সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বড় কিছু বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ারের বিক্রির চাপ ছিল। এর মধ্যে অনেক শেয়ার ছিল যেগুলো সূচকে বড় প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া সূচকের ক্রমাগত পতন দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও আরও পতনের শঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করেন। এতে পতন ত্বরান্বিত হয়।
তবে পরিস্থিতি নাজুক করেছে মার্জিন ঋণের কেনা শেয়ারগুলোর ‘ফোর্স সেল। ক্রমাগত দরপতনে গ্রাহকদের থেকে নতুন করে মার্জিন না পাওয়ায় কিছু ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক শেয়ার বিক্রি করেছে।
দিনের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, লেনদেনের প্রথম অর্ধে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত মিশ্র ধারায় চলছিল লেনদেন। সূচকও ঊর্ধ্বমুখী ছিল কয়েক পয়েন্ট নিয়ে। সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর ২০ মিনিটে আগের দিনের থেকে ৩৬ পয়েন্ট বেড়ে ৬১৯২ পয়েন্টে ওঠে। কিছুটা ওঠানামা শেষে দুপুর সোয়া ১২টায় ছিল ৬১৬২ পয়েন্টে। এর পর হঠাৎ বিক্রির চাপে ছন্দপতন হয়। শেষ পর্যন্ত ক্রমাগত দরপতনে পতন হয় সূচকের। স্বাভাবিক লেনদেন শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে দুপুর ২টা ১৭ মিনিটে আগের দিনের তুলনায় ৭৯ পয়েন্ট বা দিনের সর্বোচ্চ অবস্থানের তুলনায় ১১৫ পয়েন্ট হারিয়ে সূচকটি ৬০৭৬ পয়েন্টে নামে। সমাপনী মূল্যের হিসাবে শেষ পর্যন্ত ৭৭ পয়েন্ট হারিয়ে থামে ৬০৭৯ পয়েন্টে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এদিন মাত্র ৯ কোম্পানির শেয়ারদর ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়লেও ১০৭ কোম্পানির শেয়ারদর ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত কোম্পানির শেয়ার টানা দর হারাচ্ছে। জিএসপি ফাইন্যান্স এবং বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ার টানা ষষ্ঠ দিনেও সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন দরে কেনাবেচা হয়েছে। কিন্তু বিক্রেতার তুলনায় ক্রেতাশূন্য অবস্থা চলছে। যদিও জিএসপি ফাইন্যান্সের শেয়ারদর এর প্রত্যাহারকৃত ফ্লোর প্রাইস ৩০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে কমে ১৬ টাকা ২০ পয়সায় এবং বিডি ফাইন্যান্সের দর প্রত্যাহারকৃত ফ্লোর প্রাইস ৪৪ টাকা ১০ পয়সা থেকে কমে ২৩ টাকা ৬০ পয়সায় নেমেছে।
লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের সিইও সাফফাত রেজা সমকালকে বলেন, গত সপ্তাহের প্রথম তিন দিন বাজার ভালো আচরণ করেছিল। তবে এর পর থেকে অনেক শেয়ার ক্রমাগত দর হারাচ্ছে। অনেক বিনিয়োগকারী আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন। কিছু শেয়ারের দর অর্ধেক হয়েও ক্রেতা মিলছে না। এমনটি দেখে কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো অন্য যেসব শেয়ারে ক্রেতা রয়েছে, সেগুলো ফোর্স সেল করছে।
গতকাল সিরামিক খাতে সবচেয়ে বেশি দরপতন হয়েছে। এ খাতের পাঁচ কোম্পানির সবগুলোর গড়ে সোয়া ৮ শতাংশ দরপতন হয়। প্রায় ৫ শতাংশ দরপতন নিয়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত ছিল খাতওয়ারি দরপতনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে। এ খাতের লেনদেন হওয়া ২২ কোম্পানির ২১টিরই দরপতন হয়েছে। অধিকাংশ শেয়ারের ক্রেতা ছিল না। এখনও ফ্লোর প্রাইস কার্যকর থাকা আইডিএলসিও ক্রেতাশূন্য ছিল।
সবচেয়ে বেশি কোম্পানি থাকা বস্ত্র খাতের অবস্থাও ছিল একই রকম। খাতটির তালিকাভুক্ত ৫৮ কোম্পানির মধ্যে ৫৩টির দরপতন হয়েছে, দর বেড়েছে মাত্র তিনটির। গড়ে এ খাতের শেয়ারের দরপতন হয়েছে সোয়া ৪ শতাংশ হারে। এ ছাড়া প্রকৌশল, সেবা ও নির্মাণ, পাট, ভ্রমণ ও অবকাশ এবং বিবিধ খাতের ৩ থেকে পৌনে ৪ শতাংশ দরপতন হয়েছে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক আবু আহমেদ মনে করেন, গত দু’দিনের দরপতনের বড় কারণ মার্জিন ঋণে কেনা শেয়ারগুলোতে ফোর্স সেল বেড়েছে। তিনি সমকালকে বলেন, ক্রমাগত দরপতন হলে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক তাদের নিজস্ব অর্থ বাঁচাতে ফোর্স সেল করবে– এটাই স্বাভাবিক। লেনদেন ধারা দেখে মনে হচ্ছে, তারা এটা করছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো সুদ আয় করলেও পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের মতো বাজারে মার্জিন ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কারণ উত্থানে মার্জিন ঋণ সহায়তা করলেও পতনে এ মার্জিন ঋণই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করে। তার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা লেনদেন ও সূচক বাড়াতে মার্জিন ঋণ হার বাড়িয়ে যায়। এমন ভ্রান্ত নীতির কারণে শেয়ারবাজার কখনও স্বাভাবিক ধারায় যেতে পারবে না।
সমকাল