাফা কমেছে। এফডিআর থেকে মুনাফা নির্ভর আয়ের ডিএসই গত চার অর্থবছর ধরে মুনাফায় নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় এবারো স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদ ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব অনুমোদন ও লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

মূলত পুঁজিবাজার পতন হয়েছে তিনটি কারণে। বিদায়ী বছরের দুই মাসে যে পরিমাণে সূচক কমেছে তার কারণ হচ্ছে বিদেশীদের বিক্রয় এবং গ্রামীণফোনের ইস্যু। আরেকটা বিষয়- টাকার ডিভ্যালুয়েশন। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে দরপতন শুরু হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দরপতন শুরু হয়। সম্প্রতি কার্যদিবস সূচক কমে নেমে এসেছে ৭৯ পয়েন্টে। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক কমেছে দুই পয়েন্ট। সূচকের পাশাপাশি কমেছে লেনদেনও। বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহে সিএসইর প্রধান সূচক কমেছে এক পয়েন্টে। লেনদেনও কমেছে। যা বিনিয়োগকারীদের রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া দরপতন এখন একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ফলে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়েছে ৮৩ হাজার ৩২৩ কোটি ৯ লাখ টাকা মূল্যমানের। একইভাবে সিএসইর বিনিয়োগকারীদেরও পুঁজি কমেছে ৮৩ হাজার কোটি টাকা। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২৫ লাখ ৭৮ হাজার বিনিয়োগকারী রয়েছেন। এর মধ্যে ডিএসইর প্রধান সূচক ১ দশমিক ৮৭ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৪১৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ২০৩টির, কমেছে ৯৪টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৫৬টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। আর তাতে লেনদেন হয়েছে ২৫৪ কোটি ৩৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। সিএসইতে লেনদেন হওয়া ২৩০টির কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ১১৯টির, কমেছে ৭৭টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৪টির। এদিন লেনদেন হয়েছে ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।

গত বছরের নভেম্বর মাসের শুরুতেই দেশের শেয়ার মার্কেটে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু সে অবস্থা স্থায়ী হয়নি। আবার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কিছু চাঙ্গা ভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে চার কার্যদিবসেই বেড়ে গিয়েছিল সার্বিক মূল্যসূচক। এর পরও সপ্তাহজুড়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বাজার মূলধন হারিয়েছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

পুঁজিবাজার জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অথচ সরকারের উদাসীনতা, অব্যবস্থাপনা ও সীমাহীন অনিয়মের কারণেই বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে এবং সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, নানা প্রতিশ্রুতির পরও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। বিশেষ করে গত নির্বাচনের পর থেকে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা আরো বেড়েছে। এ জন্য দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও গণতন্ত্রহীনতার কথাও আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাঁচ কারণে পুঁজিবাজারে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, দুর্বল আইপিও, বিশৃঙ্খল আর্থিক বিবরণী, বিও অ্যাকাউন্টে স্বচ্ছতার অভাব, সেকেন্ডারি মার্কেটে সন্দেহজনক লেনদেন ও প্রশ্নবিদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি আরো বেশি শেয়ার ও বন্ড মার্কেটের শেয়ার জোগান দেয়া হলে পুঁজিবাজার হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে উদাসীন।

যেভাবেই হোক, সরকারের ধারাবাহিকতা এবং দেশের অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক অবস্থার মধ্য দিয়ে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০১৯ সাল। নতুন বছরের শুরুতেই পুঁজিবাজারও গতিশীল হয়ে উঠেছিল। লেনদেনও হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা কোনোভাবেই স্থায়ী হতে পারেনি। প্রত্যাশার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অস্থিতিশীল ও দরপতনের মধ্য দিয়ে ২০১৯ সালের পুরো সময়ই বাজারের সব ক’টি সূচকের দরপতন ঘটেছে। বিনিয়োগকারীদের আশা ভঙ্গের মধ্য দিয়েই কেটেছে ২০১৯ সাল। জানুয়ারির ঊর্ধ্বগতি আর দু-একবার সাময়িক দর বৃদ্ধি বাদ দিলে সারা বছরই মন্দাভাব চলেছে পুঁজিবাজারে। বছরজুড়েই বাজারের গতি মন্দা থাকলেও ডিএসই বাজার উন্নয়নে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফার বাই স্মল ক্যাপিটাল কোম্পানিজ) রুলস ২০১৮ সালের অধীনে পণ্যের বহুমুখিতায় বহুল প্রতীক্ষিত ‘ডিএসই এসএমই প্লাটফর্ম’ চালু করে।

ফলে স্বল্প মূলধনী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডিএসইতে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহের নতুন ও সম্ভাবনাময় দ্বার উন্মোচিত হবে এবং এতে পুঁজিবাজারে পণ্যের বৈচিত্র্যতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে সরকারের পক্ষে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। ডিএসই এসএমই প্লাটফর্ম উদ্বোধনের পর থেকেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টির জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজও শুরু করেছিল। যেহেতু পুঁজিবাজার তথা দেশের অর্থনীতিতে এসএমই প্লাটফর্ম অভিনব এক সংযোজন, সেহেতু এর প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টিও জরুরি। সে ধারাবাহিকতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানিগুলোকে কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের মানোন্নয়নের পাশাপাশি এসএমই প্লাটফর্মের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন ইস্যু ম্যানেজার, অডিটর এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সাথে এই প্লাটফর্মের সুযোগ-সুবিধার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাও হয়েছে বারবার। প্রচার-প্রচরণাও নেহাত কম হয়নি। কিন্তু এতেও পুঁজিবাজারের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

সরকারের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে, ডিএসইর সেকেন্ডারি মার্কেটে সরকারি বন্ডগুলো ট্রেডেবল করার জন্য বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ডিএসই একটি কার্যকর কমিটি গঠন করেছে। কমিটি সম্মিলিতভাবে এক্সচেঞ্জ প্লাটফর্মে বন্ডের লেনদেনপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য জোরালোভাবে কাজ করছে। বন্ড মার্কেট প্রাণবন্ত করার জন্য ডিএসই প্লাটফর্মে শিগগিরই বন্ড মার্কেটকে সক্রিয় করা হবে বলে জোরালো প্রচার-প্রচারণাও চালানো হয়েছে। কিন্তু এসব শুধু সরকারের কথামালার ফুলঝুরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

মূলত দেশ পরিচালনায় সরকারের সাফল্য কোথায় কোথায় তা এখন অনুবীক্ষণ যন্ত্রে খুঁজে দেখতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরও পড়েছে শ্যেনদৃষ্টিতে। ফলে দুর্নীতির বরপুত্ররা এখন প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শেয়ার মার্কেটসহ অর্থনৈতিক সেক্টরকে রাজরাক্ষসদের হাত থেকে বাঁচাতে হলে সরকারকেই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

E-mail: [email protected]